মোদি 'হ্যাঁ', মোদি 'না', সাসপেন্স তুঙ্গে

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ফাইল ছবি
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ফাইল ছবি

এমন টান টান ও অনিশ্চয়তার ভোট ভারতে আগে হয়নি। ভোটের সম্ভাব্য ফল নিয়ে এমন সাসপেন্সও কখনো দেখিনি। সারা দেশে একটিমাত্র মুখকে কেন্দ্র করে ভোট হচ্ছে। এক পক্ষ সেই মুখ আঁকড়ে দ্বিতীয়বার সরকার গড়তে চাইছে, অন্য পক্ষ চাইছে মুখটিকে ঠেকাতে। ফলে এই প্রথম ভারতের লোকসভার ভোট গণভোটের রূপ নিয়েছে। সেই গণভোটে নরেন্দ্র মোদি পাস করবেন না ফেল, যাবতীয় আগ্রহ তা নিয়েই। গণভোটের রায় বের হতে বাকি মাত্র দুটো সপ্তাহ। ফলে অন্তহীন সাসপেন্সের সময় এখন।

রাজনৈতিক দলকে ছাপিয়ে ভারতের কোনো নেতার বড় হয়ে ওঠা এই প্রথম দৃশ্যমান। ততোধিক বিস্ময়ের, এই প্রথম শাসক দলের প্রার্থীরা নিজেকে আড়ালে রেখে ভোট চাইছেন নেতার নামে! গুজরাট ও উত্তর প্রদেশের জেলায় জেলায় দেখেছি, বিজেপি গৌণ! মোদিই মুখ্য! কেউ বলছে না, বিজেপিকে ভোট দিন। প্রচারের কায়দাটাও অভিনব। ‘ফির একবার, মোদি সরকার’। বিজেপির সরকার নয়। বিরোধীদের মধ্যেও বিজেপিকে হারানোর ডাক নেই। রয়েছে মোদিকে রোখার হাঁক। সত্যিই অভিনব এবারের ভোট।

একটি বিষয়ে সবাই একমত, গতবারের চেয়ে বিজেপির আসন কমছে। ধারণার কারণ, আগেরবারের মতো এবার কোথাও দৃশ্যত মোদি-হাওয়া নেই। বরং সমালোচনা আছে। এই ধারণার পাশাপাশি গুজরাট ও উত্তর প্রদেশ চষে দেখেছি, শহরে তো বটেই, গ্রামাঞ্চলেও মোদির নামে একটা চোরা টান রয়েছে। হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখন্ড, দিল্লি, গুজরাট, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় ও উত্তর প্রদেশে গতবার বিজেপি প্রতিপক্ষকে তুলাধোনা করেছে। ১০৭ আসনের মধ্যে জিতেছিল ১০৪ টি। এবার তা হওয়ার নয়। কারণ, বিরোধীদের জোট। উত্তর প্রদেশ, বিহার, ঝাড়খন্ড, মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটকেও বাঁচার তাগিদে বিরোধীরা জোট বেঁধেছে। ভোটের পাটিগণিতে তার প্রতিফলন হতে বাধ্য। বিজেপি ও জোট শরিকদের পক্ষে স্বস্তির, তাদের নেতৃত্বের সংকট নেই। এই সংকটই আবার বিরোধীদের কাছে অস্বস্তির। তা সত্ত্বেও শাসক মহলের নেতারা নিভৃত আলাপচারিতায় স্বীকার করছেন, গতবারের তুলনায় তাঁদের আসন কিছুটা হলেও কমবে। সেই ঘাটতি পশ্চিমবঙ্গ, ওডিশা ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো মেটাবে। কিন্তু ঘাটতি ও জোগানের ফারাক কত হতে পারে, সেই বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা কারও নেই। যে জন্য ফল ঘিরে এত সাসপেন্স।

দেশের নজর আর্যাবর্তে নিবদ্ধ। কারণ, আর্যাবর্তই ঠিক করে দেবে দিল্লি আরও পাঁচ বছরের জন্য মোদির জিম্মায় থাকবে কি না। বলয়টা আরও ছোট করলে উত্তর প্রদেশ। এই রাজ্যের ফলই নির্ণায়ক হতে চলেছে। গতবার উত্তর প্রদেশে বিজেপি পেয়েছিল ৪২ দশমিক ৬৩ শতাংশ ভোট। মোদি-হাওয়া সত্ত্বেও সমাজবাদী পার্টির ভোট শেয়ার ছিল ২২ দশমিক ২৫ এবং বহুজন সমাজ পার্টির ১৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ। দুইয়ে মিলে ৪২ দশমিক ১২ শতাংশ। ওই রাজ্যে রাষ্ট্রীয় লোকদল পেয়েছিল ২ শতাংশের মতো ভোট। এবার তারা জোট-শরিক। নিছক পাটিগণিত তাই জোটের দিকে ঝুঁকে। এটা যেমন সত্যি, তেমনি এটাও ঠিক যে অ-যাদব অনগ্রসর এবং অ-জাটভ দলিতদের মধ্যে মোদির প্রতি ভরসা এখনো বেশ অটুট। এদের কাছে টেনে গতবার বিজেপি বাজি মাত করেছিল। এবারও তেমন হবে কি? বলা কঠিন। সত্য হলো, একদিকে মোদির আকর্ষণ, অন্যদিকে স্বজাতে থাকার ধর্ম, এই দোলাচলে অ-যাদব অনগ্রসর ও অ-জাটভ দলিতরা পেন্ডুলাম।

মোদি-মোহ না থাকলেও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁকে আরও একটা সুযোগ দেওয়া যেতে পারে, এমন একটা মনোভাব কিন্তু নজরে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদির পাল্টা কে, সেই ভাবনাও মানুষকে ভাবাচ্ছে। এই অবস্থায় মোদি নিরাপত্তাকেই করে তুলেছেন প্রধান ইস্যু। মোদি=দৃঢ় নেতৃত্ব, মোদি সরকার=পাকিস্তানের যম। পুলওয়ামা ও বালাকোট-পরবর্তী পরিস্থিতিতে এটাই এই ভোটের ‘নিউ ন্যারেটিভ’। যদিও পঞ্চম দফার ভোট থেকে কয়েকটা ঘটনা একটু ভিন্ন জল্পনার জন্ম দিচ্ছে।

যেমন অভিনেতা অক্ষয় কুমারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মোদির হঠাৎ মমতা-প্রসঙ্গ তোলা! ভোট শুরু হয়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গে লড়াই ক্ষুরধার। এমন সময় মমতা যে তাঁকে পাঞ্জাবি, চুড়িদার ও মিষ্টি পাঠান, সে কথাটা মোদি ফাঁস করে দিলেন! কেন?

দুটো ব্যাখ্যা। প্রথমটা হলো ভোটারদের কাছে মমতাকে খাটো করা। এটা বোঝানো, ঝগড়াটা ওপর-ওপর। দ্বিতীয়ত এটা বোঝানো, সরকার গড়তে প্রয়োজনে মমতার দ্বারস্থ হতে তিনি প্রস্তুত। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, মমতা সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের ৩০ শতাংশ মুসলমানের মোহ কাটানো। মমতার ক্ষতি মানে বিজেপির লাভ। প্রায় একই সময়ে মায়াবতীকে সতর্ক করে দিয়ে মোদি বলেন, কংগ্রেস ও সমাজবাদী পার্টি হাতে হাত মিলিয়ে তাঁকে পথে বসাতে চাইছে। অথচ দলিত নেত্রী তা বুঝতেই পারছেন না!

উত্তর প্রদেশে শক্তি সঞ্চয়ে কংগ্রেসের প্রথম টার্গেট তফসিলি জাতি ও মুসলমান। মায়াবতী তা জানেন। কংগ্রেসের শক্তি সঞ্চয়ের অর্থ প্রথমেই তাঁর সমর্থনের ভিত আলগা হওয়া। এটাই কায়দা করে বোঝালেন মোদি। কিন্তু কেন? প্রথম ব্যাখ্যা, রাজ্যে বিজেপির প্রাপ্তি অর্ধেক হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অতএব ধস রুখতে অবিশ্বাসের ধুনোয় বাতাস দাও। দ্বিতীয় ব্যাখ্যা, সরকার গড়তে পুরোনো বন্ধু মায়াবতীকে কাছে টানার ইঙ্গিতটুকু দিয়ে রাখা। এটা বোঝানো, আমিই আপনার প্রকৃত সুহৃদ। কংগ্রেস ও সমাজবাদী পার্টি নয়।

তৃতীয় আচরণও গুরুত্বপূর্ণ। যে দলটাকে মোদি দেশছাড়া করতে চেয়েছিলেন, সেই কংগ্রেসকে গালাগালির বহর বাড়িয়ে দিলেন! শিষ্টাচারের ধার না ধেরে প্রয়াত রাজীব গান্ধীকে ‘এক নম্বর ভ্রষ্টাচারী’ বলে গালও পাড়লেন! কেন? এখানেও দুটো ব্যাখ্যা। এক, রাফায়েল প্রসঙ্গ মানুষের মনে সন্দেহ জাগিয়েছে মেনে নেওয়া। দুই, কংগ্রেস তাঁর পাকা ধানে মই দিচ্ছে স্বীকার করা।

চতুর্থ ঘটনাটি এই তিন ধারণারই পরিপূরক। ঘটিয়েছেন বিজেপির সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক রাম মাধব। এক বিদেশি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বললেন, একার ক্ষমতায় বিজেপি ২৭১ আসন পেলেই তিনি খুশি। তখন শরিকদের নিয়ে সরকার গড়া যাবে।

আর দুটো মাত্র পর্ব। বাকি ১১৮টি কেন্দ্রের ভোট। পাঁচ বছর আগের মোদি-ম্যাজিক পাঁচ বছর পরও মায়াজাল ছড়ায় কি না, চক্ষু-কর্ণের সেই বিবাদ ভঞ্জন হবে ২৩ মে। তত দিন পর্যন্ত চলুন, সাসপেন্সে থাকি।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি