ঝুঁকিতে উপকূলের বেড়িবাঁধ

একটি চেয়ার যত দামিই হোক, চারটি পায়ার যেকোনো একটি থেকে যদি ইঞ্চিখানেক ভেঙে যায়, তাহলে চেয়ারটিতে আর বসা যাবে না। পায়ার যে অংশটুকু ভেঙে পড়ল, সেটুকুর আয়তন চেয়ারটির সামগ্রিক কাঠামোর তুলনায় হয়তো খুবই কম, তবু পায়ার ওই অংশটুকুর গুরুত্ব এতটাই যে, সেটুকু মেরামত না করা পর্যন্ত চেয়ারটি বাতিলের খাতায় পড়ে থাকবে।

এই দিক থেকে চেয়ারের সঙ্গে বেড়িবাঁধের মিল আছে। যথেষ্ট উঁচু, মজবুত ও টেকসই—এমন পাঁচ কিলোমিটারের একটি বেড়িবাঁধের মাত্র মিটার দশেক জায়গা যদি নাজুক থাকে এবং সেখান দিয়ে যদি বন্যার পানি ঢুকতে শুরু করে, তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। অর্থাৎ পাঁচ কিলোমিটারজুড়ে থাকা প্রতিরোধ সক্ষমতাকে নষ্ট করে দেওয়ার জন্য ভাঙাচোরা ১০ মিটার জায়গাই যথেষ্ট। ফলে বেড়িবাঁধের সুফল পেতে গেলে এর পুরোটাকেই অক্ষত রাখতে হবে। কোথাও কোনো ‘ক্ষত’ থাকা চলবে না।

ভয়ানক আতঙ্কের কথা হলো, দেশের উপকূলীয় এলাকার ৮ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডর ও ২০০৯ সালে আইলার পর উপকূল এলাকার এসব বাঁধের অনেক জায়গা ভেঙে গিয়েছিল, অনেক জায়গা বানের তোড়ে ভেসে গিয়েছিল; কিন্তু তার বড় অংশ এখনো যথাযথভাবে মেরামত হয়নি। তার মানে গোটা উপকূলীয় এলাকা এখন অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে।

বেড়িবাঁধ দিয়ে জলোচ্ছ্বাস ও বন্যা ঠেকিয়ে রাখা এলাকাগুলো যে কী মাত্রায় অরক্ষিত অবস্থায় আছে, তা কয়েক দিন আগে ঘূর্ণিঝড় ফণী আঘাত হানার পর বোঝা গেছে। ওই সময় দেশের অন্তত ১০টি স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি বসতি এলাকায় ঢুকেছে। এতে ফসলের ক্ষতি হয়েছে বেশি। বহু পুকুর ভেসে মাছের খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

সরকারের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২০১৭ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় মোরায় প্রায় ২২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর বাইরে ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, কোমেনের আঘাতে ১৯ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধের বড় অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেগুলো মেরামত এখনো শেষ হয়নি।

সরকারের হিসাবে দেশে ১৯ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর প্রায় অর্ধেকই উপকূলীয় এলাকায়। উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হলে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হয়। লবণাক্ত পানি ফসলি জমিতে চলে আসার পর টানা কয়েক বছর ফসল হয় না। মিঠাপানির মাছ ও অন্যান্য প্রকৃতিবান্ধব কীটপতঙ্গের বংশবিস্তার বাধাগ্রস্ত হয়। এ কারণে উপকূলের বেড়িবাঁধ সুরক্ষিত রাখায় অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার।

উদ্বেগের বিষয় হলো, বেড়িবাঁধের রক্ষণাবেক্ষণে বরাদ্দ সব সময়ই অপ্রতুল। পানি উন্নয়ন বোর্ড তাদের অধীনে থাকা বেড়িবাঁধের ওপর স্থানীয় বাসিন্দাদের ঘেঁষতে দেয় না। কিন্তু অনেক জায়গাতেই দেখা গেছে, বাঁধে সামাজিক বনায়ন করা হলে কিংবা এলাকাবাসী ঘরবাড়ি তুললে বাঁধ অনেক বেশি সুরক্ষিত থাকে। নিজেদের স্বার্থেই এলাকাবাসী বেড়িবাঁধকে সুরক্ষিত রাখতে উদ্যোগী হয়। এ কারণে বাঁধগুলোর সুরক্ষার সঙ্গে স্থানীয় মানুষের ব্যক্তিস্বার্থের মধ্যে সম্পর্ক বাড়ানো যেতে পারে।

আমাদের দেশে দুর্যোগের আগে নানা রকমের প্রস্তুতি নেওয়া এবং দুর্যোগের পরপর সব ভুলে যাওয়ার সংস্কৃতি চালু আছে। এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। এ ছাড়া সরকারি বরাদ্দের অর্থ নয়ছয়ের চেষ্টাও দেখা যায়। জোয়ারের পানি ঠেকানোর রিংবাঁধ নির্মাণ, বাঁধ মেরামত, সংস্কার প্রভৃতি নামে প্রতিবছর নেওয়া হয় বিভিন্ন প্রকল্প। এসব প্রকল্পে অর্থ নয়ছয়ের ঘটনাও ঘটে। বর্ষা এলে বাঁধ ভেঙে যায়। নতুন প্রকল্পের নামে শুরু হয় নতুন বরাদ্দ। এভাবে বছরের পর বছর উপকূলীয় বাঁধের সংস্কারের নামে চলে অর্থের অপচয়। এই মনোভঙ্গিরও অবসান জরুরি।