রোল মডেলের অর্থ বোঝা কঠিন

আঠারো শতকের আগের পাঁচ হাজার বছর পৃথিবীতে এখনকার ধরনের রাষ্ট্রও ছিল না, গণতন্ত্রও ছিল না। দুনিয়াতে গণতন্ত্র না থাকলে আকাশ খান খান হয়ে ভেঙে পড়ে না। গণতন্ত্র ছাড়াই মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন ভূখণ্ডে সভ্যতা সৃষ্টি করেছে। সমৃদ্ধ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হয়েছে। কখনো কোথাও কোথাও যুদ্ধবিগ্রহ, ধ্বংসযজ্ঞ ও নারকীয় নরহত্যা সত্ত্বেও বিপুল সৃষ্টিশীল কাজ হয়েছে। অনন্য স্থাপত্য নির্মিত হয়েছে। রচিত হয়েছে অমূল্য ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, সাহিত্য ও শিল্পকর্ম।

আমাদের দেশেও কান্তজী মন্দির, ষাটগম্বুজ মসজিদসহ অপূর্ব মন্দির–মসজিদ–ইমারত তৈরি হয়েছে সম্পূর্ণ গণতন্ত্রহীনতার মধ্যে। সেই সময়ও রামমোহন রায়, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছে। দাসসুলভ পরাধীন, গণতন্ত্রের লেশমাত্র নেই, সেই অবস্থায় উনিশ ও কুড়ি শতকে অসংখ্য মনীষীর জন্ম হয়েছে। জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আবির্ভূত হয়েছেন অনেক রাজনৈতিক নেতা। জনগণ তাঁদের বরণ করে নিয়েছে। তাঁদের কারণে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা এবং প্রতিষ্ঠিত হয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা।

১৯০৫ সালে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নিয়ে নতুন প্রদেশ গঠনের সময় থেকে জনসম্পৃক্ত রাজনীতির সূচনা। ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের আওতায় বিশের দশক থেকে সীমিত নির্বাচনী রাজনীতি চালু হয়। রাজনীতি তখনো নেতা ও তাঁর অনুসারী কর্মীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। মহাত্মা গান্ধী সূচনা করেন বিশের দশকের শুরুতে জনগণকে নিয়ে রাজনীতি তাঁর অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে। যদিও শেষ পর্যন্ত তা অহিংস থাকেনি। আশির দশক পর্যন্ত রাজনীতির সঙ্গে জনগণের কমবেশি সম্পর্ক ছিল। তারপর শুরু ক্যাডারপ্রধান রাজনীতি। জনগণ সরে যায় এক পাশে। রাজনীতি ছিল জনসেবা বা দেশসেবামূলক কাজ, তা পরিণত হয় একটি অতি লাভজনক পেশায়।

জীবিকার জন্য মানুষ অনেক কিছু করে। দোকান বা সুপারমার্কেট দেয়। আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা করে। কলকারখানা প্রতিষ্ঠা করে, যা জাতীয় অর্থনীতিতেও অবদান রাখে। কেউ মাদক চোরাচালান করে, যা সমাজ ও অর্থনীতির ক্ষতি করে। কেউ শেয়ারবাজারে নেমে রাজা হয়, কেউ হয় ফতুর। কেউ রুজি রোজগারের জন্য ইয়ের দালালি পর্যন্ত করে। বাঙালির নতুন পেশায় যোগ হয়েছে পার্লামেন্টের সদস্য হওয়া। তা হতে গেলে প্রথমে মনোনয়ন পাওয়ার সময় থেকে ভোটের দিন পর্যন্ত বিপুল বিনিয়োগ, তারপর অপরিমেয় প্রাপ্তি। এর চেয়ে বড় লাভজনক ব্যবসা শিল্পবিপ্লবের পরে আর কোনোটি ছিল না।

সব রাষ্ট্র একই প্রক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় না। কোনোটি আলোচনার মাধ্যমে, কোনো কোনোটি সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে। আমাদের বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে অভ্যুদয়। তাই মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা শব্দ দুটি উচ্চারণ না করে একটি ভাগ্যবান শ্রেণি কোনো আলাপই শুরু করে না। তারা মনে করে মুক্তিযুদ্ধই তাদের সৌভাগ্যের মূল।

একটি গোত্রের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলে এমন বুকের পাটা কোনো বাপের বেটার নেই। পাঁচতারা হোটেলে ডিনার করার পর রাতে চুকা ঢেকুর উঠলে বৃহস্পতিবার বিকেলের ফ্লাইটে চলে যান ব্যাংকক বা সিঙ্গাপুর। বেশি পানের পর রাতে দুইবারের বেশি পেশাব করতে বাথরুমে গেলে সুগার পরীক্ষা করতে বারডেমের ভিড়ের ভেতরে না গিয়ে দৌড় দেন ব্যাংকক।

বৈষয়িক কাজে হাঁপিয়ে উঠলে অবসর বিনোদনে সব সময়ই যে সবাই বালি বা অন্য কোনো দ্বীপে যান, তা নয়। কেউ যান সবুজে নিঃশ্বাস নিতে ভালুকা বা জয়দেবপুর–ময়মনসিংহ সড়কের পাশে গহিন অরণ্যবেষ্টিত কোনো নিভৃত বাগানবাড়িতে।

এই বাগানবাড়ির কনসেপ্টটা আগে ছিল না। তা থাকলে সেকালে পাকিস্তানের দুই অংশেই ২২ পরিবারের অসংখ্য বাগানবাড়ি থাকত। আদমজী–ইস্পাহানিরা চাইলে মীরজুমলার সময় নির্মিত তুরাগের ওপর টঙ্গী ব্রিজ থেকে ময়মনসিংহের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব জায়গা কিনে ফেলতে পারতেন। জমি এত সস্তা ছিল যে তাঁরা চাইলে আমিনবাজার থেকে আরিচা ঘাট পর্যন্ত সড়কের দুই পাশের তাবৎ জমি কিনে যা খুশি তাই বানাতেন।

আদমজী–ইস্পাহানি ইচ্ছা পোষণ করলে মেঘনা ব্রিজ থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত সড়কের পাশের হাজার হাজার বিঘা জমির কিছু কিনে বাকিটা জবরদখল করতে পারতেন। শ্যামপুর থেকে মাওয়া ঘাট পর্যন্ত সব নিচু জমি কেনা তাদের জন্য কোনো ব্যাপারই ছিল না। আজ ভাগ্যবানদের দ্বারা রাজধানীর চারদিকের ফসলের জমি অবলীলায় ভরাট হয়ে গেছে। যেখানে ভরাট হয়নি সেখানে গড়ে উঠেছে ইটভাটা। সারা দিনরাত দোজখের আগুনের মতো সেখানে পুড়ছে মাটি। তার চিমনির ধোঁয়ায় জনপদ ও আকাশ অন্ধকার।

এ সবই যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য, তাতে সন্দেহ পোষণ করে এমন অপদার্থ দেশে একজনও নেই। রাজনীতিজীবী ও অমাত্যদের অনেকে সন–তারিখ পর্যন্ত বলে দিচ্ছেন, যখন বাংলাদেশ অর্থনীতিতে অস্ট্রেলিয়া–কানাডাকে অতিক্রম করবে, জি-৭ দেশের কাতারে যাবে। এর চেয়ে খুশির কথা আর হতে পারে না। কিন্তু এই সব বিজ্ঞ ব্যক্তি অস্ট্রেলিয়া–কানাডার মানচিত্রের দিকে তাকাননি। সেসব দেশের ভূমির পরিমাণ ও মানুষের সংখ্যাটার কথা খেয়াল করেননি। বাংলাদেশের প্রতি বিঘা জমিতে যদি কলকারখানা হয়, ইটভাটা হয়, নদীগুলো ভরাট করে যদি তামাক ও ভুট্টাচাষ করা যায়, তাহলে অর্থনীতির আকার ও প্রবৃদ্ধির হার চীনকে ছাড়িয়ে যেতেই পারে।

বাংলাদেশ যদি অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও জাপানের মতো উন্নত হয়ে ওঠে, গণতন্ত্রের নামও মানুষ মুখে আনবে না। যানজট যতই হোক, কেউ মুখ খুলবে
না। ভেজাল ও বিষাক্ত খাদ্য খেয়েও মানুষ তৃপ্তির ঢেকুর তুলবে। বিশ্বের সবচেয়ে বায়ুদূষণের নগরী শুধু নয়, ঢাকার বাতাসে যদি বিষও থাকে কেউ আপত্তি করবে না।

বাজেটের আকার অবিশ্বাস্যভাবে বাড়ছে। রোল মডেল শব্দটি এখন হতভাগ্য টোকাই পর্যন্ত জানে। তার অর্থ জানে না, কিন্তু প্রতিদিন শুনছে। আর্থিক অবস্থা এতটাই সরেস যে এরপর ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে অনেকে। দ্রুততম সময়ে বিত্তবান হওয়ার সুবন্দোবস্ত অব্যাহত থাকলে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে মেরে দেওয়ার বর্তমান ব্যবস্থা অপ্রতিহত থাকলে আলবদর রাজাকার পর্যন্ত পাকিস্তানকে গালাগাল দিতে শুরু করবে।

একাত্তরে স্বজন হারানো ৩০ লাখ পরিবারের ৯০ শতাংশেরই বাস্তুভিটা নেই। তাদের দুর্ভাগ্যের বিনিময়ে পাহাড়ি এলাকা ও বনভূমিতে গড়ে উঠছে বাগানবাড়ি, মহাসড়কগুলোর দুই পাশে বিশাল সাম্রাজ্য। নানা রকম ডেভেলপমেন্ট গোল বা উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না করে বাংলাদেশ যাবে কোথায়?

অনেকে সগৌরবে জনগণকে শোনাচ্ছেন, বাংলাদেশ অমুক বছরের মধ্যে মালয়েশিয়া হয়ে উঠবে। একাত্তরে একজন বাঙালিও এ দেশকে মালয় দেশ বানানোর কথা ভাবেনি। বরং মালয়েশিয়াই বাংলাদেশের মতো হতে চেয়েছিল। আশির দশক পর্যন্ত মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশে মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং প্রভৃতি পড়তে শিক্ষার্থীরা আসতেন। আজ বাংলাদেশ থেকে লাখ লাখ নারী–পুরুষ সে দেশে যাচ্ছে দাসত্ব করতে। এই রোল মডেলের অর্থ বোঝার বিদ্যা আমার নেই।

বাজারে আম–লিচু উঠতে না উঠতেই বাজেট নিয়ে বয়ান শুরু হয়। কনসালট্যান্ট দিয়ে রচিত প্রথাগত বাজেটের মূল্য রয়েছে, কিন্তু আরও যা দরকার তা হলো জাতির আবহমানকালের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করে, জনগণের যোগ্যতা পরিমাপ করে, সমস্যা ও সম্ভাবনা শনাক্ত করে, পরিবেশ রক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন। জনগণের প্রতিনিধিত্বহীন প্রথাগত ধারায় যে উন্নয়ন, তা স্থায়িত্ব পাবে না। তাতে নতুন কোনো সভ্যতা সৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। 

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক