বিএনপির 'আত্মহত্যার' কৌশল

নির্বাচন কমিশন ভবন
নির্বাচন কমিশন ভবন

গত চার পর্বের উপজেলা (যে কাঠামো সাংসদদের মুঠোবন্দী) নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি সভাপতি ও সাংসদ রাশেদ খান মেনন হতাশ। কিন্তু জানতে চাইলে বললেন, তাঁরা পঞ্চম পর্বেও অংশ নেবেন। তবে তাঁর কথায়, আগেরগুলোর মতো হলে নির্বাচনের প্রতি মানুষের আর আস্থা থাকবে না।

বছরের ফেব্রুয়ারি–মার্চে অনুষ্ঠেয় ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) নির্বাচনে ‘কৌশলগত’ভাবে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে বিএনপির উচিত বাদবাকি উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়া। পঞ্চম ধাপে ১৮ জুন ১৬টি উপজেলায় নির্বাচন হতে যাচ্ছে। প্রায় ভোটারবিহীন, কালিমালিপ্ত এই উপজেলা নির্বাচনপর্বটির কালিঝুলি বিএনপির বয়কটের কারণে মানুষের মনোযোগের বাইরে থেকেছে। নির্বাচনের প্রতি মানুষকে বীতশ্রদ্ধ নয়, যতটা সম্ভব আগ্রহী রাখা বিরোধী দলের কাজ। ক্ষমতাসীন মহাজোটের মিত্ররা, কিংবা আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা যেখানে ভালো ফাইটার, সেখানে বিএনপি মাঠে থাকলে, সেখানকার ফাইট আরও কৌতূহলোদ্দীপক হওয়ার কথা।

শুধু উপজেলা নয়, সামনে পৌরসভা নির্বাচনও আসছে। সেই নির্বাচনকেও কি এবারের কলঙ্কিত উপজেলা নির্বাচনের মতোই দেখব?

৩০ ডিসেম্বেরের পরে বিএনপি ক্ষমতাসীন দলকে প্রশান্তির সাগরে নিমজ্জিত করেই ঘোষণা করেছিল যে এই সরকারের অধীনে তারা নির্বাচনে যাবে না। এখন তাদের উচিত, ‘কৌশলের অংশ’ হিসেবে প্রতিটি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া। দলকে সর্বোতভাবে নির্বাচনমুখী করা। যদি তারা মধ্যমেয়াদি নির্বাচনের তাত্ত্বিক স্বপ্ন দেখে, তাহলেও মাঠের নেতা–কর্মীদের রাজনীতি বা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় জাগিয়ে রাখতে হবে।

নির্বাচন কমিশনের নেতৃত্বে নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংস হচ্ছে। সেই যজ্ঞে দূরে থেকে নয়, লেগে থেকে প্রতিবাদী থাকা বেশি কার্যকর।

নির্বাচন কমিশন থেকে কয়েক দশক কাজ করে অবসর নেওয়া একজন নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ৯ মে রাতে মুঠোফোনের আলোচনায় আমাকে বলেন, ক্ষমতায় যাওয়ার স্বর্ণদ্বার হলো ঢাকার সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এখানে মেয়রের পদ যে দলের, সরকার গঠনের চাবিও থাকে সেই দলের হাতে। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পরপরই সরকার কেন ঢাকা উত্তরের মেয়র নির্বাচনটি সেরে নিল, সেটা বিএনপির হিসাবে থাকার কথা ছিল। কিন্তু তারা বয়কট করেছে। সরকার মুচকি হেসেছে। কারণ তারা জানত, এই ফাঁদে বিএনপি পা দেবেই। ৩০ ডিসেম্বেরের মতো কোনো গ্লানি তাদের নিতে হয়নি। বরং বিএনপি নির্বাচন বয়কট করেছে বলে ঢাকা উত্তরের মেয়র কীভাবে নির্বাচিত হলেন, তা মানুষ ও সংবাদমাধ্যমের রাডারের বাইরেই থাকল। বিএনপি হয়তো আবেগে ভেসে আত্মঘাতী আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলেছে। তারা স্বীকার করতে নারাজ যে এই মেয়র নির্বাচন বয়কট করে তারা ভুল করেছে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এটা প্রমাণিত যে নির্বাচন বয়কটের যেকোনো সিদ্ধান্ত আবেগনির্ভর, কৌশল হিসেবে এটা অকার্যকর কিংবা কম কার্যকর।

রাজপথের আন্দোলন ও হরতালনির্ভর বাংলাদেশের চিরচেনা রাজনীতি আপাতত হারিয়ে গেছে। এই অবস্থায় নির্বাচন হলো মানুষের প্রতিবাদ ও বিতর্ক করার অবশিষ্ট ফোরাম।

স্থানীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনগুলো নানাভাবে আমাদের গ্রামীণ সমাজকে বাঁচিয়ে রাখছে। অবক্ষয়, নীতিনৈতিকতা সমাজে যথেষ্ট খর্ব হলেও এখনো তৃণমূলের মানুষের দৈনন্দিন জীবনের নানা প্রয়োজন মেটাতে ‘মেম্বর বা চেয়ারম্যানসাবরা’ কার্যকর ভূমিকা রাখছেন। এমনকি যাঁরা ‘সাবেক’ হয়ে যান, তাঁরাও গ্রামীণ সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সুতরাং বিষয়টি এমন নয় যে বড় দলগুলো তাদের কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ভোট বর্জনের সিদ্ধান্ত নিলেই তৃণমূলের নেতা–কর্মীরা সেটা সহজে হজম করে নেওয়ার জায়গায় থাকেন। তাঁদেরকে একটি সমাজ নিয়ে ওঠাবসা করতে হয়, নির্বাচনে অংশগ্রহণ তাঁদেরকে একতাবদ্ধ এবং সক্রিয় রাখে। বর্জন তাঁদেরকে হতোদ্যম এবং বিচ্ছিন্ন হওয়ার বোধ তৈরি করে দেয়। কারচুপি করে জয়ী হওয়া ব্যক্তির লজ্জিত বা আড়ষ্ট থাকাটা তখনই সম্ভব, যদি নির্বাচনটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়। বিরোধীদলীয় প্রার্থী শক্তিশালী থাকলে কারচুপিটা আর ‘সূক্ষ্ম’ থাকে না, পুকুরচুরিতে রূপ নেয়।

গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের ফলাফলে হতভম্ব বিএনপি ২০১৯ সালের উপজেলা নির্বাচন বয়কটকালে ভাবতেই পারেনি যে খোদ সংসদ নির্বাচনে যোগদান প্রশ্নেই তাদেরকে অবমাননাকর ডিগবাজি খেতে হবে। তারা সংসদে যাবে, সংরক্ষিত নারী আসনের জন্য নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিলে অংশ নেবে, কিন্তু উপজেলা নির্বাচনে তৃণমূলের নেতাদের অংশ নেওয়া থেকে বঞ্চিত রাখবে, সেটা বৈষম্যমূলক এবং অর্থহীন।

বিএনপির নির্বাচন বয়কটকারী অভ্যন্তরীণ শক্তি ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচন বয়কটের ভুল এখনো স্বীকার করেনি, তারা বরং বিপুল উৎসাহে দাবি করছে যে তারাই অভ্রান্ত ছিল।

এমনকি যাঁরা নির্বাচনে যেতে ভূমিকা রেখেছেন, তাঁদের প্রতি সন্দেহের তির ছুড়ছে। অথচ বাস্তবতা এটাই যে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে অংশগ্রহণ তাদেরকে একটি নৈতিক বিজয় এনে দিয়েছে বলে তারা সান্ত্বনা পেতে পারে। সব থেকে বড় কথা, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন যে ‘আগের রাতে সিল’ মারার মতো অভিযোগকে বিশ্বাসযোগ্যতা দিতে পারে, সেটা দেশ–বিদেশের মানুষকে বিশ্বাস করানো কঠিন হতো।

কিন্তু হতাশায় নিজেদের ডুবিয়ে দিয়ে কেন্দ্রীয় নেতারা উপজেলার নেতা–কর্মীদের পাশে দাঁড়ানোর ঝুঁকি নেওয়া থেকে বিরত থাকলেন। উপজেলা নির্বাচনে গেলে ঢাকায় সভা–সমাবেশ করতে না পারা কেন্দ্রীয় নেতারা গ্রামে–গঞ্জে যেতে পারতেন। সংসদ নির্বাচনে জয়ী হতে না পারা বিএনপির স্থায়ী কমিটির অধিকতর ক্ষুব্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা শুধু দলের স্বার্থে গ্রীষ্মের এই দাবদাহে মাঠে–ময়দানে ছুটে বেড়াবেন, এই দৃশ্য অভাবনীয়।

২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচন বয়কটের ঐতিহাসিক ভুলটি করার পরপরই উপজেলা নির্বাচন হয়েছিল। তখন তারা কিন্তু ‘খালি মাঠে গোল করতে দেওয়া যাবে না’ বলে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। ৪৬০ উপজেলায় ছয় ধাপের নির্বাচনে ১০০টির বেশি উপজেলায় বিএনপি এবং ৩০টির বেশি উপজেলায় জামায়াতের প্রার্থীরা জয়ী হয়েছিলেন।

এবারে বিএনপি প্রতীক ছাড়াই উপজেলা নির্বাচনে যেতে পারত। চতুর্থ পর্বের উপজেলা নির্বাচনের পরে ইসি মাহবুব তালুকদার উপজেলাকে ‘রিমোট কন্ট্রোলের’ নির্বাচন বলেছিলেন। তবে এখন যদি ‘কৌশলের অংশ’ হিসেবে বিএনপি প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে যায়, তাহলে তা রিমোট কন্ট্রোল থাকবে না। বগুড়া ৬ ও ৭ জিয়া পরিবারের সংরক্ষিত আসন। বগুড়া–৭ আসনে ট্রাক প্রতীক নিয়ে দাঁড়ানো এক ভুঁইফোড় ব্যক্তি শুধু শেষ মুহূর্তে বিএনপির সমর্থনে জিতে এখন সংসদে। মির্জা ফখরুলের ছেড়ে দেওয়া বগুড়া–৬ আসনে বিএনপি–সমর্থিত ‘কলাগাছকেও’ হারানো সহজ হবে না।

এই আসনের আসন্ন উপনির্বাচন বয়কটের প্রতীকী অর্থ দাঁড়াবে বগুড়াবাসীকে বলা, এটা আর জিয়া পরিবারের সংরক্ষিত আসন নয়। অবশ্য বিএনপির যা অবস্থা, তাতে তারা আত্মহত্যার সিদ্ধান্তকেও ‘কৌশলের অংশ’ বলতে পারে।