লাসান্থা বিক্রমাসিংহেকে মনে পড়ে

লাসান্থা বিক্রমাসিংহে
লাসান্থা বিক্রমাসিংহে

গত ৩৫ বছরে অনেক বড় বড় সাংবাদিকের সঙ্গে আমার জানাশোনা হয়েছে। তবে তাঁদের মধ্যে আমি শীর্ষস্থানীয় তিনজন সাহসী সাংবাদিকের মধ্যে লাসান্থা বিক্রমাসিংহেকে একজন মনে করি।

নিজের ভাই লাল বিক্রমাসিংহেকে সঙ্গে নিয়ে ১৯৯৪ সালে দ্য সানডে লিডার পত্রিকা করার পর থেকেই লাসান্থা একের পর এক মামলায় জড়িয়েছেন এবং আইনি মারপ্যাঁচের শিকার হয়েছেন।

লাসান্থা বিক্রমাসিংহে ১৯৮০ সালে সান নিউজ পেপার-এ সহসম্পাদক হিসেবে সাংবাদিকতার জীবন শুরু করেছিলেন। এরপর তিনি নিজের মেধা ও দক্ষতায় উঠে আসেন এবং আইল্যান্ড পত্রিকার বার্তা সম্পাদক হন। ২০০০ সালে তিনি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ইন্টিগ্রিটি অ্যাওয়ার্ড পান।

লাসান্থা বিক্রমাসিংহে সব সময়ই ক্ষমতাসীনদের পথের কাঁটা ছিলেন। সব সময়ই তিনি হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে ছিলেন। একবার তিনি আমাকে বলেছিলেন, তিনি ভোর চারটায় দিনের কাজ শুরু করবেন, কারণ ওই সময় রাস্তা ফাঁকা থাকে এবং ফাঁকা রাস্তায় অফিসে যাওয়ার পথে কেউ তাঁকে অনুসরণ করলে তিনি সহজেই তা বুঝতে পারবেন।

আসলে কী পরিমাণ ঝুঁকি ও বিপদ তাঁর ওপর ছিল, তা তিনি ভালো করে জানতেন। তিনি নৃশংসভাবে খুন হওয়ার আগে তাঁর ভাই আমাকে বলেছিলেন, তাঁরা নিরাপত্তাহীনতার কারণে শ্রীলঙ্কা ছেড়ে অন্য কোনো দেশে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। কিন্তু সেটি আর হয়ে ওঠেনি। ২০০৯ সালের ৮ জানুয়ারি অফিসে যাওয়ার পথে তাঁকে মোটরবাইকে আসা কিছু দুর্বৃত্ত তাঁর ব্যক্তিগত গাড়ি থামায় এবং তাঁকে গুলি করে। হাসপাতালে নেওয়ার পর সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়।

আমি বন্ধু হিসেবেই তাঁকে চিনতাম। তাঁর হত্যাকাণ্ডের তদন্তের সময় বাড়ানো চলছেই। তাঁর হত্যাকারীরা হত্যার আলামত, তথ্যপ্রমাণ নষ্টের যে চেষ্টা করেছিল, তদন্তকাজ প্রলম্বিত করার মধ্য দিয়ে তাদের সেই উদ্দেশ্যই পূরণ করা হচ্ছে। অবশ্য তাঁর হত্যাকারী কারা, সে বিষয়ে জনসাধারণের মধ্যে একটি সাধারণ ধারণা প্রথম থেকেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে।

লাসান্থা বিক্রমাসিংহে নিহত হওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেছিলেন, ‘৮ জানুয়ারি, তিনি (লাসান্থা) এবং আমি দুজনেই টের পেয়েছিলাম আমাদের অনুসরণ করা হচ্ছে। ওই দিন সকালে আমরা বাইরের কিছু কাজকর্ম সারার পর তিনি আমাকে বাসায় নামিয়ে দিলেন। আমার আরও কিছু কাজ ছিল। তিনি আমাকে কিছুক্ষণ পরে তাঁর অফিসে যেতে বললেন। আমি তাঁকে একা যেতে নিষেধ করলাম। কিন্তু তিনি শুনলেন না। একাই গেলেন। আমাকে নামিয়ে দেওয়ার ১০ মিনিট পরই একটি ফোনকল পেলাম। তখনই জানলাম, তাঁকে গুলি করা হয়েছে।’

লাসান্থা নিহত হওয়ার পর দেশে এবং দেশের বাইরে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। ভারতের হাইকমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, এটি শ্রীলঙ্কার সাংবাদিক সমাজ ও গণমাধ্যমের ওপর নগ্ন হামলা। বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত দাবি করা হয়। এর বাইরে ব্রিটিশ হাইকমিশন ও ইউরোপিয়ান কমিশন এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানায়। প্রখ্যাত কলামিস্ট ডি বি এস জিয়ারাজ ডেইলি মিরর পত্রিকায় ওই সময় লিখেছিলেন, লাসান্থা বিক্রমাসিংহের এই হত্যার মধ্য দিয়ে তাঁর দেখা শ্রেষ্ঠ সাহসী মানুষের অনন্য এক বীরত্বগাথার অবসান হয়েছে।

দেশে এবং দেশের বাইরে এ রকমের অসংখ্য মানুষ ও প্রতিষ্ঠান লাসান্থার হত্যাকাণ্ডে প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর হত্যার তদন্ত এগোয়নি। তাঁর হত্যাকারীদের সাজা না হওয়ায় শ্রীলঙ্কার প্রেক্ষাপটে যে মলিন প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসছে, সেটি হলো: সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকেরা কি ঝুঁকির মধ্যেই থাকবেন?

ইংরেজি থেকে অনূদিত
জীবন থিয়াগারাজা শ্রীলঙ্কার সেন্টার ফর হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাফেয়ার্সের চেয়ারম্যান