একসঙ্গে চার ফ্রন্টে ডোনাল্ড ট্রাম্প

ডোনাল্ড ট্রাম্প
ডোনাল্ড ট্রাম্প

উত্তর কোরিয়া, ভেনেজুয়েলা, ইরান ও চীন—একই সঙ্গে এই চার ফ্রন্টে বিবাদে জড়িয়ে পড়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।

উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক অস্ত্র প্রশ্নে চুক্তি হাতের মুঠোয়, এমন দাবির ভিত্তিতে ট্রাম্প নিজের জন্য নোবেল পুরস্কার দাবি করেছিলেন। ফেব্রুয়ারিতে ভিয়েতনামে ট্রাম্প ও কিমের দ্বিতীয় শীর্ষ বৈঠক ব্যর্থ হওয়ার পর তাঁরা এখন একে অপরকে দুষছেন। গত সপ্তাহে উত্তর কোরিয়া দুটি স্বল্প পাল্লার মিসাইল নিক্ষেপ করেছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে পণ্য পাচারের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমায় উত্তর কোরিয়ার একটি কয়লাবোঝাই জাহাজ আটক করেছে।

ভেনেজুয়েলায় সরকার পরিবর্তনের জন্য সে দেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে গোপন আলাপ-আলোচনা, এমনকি প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দলবদলের আশ্বাস সত্ত্বেও মাদুরো সরকার এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছে। ওয়াশিংটন বলছে, কিউবা ও রাশিয়ার নাক গলানোর জন্যই মাদুরো আসন ছাড়ছেন না। ‘সরকার বদলের’ এই আয়োজনে প্রধান উদ্যোগী ছিলেন ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন। এই ব্যর্থতায় ট্রাম্প এতটা ক্ষিপ্ত যে তিনি বোল্টনকে ডেকে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন বলে জানা গেছে। আপাতত ব্যর্থ হলেও সরকার বদলের চেষ্টা থেমে গেছে, এ কথা ভাবার কোনো কারণ নেই।

ইরানের সঙ্গে যুদ্ধের তাপমাত্রা বৃদ্ধিতেও প্রধান রূপকার বোল্টন। মধ্যপ্রাচ্যের উদ্দেশ্যে গত সপ্তাহে একটি মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ও বোমারু বিমান পাঠানোর সিদ্ধান্তের পর এই দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধের আশঙ্কা তেতে উঠেছে। শুক্রবার গৃহীত আরেক সিদ্ধান্তে যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে প্যাট্রিয়ট মিসাইল পাঠাচ্ছে বলে জানিয়েছে। এর আগে আমেরিকা কোনো দেশ, যাতে তার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ইরানের তেল না কেনে, এ বিষয়ে হুঁশিয়ারি দেয়। ভাবা হচ্ছে, ইরান সরকারের তেল ও অন্যান্য রপ্তানি শূন্যের কোঠায় এনে তাকে পদানত করতে চাইছে ওয়াশিংটন। লক্ষ্য একটাই, সে দেশে সরকার বদল। ইরান অবশ্য ভীত হওয়ার বদলে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে বহুজাতিক পারমাণবিক চুক্তির অংশবিশেষ ভঙ্গ করে পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদন শুরুর কথা ঘোষণা করেছে। এই ইট বনাম পাটকেলের অংশ হিসেবে কিছুদিন আগে আমেরিকা ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডকে সন্ত্রাসী দল হিসেবে ঘোষণা করলে তার জবাবে ইরান ইরাকে অবস্থিত মার্কিন সৈন্যদের ‘সন্ত্রাসী’ তকমা সেঁটে দেয়। বিশেষজ্ঞেরা এই ভেবে ভীত যে ইরাকে যে পাঁচ হাজার মার্কিন সৈন্য রয়েছে, তারা যেকোনো সময় ইরানপন্থী ইরাকি মিলিশিয়াদের আক্রমণের শিকার হতে পারে। এ রকম সামান্য কোনো ঘটনা থেকেই এই অঞ্চলে বড় রকমের যুদ্ধ বেধে যেতে পারে। শুরুটা যাতে ইরান করে, যুক্তরাষ্ট্র তেমন চেষ্টা করে চলেছে বলেই মনে হচ্ছে।

চতুর্থ ফ্রন্ট চীনের সঙ্গে, বাণিজ্য চুক্তি প্রশ্নে। ট্রাম্প আশা করেছিলেন, শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়ে তিনি চীনের কাছ থেকে রেয়াত আদায় করে নেবেন। বৃহস্পতি ও শুক্রবার এই দুই দেশের নেতাদের মধ্যে ওয়াশিংটনে দফায় দফায় বৈঠক শেষে চীনা নেতারা দেশে ফিরে গেছেন। বেইজিং জানিয়ে দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র তাদের রপ্তানি পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করার জবাবে তারাও পাল্টা ব্যবস্থা নেবে।

অধিকাংশ ভাষ্যকার একমত, প্রতিটি ক্ষেত্রেই ট্রাম্পের এই যুদ্ধংদেহী মনোভাবের পেছনে ২০২০ সালের নির্বাচনী অঙ্ক কাজ করছে। অভিবাসন প্রশ্নে ট্রাম্পের অবস্থান দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আসা অভিবাসী ভোটারদের মধ্যে বিরূপ মনোভাবের জন্ম দিয়েছে। এই অবস্থায় ভেনেজুয়েলার অজনপ্রিয় মাদুরো সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তিনি নিজের বিজয়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফ্লোরিডার রক্ষণশীল লাতিন আমেরিকান ভোটারদের নিজ দলে টানতে চাইছেন। ইরানের সঙ্গে কঠোর হওয়ায় ইসরায়েল ও ইসরায়েলপন্থী রক্ষণশীল মার্কিন ভোটাররা খুশি হবেন, এমন ভাবনাও তাঁর মাথায় রয়েছে।

ট্রাম্প চীনের সঙ্গে বাণিজ্য প্রশ্নে তিনি কঠোর হবেন, এ কথা তিনি ২০১৬ সালের নির্বাচনী প্রচারণার সময় থেকেই বলে আসছেন। ‘বাণিজ্যযুদ্ধ খুব সোজা, ’ এমন কথা তিনি অনেকবার বলেছেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, তা মোটেই নয়। নিজেকে ‘শুল্কপন্থী’ হিসেবে পরিচিত করালেও চীনের ওপর আরোপিত শুল্কের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন আমেরিকার কৃষিনির্ভর রাজ্যগুলোর ভোটাররা। সয়াবিনসহ যেসব কৃষিপণ্য চীন বিপুল পরিমাণে আমদানি করত, তা নাটকীয়ভাবে হ্রাস পাওয়ায় অনেকের ব্যবসা এখন লাটে উঠতে বসেছে। ২০১৬ সালের নির্বাচনে কৃষিপ্রধান অধিকাংশ রাজ্য ট্রাম্পের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। এবার তারা হয়তো ভিন্ন পথ নেবে।

ট্রাম্প দাবি করেছিলেন, শুধু চীন নয়, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর সব বাণিজ্য চুক্তি তিনি ঢেলে সাজাবেন, এই কাজ তাঁর চেয়ে বেশি ভালো আর কেউ বোঝে না। ক্ষমতা গ্রহণের পর দুই বছর পেরিয়ে গেলেও এই পর্যন্ত ট্রাম্প শুধু দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে একটি নগণ্য বাণিজ্য চুক্তি সম্পন্ন করতে পেরেছেন। কানাডা ও মেক্সিকোর সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় নাফটা চুক্তি নতুন করে সম্পাদিত হয়েছে বটে, কিন্তু কংগ্রেসে উভয় দলের আপত্তির কারণে তার আইনি সম্মতি বা র‍্যাটিফিকেশন আটকে আছে। ইউরোপের সঙ্গেও বাণিজ্য চুক্তি চূড়ান্তকরণের কোনো লক্ষণ নেই। লোহা ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক প্রশ্নে তাঁর নিজের দলের অনেক শীর্ষ সিনেটরই আপত্তি তুলেছেন। ভাবা হয়েছিল, চীনের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি প্রশ্নে চাপ সৃষ্টির জন্য ট্রাম্প অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেছেন। এটা তাঁর পুরোনো ব্যবসায়িক চাল। বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউসে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনার আগে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ ঘোষণার সময় ট্রাম্প নিজেই বলেছিলেন, ‘শুল্ক আরোপ খুবই ভালো একটা কাজ। পৃথিবীর সবাই ভাবে, আমরা তাদের মাটির ব্যাংক। চীনসহ সবাই আমাদের কাছ থেকে চুরি করছে, তা ঠেকাতেই অতিরিক্ত শুল্ক।’

শুল্ক আরোপের হুমকি সত্ত্বেও চীন ভড়কে গেছে, এ কথা মনে হয় না। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে একটি ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন বলে ভাবা হলেও নিজ দেশের জনগণের সামনে কিছুতেই নিজেকে ‘দুর্বল’ দেখাতে চাইবেন না। নিউইয়র্ক টাইমস হাডসন ইনস্টিটিউটের চীনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ মাইকেল পিলসবারির উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার মূল কারণই হলো চীনের কঠোরপন্থীরা প্রেসিডেন্ট সির ওপর চাপ দিচ্ছেন, যাতে তিনি পিছু না হটেন। ট্রাম্পের মতো তাঁকেও অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সমীকরণ মাথায় রাখতে হচ্ছে।

পাল্টা শুল্ক আরোপ ছাড়াও চীনের হাতে অন্য অস্ত্র রয়েছে। সে চাইলে তার কাছে রক্ষিত যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সোয়া ট্রিলিয়ন ডলারের ট্রেজারি বন্ড যেকোনো সময় বাজারে ছেড়ে দিতে পারে, যা আমেরিকার অর্থনীতির জন্য বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। বিশেষজ্ঞরা অবশ্য মনে করেন না চীন সে পথ যাবে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক রক্ষা করা তার জন্যও কম জরুরি নয়।

যদি শেষ পর্যন্ত চীনের সঙ্গে সন্তোষজনক কোনো চুক্তি স্বাক্ষরিত না হয়, তাহলে ট্রাম্প সম্ভবত চীনের ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করবেন। বাজে চুক্তির চেয়ে কোনো চুক্তি না করা অনেক ভালো, এমন যুক্তি দেখাবেন। তিনি ইতিমধ্যে বলে রেখেছেন, যেসব মার্কিন কোম্পানি চীনে কারখানা খুলে বসেছে, তাদের উচিত হবে সেসব কারখানা তুলে এনে যুক্তরাষ্ট্রে বসানো। কথাটা বলা যত সহজ, বাস্তবে ততটা নয়। ট্রাম্প চাইলেও বিশ্বায়নের চাকা বদলানো যাবে না, এ ব্যাপারে প্রায় সব বিশেষজ্ঞই একমত।

হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি