ইমরান খান কি কথা রাখবেন?

ইমরান খান। ছবি: ফাইল ছবি
ইমরান খান। ছবি: ফাইল ছবি

স্বপ্ন দেখানো মানুষেরা কীভাবে দ্রুত গতানুগতিক রাজনীতিবিদ হয়ে যান, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তার একটা উদাহরণ হতে চলেছেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি প্রথম করাচি গিয়েছিলেন গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর। সফরকালে সবাইকে বিস্মিত করে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, করাচিসহ পাকিস্তানজুড়ে বাংলাভাষীদের মধ্যে যাদের পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট নেই, তাদের তা দেওয়া হবে। এই ঘোষণা শুনে করাচি প্রেসক্লাবের সামনে বাঙালি ও আফগানরা ‘শোকরানা সমাবেশ’করে। তারপর প্রায় আট মাস পেরিয়ে গেছে, কিন্তু চমকপ্রদ ওই ঘোষণার কিছুই বাস্তবায়ন করা হয়নি।

পাকিস্তানের বাংলাভাষীদের জন্য বাংলাদেশে উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা-সহানুভূতি খুব বিরল। অথচ একই ভাষা, সংস্কৃতি ও পূর্বপুরুষের ঐতিহাসিক যোগসূত্র ধারণ করে আছে তারা। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, একদা করাচি থেকে কওমি বন্ধন নামে একটি বাংলা দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হতো। করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় এখনো বিএ-এমএ পড়ানো হচ্ছে। অথচ বাংলাভাষীরা রয়েছে দুর্দশায়।

করাচির পাক মুসলিম অ্যালায়েন্স নামের একটি রাজনৈতিক সংগঠনের দাবি, পাকিস্তানজুড়ে প্রায় ২০ লাখ বাংলাভাষী আছে। বাংলাভাষীদের শতাধিক দারিদ্র্যপীড়িত কলোনি আছে করাচিতে। দেশটির আরও কয়েকটি শহরেও তারা আছে।

মিয়ানমারের অনেক রোহিঙ্গা নাগরিকও করাচিতে আশ্রয় নিয়ে আছে। ভাষা ও সংস্কৃতিগত মিল থাকায় অনেকে তাদেরও ‘বাঙালি’ বলে ভুল করে।

পাকিস্তানে নাগরিকত্ব সংকটে ভোগা আরেক জনগোষ্ঠী আফগানরা। বৈধ-অবৈধ মিলে তাদের সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। তাদের অনেকের জন্ম পাকিস্তানেই এবং সামান্যই তারা আফগানিস্তানে ফিরতে চায়।

ইমরানের ঘোষণা বাঙালি ও আফগান উভয় সম্প্রদায়কে আশাবাদী করেছিল। কিন্তু তারপর থেকে ক্রমে ইমরান রাজনীতিবিদ হতে শুরু করেছেন।

করাচিসহ পাকিস্তানে বসবাসকারী বাংলাভাষীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ১৯৪৭–পরবর্তী আজকের বাংলাদেশ থেকে কাজের সন্ধানে যাওয়া মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেকে চলে এসেছিল। কেউ কেউ ইতিমধ্যে গড়ে তোলা পেশা হারাতে চায়নি বলে রয়ে গেছে। এ রকম অনেকে পরে নিকটাত্মীয়দের সেখানে নিয়ে গেছে। এরূপ বাংলাভাষীরা অধিকাংশ দরিদ্র কর্মজীবী। পাকিস্তানের অর্থনীতির চলতি মন্দায় এদের অনেকে ভালো নেই। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন সীমান্তে কড়া নজরদারি এখন। আগের মতো অবৈধভাবে আসা-যাওয়া করা যায় না।

পেশাগতভাবে করাচির বাংলাভাষীরা মূলত স্থানীয় মত্স্য খাতে যুক্ত। পাকিস্তানের ২৫ বিলিয়ন ডলারের মাছ রপ্তানি খাতের মূল শক্তি তারা। অনেকে সমুদ্রগামী ট্রলারগুলোতে কাজ করে। করাচির অর্থনৈতিক জীবনে সস্তা শ্রমের স্থায়ী উৎস এসব মানুষ। নাগরিকত্বের সনদ না থাকায় কাজদাতাদের পক্ষে এদের ঠকানো সহজ হয়। পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট না থাকলে মানুষের যেসব সমস্যা হয়, করাচির বাংলাভাষীদের রয়েছে তার সব কটিই। জন্মনিবন্ধন সনদের (‘বি-ফরম’ নামে পরিচিত) অভাবে শিক্ষাজীবন বিঘ্নিত অনেকের। কম্পিউটারাইজড ন্যাশনাল আইডি কার্ড (সিএনআইসি) না থাকলে চাকরিও মেলে না।

করাচির এখনকার বাংলাভাষীদের সংখ্যাগরিষ্ঠের সেখানেই জন্ম। বাঙালি পিতা-মাতার সন্তান তারা। দেশটির ১৯৫১ সালের নাগরিকত্ব আইনও এরূপ মানুষের স্বীকৃতি অনুমোদন করে। কিন্তু জন্মসনদ বা পরিচয়পত্র চাইলে বাংলাভাষীদের ক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী সব হচ্ছে না। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে যারা সেখানে গিয়েছে, তারা কেউ কেউ নিজ ভূমিতে ফিরতে ইচ্ছুক। কিন্তু যারা বাংলাদেশে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির আগে গিয়েছে, তারা নিজেদের বাংলাদেশি দাবি করতে পারছে না।

আবার দুই দেশের কূটনীতিক সম্পর্ক বর্তমানে খুব শীতল অবস্থায় আছে। এটাও এরূপ বাংলাভাষীদের সঙ্গে নিকটাত্মীয়দের যোগাযোগ দুরূহ করেছে। দীর্ঘ পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা বহুজনের মানসিক বিড়ম্বনার কারণ হয়ে আছে।

বাংলাদেশে ক্যাম্পের বাসিন্দা উর্দুভাষীদের সরকার পরিচয়পত্র দিয়ে যে অসাধারণ নজির স্থাপন করেছে, তার কারণেও করাচির বাংলাভাষী তরুণ প্রজন্ম তাদের নাগরিকত্বের দাবিকে আগের চেয়ে অধিক যুক্তিযুক্ত মনে করছে এখন। কিন্তু মানবিক সহানুভূতি পেলেও রাজনৈতিক দলগুলোর লাভ-ক্ষতির হিসাবে আটকে আছে সমস্যার ফয়সালা।

পাকিস্তানের জনশুমারি দলিলে নয়টি মাতৃভাষার উল্লেখ আছে। এই তালিকায় বাংলা নেই। এ নিয়ে দুঃখবোধ আছে বাংলাভাষীদের। ইমরানের দল পিটিআইয়ের এসব অজানা নয়। দেশটির প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভির জন্ম করাচিতে এবং দীর্ঘ সময় তিনি পিটিআইয়ের সিন্ধু শাখার প্রধান ছিলেন। তাঁর প্রভাবেই হয়তো ইমরান করাচিতে বাংলাভাষীদের জীবন-জীবিকা সহজ করতে পরিচয়পত্রের আশ্বাস দিয়েছিলেন। একই সপ্তাহে তিনি পার্লামেন্টেও এই সমস্যার সমাধানে আগ্রহের কথা জানান। করাচিতে তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘ইসলামাবাদ গিয়ে আমার প্রথম কাজ হবে এই সমস্যার সমাধান করা। এদের পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট দেওয়া।’ কিন্তু বহু মাস পরও তিনি আর এ বিষয়ে মনোযোগী নন। এর বড় কারণ, রাজনীতিতে মিত্রদের হারানোর ভয়। এখন বলা হচ্ছে, সব রাজনৈতিক দলকে ‘আস্থায় নিয়ে’ তিনি নাগরিকত্ব সমস্যার সমাধান খুঁজতে ইচ্ছুক। কিন্তু ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশে সব রাজনৈতিক দল কম ক্ষেত্রেই কোনো বিষয়ে একমত হতে পারে।

অন্তত দুটি বিপরীত আদর্শের রাজনৈতিক দল আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টি (এএনপি) ও জামায়াতে ইসলামি থেকে ইমরানের ঘোষণার পক্ষে জোরালো সমর্থন এসেছিল। এএনপির প্রেসিডেন্ট এসফানদার ওয়ালি খান যদিও পিটিআইবিরোধী, কিন্তু ইমরানের ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে বলেছিলেন, শিশুরা যেখানে জন্ম নেবে, সে দেশের নাগরিকত্ব পাবে, এটা মানবিক বিষয়। কিন্তু সিন্ধুর প্রভাবশালী দল এমকিউএম এবং বেলুচিস্তানের ন্যাশনালিস্ট পার্টি (মেঙ্গাল) ইমরানের আগ্রহের বিরুদ্ধে। পেশোয়ার ও করাচি উভয় শহরে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর একাংশও চায় না বাঙালি ও আফগানরা নাগরিকত্ব পাক। ইমরানের পক্ষে করাচির বিরোধিতা অগ্রাহ্য করা সম্ভব হলেও খাইবার পাখতুন অঞ্চলের প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করা কঠিন। ওটা তাঁর বড় ভোটব্যাংক এলাকা।

বিরোধীদের মধ্যে এমকিউএম, জিডিএ (গ্র্যান্ড ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স) ও মেঙ্গালের বেলুচ ন্যাশনাল পার্টি ইমরানকে গত বছর প্রধানমন্ত্রী হতে সমর্থন দিয়েছিল। জাতীয় পরিষদে জিডিএর রয়েছে তিনটি আসন, এমকিউএমের সাতটি আসন এবং মেঙ্গালের দলের তিনটি আসন। ইমরান বাংলাভাষী ইস্যুতে এদের বিরাগভাজন হতে চাইছেন না।

করাচির রাজনীতিতে ইমরানের প্রধান প্রতিপক্ষ পাকিস্তান পিপলস পার্টিও (পিপিপি) বাংলাভাষীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিপক্ষে। সিন্ধিদের ধারণা, অন্য ভাষার মানুষ করাচিতে বৈধ হতে থাকলে তারা সংখ্যালঘু হয়ে যাবে। ইমরানের প্রথম ঘোষণার পরপরই পিপিপির সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রাব্বানি একে ‘দায়িত্বহীন’ উদ্যোগ বলে অভিহিত করেন। স্পষ্ট যে এত রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ইমরান একা হয়ে যেতে চান না। অথচ এক ‘নয়া পাকিস্তান’-এর স্বপ্ন দেখিয়ে তিনি এরূপ দলকে মোকাবিলা করেই প্রত্যাশার নক্ষত্র হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু এখন তিনি হতে চাইছেন ‘রাজনীতিবিদ’। তাঁকে ‘টিকে থাকা’র কথা ভাবতে হচ্ছে। নিজের ঘোষণা বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ নিতে পারছেন না তিনি।

গোলাকার বিশ্বে বৈধ-অবৈধ অভিবাসন এক বাস্তবতা। পাকিস্তানও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রায় ৮০ লাখ পাকিস্তানি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাস করছে। তাদের দেশেও আছে এর অন্তত অর্ধেক পরিমাণ বিদেশি। আফগান অভিবাসীদের পাসপোর্ট প্রদানে বড় ধরনের নিরাপত্তা উদ্বেগ যুক্ত থাকলেও বাংলাভাষীদের ক্ষেত্রে সে রকম সমস্যা নেই। করাচিসহ পাকিস্তানের সব শহরে বাংলাভাষীদের শান্তিপ্রিয় নিরীহ জনগোষ্ঠী মনে করা হয়। ইমরানের ঘোষণা তাদের মধ্যে কয়েক দশকের দমবন্ধ অবস্থা থেকে মুক্তির আশা তৈরি করেছিল। পিটিআই সরকার কেবল রাজনৈতিক সমীকরণের কারণে তাদের ঘোষণা থেকে সরে আসবে, এটা প্রত্যাশিত নয়। তা ছাড়া, ইমরান সরকার এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে শিগগির আর কোনো দল বাঙালিদের নাগরিকত্ব দেওয়ার ঝুঁকি নেবে বলে মনে হয় না।

আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক