চিরকালের শরণার্থী?

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লেবাননে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের দুর্দশা বেড়েছে
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লেবাননে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের দুর্দশা বেড়েছে

ইসরায়েল আবারও ফিলিস্তিনে তাদের দখল অভিযান শুরু করেছে। ১৯৪৮ ও ১৯৬৭ সালের দুটি বড় ধরনের উচ্ছেদ অভিযানে ফিলিস্তিনিদের তাদের ভূমি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল, তাদের বড় একটি অংশ প্রতিবেশী দেশগুলোতে শরণার্থী হিসেবে বসবাস করছে। এসব শরণার্থীর নিজ পূর্বপুরুষের ভূমিতে ফিরে যাওয়ার স্বপ্নটি ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে। কেননা, ইসরায়েল অন্যায়ভাবে তার অত্যাচারী শাসনকে বিস্তৃত করে যুদ্ধের মাধ্যমে আরও জমি দখল করছে এবং তারপর সেখানে অবৈধ বসতি স্থাপন করছে। এগুলো এখন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে।

ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করা জাতিসংঘের ত্রাণবিষয়ক সংস্থা ইউনাইটেড ন্যাশনস রিলিফস অ্যান্ড ওয়ার্কস এজেন্সিতে (ইউএনআরডব্লিউএ) নিবন্ধিত ফিলিস্তিনি শরণার্থীর সংখ্যা ৫৩ লাখ। এর মধ্যে জর্ডানে রয়েছে ২০ লাখ শরণার্থী এবং গাজা উপত্যকা থেকে যারা এসেছে, তাদের ছাড়া জর্ডান ফিলিস্তিনি নাগরিকদের পাসপোর্ট এবং নাগরিক অধিকার দিয়ে ফিলিস্তিনবান্ধব নীতি পরিচালনা করছে। সিরিয়ায় রয়েছে ৫ লাখ ২৬ হাজার ফিলিস্তিনি, যারা নাগরিকত্ব না পেলেও স্থানীয় জনগণের মতো সব অধিকার ভোগ করতে পারছে। ইউএনআরডব্লিউএ গাজা ও পশ্চিম তীরেও শরণার্থী শিবির পরিচালনা করছে। মিসর ও ইরাকেও হাজার হাজার ফিলিস্তিনি শরণার্থী রয়েছে।

লেবানন স্থানীয় জনসংখ্যার অনুপাতে আরও শরণার্থী গ্রহণ করেছে। সেখানে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। ১৯৪৮ সালের পর থেকে নাগরিকত্ব না থাকায় শরণার্থী শিবিরগুলোতে তারা অবহেলিত ও মানবেতর জীবন যাপন করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি বিরাজ করছে সাবরা ও শাতিলা শরণার্থী শিবিরে। ১৯৮০ দশকে লেবাননের গৃহযুদ্ধের সময় রাজধানী বৈরুতে এই শরণার্থী শিবিরে ঢুকে খ্রিষ্টান ফালাঞ্জে মিলিশিয়ারা হত্যা করেছিল শত শত ফিলিস্তিনিকে। সে গণহত্যায় ইসরায়েলের পরোক্ষ সমর্থন ছিল।

উদ্বাস্তুদের প্রথম প্রজন্মের সংখ্যা ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে। দ্বিতীয় প্রজন্ম নিজেদের শরণার্থী শিবিরের সীমাবদ্ধ জীবনে আবিষ্কার করছে; যে জীবনের কোনো সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ নেই। লেবাননে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের অন্য বিদেশিদের মতো একই অধিকার নেই। লেবাননে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের ২০টির বেশি পেশা গ্রহণের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে এবং তারা সম্পত্তি কিনতে পারে না। এমনকি তারা শিবিরের ভৌত কাঠামোতেও কোনো পরিবর্তন আনতে পারে না। আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব বৈরুতের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের মাত্র ৩৬ শতাংশ কাজ করে এবং ফিলিস্তিনি যুবকদের মাত্র ৬ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশিক্ষণ কর্মসূচিগুলোতে অংশগ্রহণ করে।

লেবাননে ইউএনআরডব্লিউএতে নিবন্ধিত ফিলিস্তিনি শরণার্থীর মোট সংখ্যা ৫ লাখ। কিন্তু বিভিন্ন হিসাব অনুযায়ী, প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা আরও কম, ২ লাখ থেকে ৩ লাখের মধ্যে। ধারণা করা হয়, তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার ফিলিস্তিনি শরণার্থীর কোনো শনাক্তকরণ কাগজপত্র নেই। এরা স্থানীয় এনজিওগুলোর ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের কারণে প্রায় ৩০ হাজার ফিলিস্তিনি শরণার্থী সেখান থেকে পালিয়ে গেছে।

লেবানন-ফিলিস্তিন সংলাপ কমিটি লেবাননের শরণার্থী শিবির থেকে ফিলিস্তিনিদের অন্য দেশে অভিবাসনের প্রবণতা বৃদ্ধির বিষয়টিকে চিহ্নিত করেছে। ফিলিস্তিনিরা শরণার্থী শিবিরে তাদের জীবনযাত্রার নিম্ন মানের কারণে এত হতাশ হয়ে পড়েছে যে তারা ইথিওপিয়ায় চলে যাওয়ার জন্য বেপরোয়া হয়ে পড়েছে। এমনকি ব্রাজিল, বলিভিয়া ও উরুগুয়ের মতো দূরবর্তী দেশগুলোতেও তারা চলে যাচ্ছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের দুর্দশা আরও বেড়েছে। গত বছর ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য সব ধরনের মানবিক সাহায্য–সহযোগিতা পুরোপুরি বন্ধ ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। ইউএনআরডব্লিউএকে তহবিল দেওয়া বন্ধ করে দেয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন। তখন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, ফিলিস্তিনিরা যতক্ষণ পর্যন্ত না ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তিতে সম্মত হবে, তার দেশ ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো সহযোগিতা দেবে না ফিলিস্তিনকে। এরপর ফিলিস্তিনি শরণার্থীরা আরও দুর্ভোগের মধ্যে পড়ে। ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের অপেক্ষাকৃত ভালো জীবনের সন্ধানে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার পেছনে এটা একটা কারণ হতে পারে।

জাতিসংঘের প্রস্তাবে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের অধিকারকে সমর্থন করা হয়েছে। আরব-ইসরায়েলি বৈঠকেও বিষয়টি নিয়ে আন্তরিক আলোচনা হয়েছে। শরণার্থী শিবিরগুলো থেকে যত বেশি ফিলিস্তিনি পশ্চিমের দেশগুলোতে পালিয়ে যাবে, ততই তাদের নিজ ভূমিতে ফেরার সম্ভাবনা কমবে। কেননা, ইউরোপ ও আমেরিকায় বসবাসকারী ফিলিস্তিনিরা নিজ ভূমিতে ফিরে যাওয়ার অধিকারের ব্যাপারে খুব একটা তাগিদ দেবে, এমন সম্ভাবনা কম। তবে সবাই যে পালিয়ে যেতে পারছে, তা নয়। তারা প্রতিবেশী দেশগুলোর শরণার্থী শিবিরগুলোতে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তারা মানবেতর জীবন যাপন করছে। এ পরিস্থিতির অবসান কবে হবে, কে বলতে পারে?

পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক ডন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

আরিফ আজাদ: পাকিস্তানের লেখক
[email protected]