জাকাতের উদ্দেশ্য দারিদ্র্য বিমোচন

জাকাত মানে পবিত্রতা ও প্রবৃদ্ধি। জাকাত প্রদানের মাধ্যমে সম্পদ পবিত্র হয়, আত্মা পরিশুদ্ধ হয় এবং সম্পদে বরকত হয় ও মনে প্রাচুর্যের অনুভূতি আসে, তাই এই নামকরণ। জাকাত একটি নির্ধারিত ফরজ ইবাদত। জাকাত ইসলামের পাঁচটি মূল ভিত্তির অন্যতম ভিত্তি। আল–কোরআনে নামাজের নির্দেশ যেমন ৮২ বার রয়েছে, অনুরূপ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জাকাতের নির্দেশনাও রয়েছে ৮২ বার। ‘জাকাত’ শব্দ দ্বারা ৩০ বার, ‘ইনফাক’ শব্দ দ্বারা ৪৩ বার এবং ‘সদকা’ শব্দ দ্বারা ৯ বার।

কোরআন মজিদে আল্লাহ তাআলা বলেন: মুত্তাকিরা জান্নাতে ফোয়ারার নিকটে থাকবে। তারা গ্রহণ করবে, যা তাদের পালনকর্তা তাদেরকে দেবেন। নিশ্চয় ইতিপূর্বে তারা ছিল সত্কর্মপরায়ণ, তারা রাত্রির সামান্য অংশেই নিদ্রা যেত, রাতের শেষ প্রহরে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করত এবং তাদের ধনসম্পদে ছিল প্রার্থী ও বঞ্চিতের হক বা ন্যায্য অধিকার। (সুরা-৫১ জারিয়াত, আয়াত: ১৫-১৯)। আল্লাহ তাআলা আরও বলেন: তবে তারা স্বতন্ত্র, যারা নামাজ আদায়কারী। যারা তাদের নামাজে সার্বক্ষণিক কায়েম থাকে এবং যাদের ধনসম্পদে নির্ধারিত হক আছে এবং যারা প্রতিফল দিবসকে সত্য বলে বিশ্বাস করে আর যারা তাদের পালনকর্তার শাস্তি সম্পর্কে ভীত-কম্পিত। (সুরা-৭০ মাআরিজ, আয়াত: ২২-২৭)।

জাকাতের উদ্দেশ্য দারিদ্র্য বিমোচন ও সম্পদের প্রবাহ তৈরি। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ফরমান করেছেন: যাতে তোমাদের বিত্তবানদের মধ্যেই শুধু সম্পদ আবর্তন না করে। (সুরা-৫৯ হাশর, আয়াত: ৭)। সুতরাং এভাবে জাকাত প্রদান করা উচিত, যাতে আজকের জাকাতগ্রহীতা আগামীর জাকাতদাতায় পরিণত হতে পারে। পরিকল্পিতভাবে জাকাত প্রদান করলেই সমাজ, দেশ, জাতি ও রাষ্ট্র এবং বিশ্ব দারিদ্র্যমুক্ত হবে।

জাকাত ও সদকা প্রদানের উপকারিতা প্রসঙ্গে হাদিস শরিফে এসেছে: দাতা আল্লাহর কাছে প্রিয়, মানুষের কাছে প্রিয়, জান্নাতের নিকটতম; জাহান্নাম থেকে দূরে। সাধারণ দাতা অধিক ইবাদতকারী কৃপণ অপেক্ষা আল্লাহর নিকট বেশি প্রিয়। (তিরমিজি শরিফ)। এ ছাড়া জাকাতের সামাজিক অনেক সুফল রয়েছে। যেমন: (ক) অর্থের প্রবাহ বা অর্থের সঞ্চালন: জাকাত প্রদান করলে নগদ অর্থ হাতবদল হয়। এতে সম্পদে গতিশীলতা আসে। যাতে প্রচুর লোক ক্রয়ক্ষমতা অর্জন করে, তাতে চাহিদা বা ভোক্তা সৃষ্টি হয়। ক্রেতা সৃষ্টি হলে উৎপাদন বৃদ্ধি হয়, শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা হয়, কর্মসংস্থান হয়। যার ফলে জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হয়। (খ) দারিদ্র্য বিমোচন: সঠিকভাবে জাকাত প্রদান করলে সমাজের দারিদ্র্য দূরীভূত হয়, অপরাধপ্রবণতা কমে এবং আর্থসামাজিক বিপর্যয় থেকে জাতি রক্ষা পায়। সর্বোপরি সুদের অভিশাপ থেকে মুসলমানগণ রক্ষা পায়। (গ) মানবিক উন্নয়ন: জাকাত আদায়ের মাধ্যমে ধনী-গরিবের বিভেদ দূর হয়, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা ও সম্প্রীতি তৈরি হয়, এতে দাতা-গ্রহীতা উভয়ের আর্থসামাজিক নিরাপত্তা জোরদার হয়।

পবিত্র কোরআনে জাকাত ও সদকাতুল ফিতর ব্যয়ের আটটি খাত উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন: নিশ্চয়ই জাকাত হলো কেবল ফকির, মিসকিন, জাকাত আদায়ে নিযুক্ত কর্মচারী, নওমুসলিম, ক্রীতদাস, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি, আল্লাহর পথে জিহাদ ও বিপদগ্রস্ত বিদেশি মুসাফির ও পথসন্তানদের জন্য। এটি আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞানী ও পরম কৌশলী। (সুরা-৯ তাওবাহ, আয়াত: ৬০)। উক্ত ৮টি খাতের মধ্যে যুগচাহিদা ও গুণাগুণ বিবেচনায় রেখে নিকটাত্মীয় ও প্রতিবেশীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। এতে জাকাত-ফিতরা আদায় হওয়ার পাশাপাশি নিয়ত অনুযায়ী ক্ষেত্রবিশেষ সওয়াবের তারতম্যও হবে। যেমন দ্বীনি ইলম অর্জনে, ধর্মীয় কাজে সহযোগিতা ইত্যাদি।

সদকা ও জাকাত যাদের দেওয়া যায় না তাঁরা হলেন পিতা-মাতা ও ঊর্ধ্বতন পুরুষ, ছেলেমেয়ে ও অধস্তন পুরুষ, ধনী লোক, যাঁরা নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক, সায়্যিদ অর্থাৎ হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রকৃত বংশধর ও অমুসলিম। পিতা-মাতা ও ছেলেমেয়েকে দেওয়া যায় না কারণ, তারা অসচ্ছল হলে তাদের ভরণপোষণ এই ব্যক্তির দায়িত্বে।

আপন সহোদর ভাইবোন গরিব হলে তাদেরকেও জাকাত দেওয়া যাবে এবং তা-ই উচিত। জাকাত দেওয়ার সময় দাতা জাকাতের নিয়ত করলেই হবে, গ্রহীতাকে তা জানানোর প্রয়োজন নেই। জাকাতগ্রহীতা যদি আত্মীয়স্বজন, আপনজন বা পরিচিত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি হন, তাহলে জাকাত উল্লেখ করাটা মোটেই সমীচীন হবে না। কারণ, এতে গ্রহীতা অপমানিত, অসম্মানিত ও বিব্রত বোধ করতে পারেন।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
[email protected]