হাওরে বোরো ধানের দাম কম

আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে দর্শকদের চোখ ভেজাতে চান এমন পরিচালকেরা এই বেলা কৃষি নিয়ে একটা ছবি তৈরি করতে পারেন। গল্পটা এমন হতে পারে: একদিকে নেতারা, কৃষিবিজ্ঞানীরা এবং সরকারি কর্মকর্তারা কৃষির সম্ভাবনা নিয়ে অসামান্য সব স্বপ্ন দেখাচ্ছেন, অন্যদিকে কৃষকেরা গোলাভরা ধান পেয়েও ন্যায্য দামের অভাবে গালে হাত দিয়ে আড়তদারের আড়তের সামনে বসে আছেন।

ফসল মার খেলে তবু একধরনের সান্ত্বনা থাকে, কিন্তু মাঠভরা ধান ফলিয়েও যদি লোকসান গুনতে হয়, তাহলে তার চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কী থাকতে পারে? এখন হাওরাঞ্চলের কৃষকেরা সেই অবস্থা পার করছেন।

কর্মকর্তাদের দুর্নীতি আর সরকারের ‘ভুল নীতি’র মধ্যে পড়ে ধানচাষিদের এখন জান বেরোনোর জোগাড় হয়েছে। অন্যবারের চেয়ে এবার সরকার ধান কিনছে অনেক কম। স্থানীয় আড়তদারেরা সিন্ডিকেট করে যে দামে ধান কিনছেন, তা উৎপাদন খরচের চেয়ে অনেক কম। এই আড়তদারদের বাইরে গিয়ে ধান বিক্রির সুযোগ নেই। বাইরের কেউ এসে ধান কিনবে, সে পথও বন্ধ করে রাখা হয়েছে। এরপর আছে ‘ঢলতা’র উৎপাত। ৮০ কেজি ধানে দুই মণ হলেও স্থানীয়ভাবে ৮৩ কেজি ধানকে দুই মণ ধরছেন আড়তদারেরা। প্রতি দুই মণে তিন কেজি ধান ‘ফাউ’ দিতে হচ্ছে আড়তদারদের। এই ফাউ ধানকে বলে ঢলতা। এই ঢলতা ছাড়া ধান বিক্রি সম্ভব হচ্ছে না।

সরকার প্রতি মণ ধানের দাম বেঁধে দিয়েছে ১ হাজার ৪০ টাকা। কিন্তু মাঠের চিত্রে দেখা যাচ্ছে, আড়তদারেরা তা মানছেন না। সরকারের পক্ষ থেকেও তা মানা না-মানা নিয়ে কিছু বলতে দেখা যাচ্ছে না। ভেজা ধান প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকায়। শুকনো ধান ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকায়। আর এই ধান কাটতে একজন শ্রমিককে দিনে পারিশ্রমিক দিতে হচ্ছে এক হাজার টাকা।

এইভাবে ‘পানির দরে’ ধান না বেচে এক-দুই মাস পরে বেচলে হয়তো দাম পাওয়া যেত। কিন্তু পাওনাদারের তাগাদা, সুদের বোঝা, সংসারের দৈনন্দিন খরচ—এসব কারণে ধান না বেচে চাষির সামনে কোনো পথ খোলা নেই। তাই হাওরের কৃষকদের কাছে এখন ‘ক্ষমতা’ মানে ‘অপেক্ষা করার ক্ষমতা’। ধান এখনই না বেচে যাঁরা মাসখানেক রেখে দিতে পারবেন, তাঁরাই সেখানকার ‘ক্ষমতাবান’ লোক।

হাওরাঞ্চলে এই ধরনের ‘ক্ষমতাবান’ লোকের সংখ্যা হাতে গোনা। ক্ষমতাহীনেরা অগণিত। মূলত তাঁরাই ফসল ফলান। কিন্তু বারবার প্রতারিত হলে তাঁরা চাষাবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন। এ কারণে মঞ্চ থেকে যাঁদের আদর করে ‘চাষি ভাই’ বলে ডাকা হয়, মাঠে গিয়ে তাঁদের ‘চাষার বাচ্চা’ বলার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তাঁদের ন্যায্য অধিকারের দিকে সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে।