নুসরাত হত্যার বিচার

বাংলাদেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কোনো সদস্য কোনো ধরনের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হলে, অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগের দায়িত্ব সচেতনভাবে এড়িয়ে গেলে, কিংবা অপরাধীদের পক্ষ নিয়ে অপরাধের শিকার ব্যক্তিদের ন্যায়বিচার পাওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করলে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়, এমন দৃষ্টান্ত অত্যন্ত বিরল। সেই বিবেচনায় ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহানকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় পুলিশ বিভাগকে ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে।

নুসরাত হত্যার ঘটনায় পুলিশ বিভাগের গঠিত তদন্ত কমিটি চার পুলিশ কর্মকর্তার গাফিলতি ও অসদাচরণের প্রমাণ পেয়েছে। এ জন্য সোনাগাজী থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেনকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। নুসরাত হত্যার আগে ধারণ করা একটি ভিডিও চিত্র তাঁর হত্যাকাণ্ডের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। একটি ভিডিও চিত্রে নুসরাতের সঙ্গে এই পুলিশ কর্মকর্তার কথোপকথনে স্পষ্ট হয়েছিল, ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন নুসরাতকে হত্যার নির্দেশদাতা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার পক্ষের লোক। পুলিশ সদর দপ্তরের তদন্ত কমিটির তদন্তেও সেটাই প্রমাণিত হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন ও এসআই ইকবাল হোসেন নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে প্রচারের কাজে একে অন্যকে সহযোগিতা করেন।

ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করার পর খবর পাওয়া গেল, সোনাগাজী থানার দুই এসআইকেও সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে এবং ফেনীর জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) জাহাঙ্গীর আলম সরকারকেও প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে বলা হয়েছে, সংযুক্তি কোনো বদলি নয়, এবং এটা শাস্তি প্রক্রিয়ার একটি অংশ। পুলিশের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এসপি জাহাঙ্গীর আলম সরকার সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনি সকাল ১০টায় নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার খবর পেয়েও ঘটনাস্থলে না গিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে রওনা দিয়েছিলেন, পরে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজির নির্দেশে মাঝপথ থেকে ফিরে আসেন।

এভাবে দেখা যাচ্ছে, নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যা করার যে বর্বর ঘটনাটি ঘটেছে, তার নির্দেশদাতা ও সংঘটকদের মনে এমন ভরসা ছিল যে স্থানীয় পুলিশের ক্ষমতাধর কর্মকর্তারা তাদের পাশে আছেন। কাউকে হাত-পা বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে নৃশংসভাবে পুড়িয়ে হত্যা করার পরও বিচার ও শাস্তির ঊর্ধ্বে থাকা যাবে—এমন সেন্স অব ইমপিউনিটি বা বিচারহীনতার বোধ তারা পেয়েছিল আইন প্রয়োগকারীদের সমর্থন বা পৃষ্ঠপোষকতার কারণেই।

সুতরাং ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন ও দুই এসআইকে সাময়িক বরখাস্ত এবং এসপিকে প্রত্যাহার সঠিক পদক্ষেপ। এ ধরনের পুলিশ কর্মকর্তা শুধু যে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথে প্রতিবন্ধক তা নয়, তাঁদের দ্বারা অপরাধবৃত্তি উৎসাহিত হয়, অপরাধীরা শাস্তির ভয় থেকে মুক্ত হয়ে অপরাধ সংঘটনে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। খোদ পুলিশ বিভাগের জন্যও তাঁরা ক্ষতিকর। তাঁদের কারণে রাষ্ট্রীয় সংস্থা হিসেবে পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, পুলিশের ওপর জনসাধারণের আস্থা কমে যায়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দেহে তাঁরা ক্ষতিকর জীবাণুর মতো কাজ করেন। পুলিশ বিভাগের উচিত এসব জীবাণু থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করা।

স্থানীয় পুলিশের এই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে নুসরাত হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার ও অপরাধীদের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করার পথ সুগম হবে বলে আমরা আশা করতে চাই। সে জন্য হত্যা মামলাটি দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করতে হবে, সংঘটিত অপরাধ আদালতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করার জন্য জোরালো অভিযোগপত্র তৈরি করা প্রয়োজন এবং অপরাধ প্রমাণে সহায়ক সাক্ষ্য–প্রমাণ সংগ্রহে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এসবের জন্য মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আন্তরিক সক্রিয়তা প্রয়োজন।