বহুতল আবাসিক ভবনেও নজর দরকার

চকবাজারের চুড়িহাট্টায় এবং বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুন লাগার পর জাতি দেখল, শুধু পুরান ঢাকায় নয়, নতুন ঢাকায়ও আগুন লাগার ফলে কী পরিস্থিতিতে অসহায় মানুষের মৃত্যু হতে পারে। ঘরের বাইরে সড়ক দুর্ঘটনা আর ঘরের ভেতরে আগুন লাগার আতঙ্ক মানুষকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।

আশার কথা, রাজউকসহ কয়েকটি সংস্থা এফ আর টাওয়ারে আগুন লাগার বিষয়টি খুব গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করেছে এবং তদন্ত কমিটি গঠনসহ বাস্তব কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। রাজউক কমসংখ্যক লোকবল দিয়ে হলেও চেষ্টা করছে এমন ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করতে। ফায়ার সার্ভিস ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে প্রয়োজনে ভবনের সামনে ঝুঁকির নোটিশ ঝুলিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

ঢাকায় এখন আশি-নব্বইয়ের দশক থেকে নির্মিত অনেক ছয়তলা আবাসিক ভবনও ধসিয়ে ১০-১২ তলা করা হচ্ছে। এই প্রবণতা ২০০৮ সাল থেকে রাজউকের এফএআরের (ফ্লোর এরিয়া রেশিও) নীতিমালা হওয়ার পর থেকে লক্ষ করা যায়। নতুন প্লট হলে তো কথাই নেই। আকাশের দিকে যত বাড়বে, পাশে তত খোলা জায়গা বেশি রেখে ভবনের নকশা করতে হবে, এটাই মোটা দাগে এফএআরের নিয়ম। এই ছোট ঘনবসতিপূর্ণ দেশে আকাশের দিকে বাড়ানো আর মাটির নিচটাও ব্যবহার করা ছাড়া উপায় নেই। আকাশের দিকে বাড়ার সঙ্গে ভবনের ভূমিকম্প প্রতিরোধ ক্ষমতা আর আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার সক্ষমতা বাড়াতে হয়।

ভূমিকম্পের সময় বহুতল ভবন থেকে দৌড়ঝাঁপ করে বের হওয়ার চেষ্টা করা নিজেকে মৃত্যুঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেওয়ার শামিল। ঝাঁকুনির মুহূর্তে বোঝাপড়াটা হবে ভবন ও তার বাসিন্দাদের মধ্যে। তেমনি বহুতল ভবনে আগুন নেভানোর সক্ষমতা থাকা অপরিহার্য। বিএনবিসি (বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড) অনুসরণ করে ভবনের নকশা করলে এফ আর টাওয়ারের মতো মানুষজনকে সরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হওয়ার সুযোগ নেই। বিএনবিসি মেনে নকশা করা হচ্ছে কি না এবং নকশা অনুসরণ করে নির্মাণকাজ হচ্ছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব রাজউকের।

বহুতল আবাসিক ভবনগুলোতে শিশু, বয়স্ক ব্যক্তিসহ সব বয়সী লোক বাস করে। আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিসের ভরসায় বসে না থেকে নিজ ভবনের আগুন নেভানোর সক্ষমতা নিজেদের থাকা অপরিহার্য। সাধারণত বহুতল আবাসিক ভবনে আগুন নির্বাপণ যন্ত্র (ফায়ার এক্সটিংগুইশার) রাখা থাকে প্রতি তলা বা একতলা পরপর। এই আগুন নেভানোর যন্ত্রটা কীভাবে চালাতে হয়, তা ভবনে বাস করা প্রত্যেক বাসিন্দার জানা দরকার। কারণ, ভবনে বাস করা ব্যক্তিদের মধ্যে গৃহস্থালির কাজে যাঁরা সহায়তা করেন, তঁাদের বাসায় উপস্থিত থাকার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। তারপর বেশি সম্ভাবনা থাকে বাসার গৃহিণীর ও বয়স্ক সদস্যদের। তাই বাসার কাজের মানুষ ও গৃহিণীসহ সবারই জানা দরকার যন্ত্রটা কী করে চালাতে হবে। তা জানার জন্য অগ্নিনির্বাপণ মহড়া করা ছাড়া সহজ কোনো উপায় নেই।

এই মহড়া নিখরচায় করা সম্ভব। শুধু প্রয়োজন উদ্যোগের। সিলিন্ডার আদলে তৈরি সাধারণত লাল রঙের এই যন্ত্রগুলোর মধ্যে থাকা কার্বন ডাই-অক্সাইড বছর পেরোতে নতুন করে ভরতে হয়। এর আগে একটি ভবনে থাকা সব যন্ত্র ব্যবহার করে ভবনের সামনের রাস্তা বা অন্য কোনো খোলা জায়গায় ফায়ার ড্রিল করা সম্ভব। একটি খোলা টিনের মধ্যে কিছু দাহ্য পদার্থে আগুন লাগিয়ে ভবনের তত্ত্বাবধানে থাকা লোকজন, গৃহস্থালির কাজে সহায়তাকারী লোকজন, গৃহিণী ও অন্যরা যন্ত্রগুলো দিয়ে আগুন নেভাবেন। যাঁরা সরাসরি হাতে নিয়ে নেভানোর সুযোগ পাবেন না, তাঁরা হাতে থাকা একটি কাগজে লেখা নির্দেশনা থেকে অনুসরণ করবেন।

প্রতিবছর এই মহড়া করা গেলে বাসিন্দাদের প্রত্যেকেই নিজ হাতে যন্ত্রটি ব্যবহার করে আগুন নেভানোর সুযোগ পাবেন। একটি সড়কে থাকা সব কটি ভবন মিলে এই উদ্যোগ নিলে একত্রে মহড়ার কাজটি হতে পারে। এই উদ্যোগের কথা নিকটবর্তী ফায়ার স্টেশনে জানালে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য তারাও আগুন নেভানোর গাড়িসমেত উপস্থিত থাকতে পারে।

আমরা বড় মাপের কোনো দুর্ঘটনা না ঘটার আগে কিছু করি না। ২০০৯ সালের ১৩ মার্চ পান্থপথের বসুন্ধরা সিটিতে আগুন লাগার পর ঢাকার অনেক বাণিজ্যিক ভবনে অগ্নিনির্বাপণ মহড়া করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিছুদিন পর আবার তা থেমে যায়। অগ্নিনির্বাপণ মহড়া করা বহুতল ভবনের একটি নিয়মিত কাজ, যা কমপক্ষে বছরে এক বা একাধিকবার হতে হবে। সে জন্য কোনো বহুতল ভবনে আগুন লাগতে হবে কেন? আমরা আসলে গাড়ি রাস্তায় অকেজো না হওয়া পর্যন্ত গ্যারেজের দিকে যেতে চাই না বা অসুস্থ না হলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য হাসপাতালে হেলথ চেক করাই না। কিছু একটা ঘটার পর তার খেসারত দিতে হয় অনেক বেশি। অগ্নিনির্বাপণ মহড়ার মাধ্যমে হাতে–কলমে আগুন নেভানো শেখা জীবনবিমা করার শামিল।

পানির অভাবে ঢাকায় আগুন নেভানোর কাজ বাধাগ্রস্ত হতে দেখা যায়। ওয়াটার হাইড্রেন্ট পানির উৎসের একটি উৎকৃষ্ট ব্যবস্থা। কিন্তু ঢাকার মতো বড় শহরে ওয়াটার হাইড্রেন্টের ব্যবস্থাপনা মোটেই সহজ কাজ নয়। প্রযুক্তিগত সমস্যা ছাড়াও পানির অবৈধ ব্যবহার একটি সমস্যা। যে সমস্যার কারণে পুরান ঢাকায় থাকা ওয়াটার হাইড্রেন্ট নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে ওয়াসা বন্ধ করে দেয়। তবে ওয়াসার পাম্প স্টেশন থেকে এলাকাভিত্তিক এমন ব্যবস্থা রিজার্ভ ওয়াটার দিয়ে থাকতে পারে। বিষয়টি নিয়ে ওয়াসা ও ফায়ার সার্ভিস কাজ করতে পারে।

ঢাকা শহরে থাকা লাখো ভবনের প্রতি রাজউকের পক্ষে নজর রাখা কঠিন। ভূমিকম্প প্রতিরোধ সক্ষমতা ও ফায়ার সেফটিসম্পন্ন ভবন কি না, তা যাচাই করার জন্য রাজউকের লোকবল অপ্রতুল। তাই রাজউক কর্তৃক এলাকাভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিলে ভালো হয়। তারা ভবন নির্মাণ ও নির্মাণ-উত্তর সেবা দেবে এবং রাজউকের কাছে রিপোর্ট করবে। এর জন্য পরামর্শক ফি রাজউক ভবনমালিকের কাছ থেকে আদায় করবে, যার পরিমাণ খুব বেশি হবে না। এই সামান্য ফি কিন্তু সম্পদ ও জীবনবিমার অংশ।

ড. আলী আকবর মল্লিক: কাঠামো প্রকৌশলী ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ