ফেসবুকে খায়, ফেসবুকেই ঘুমায়

ফেসবুক
ফেসবুক

সবাই না হলেও মানুষ এখন ফেসবুকে খায়, ফেসবুকেই ঘুমায়। ডি এল রায়ের গানের মতো, ‘তারা পাখির ডাকে ঘুমিয়ে পড়ে, পাখির ডাকে জাগে’। তবে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙার পরিস্থিতি আর নেই। সবার ঘরে ঘরে এখন ফেসবুক পাখি। দিন-রাত চ্যাট বক্সে শুধু ফুত ফুত করে মেসেজ আসতে থাকে। সেই মেসেজের ডাকেই এখন ফেসবুকবাসীর ঘুম ভাঙে।

এ বড় অদ্ভুত এক সময়ে আমরা বাস করছি। মানুষের প্রেম–ভালোবাসা, আবেগ–অনুভূতির সবকিছু যেন বন্দী হয়ে পড়েছে এই ফেসবুকের খাঁচায়। মরমি কবি হাসন রাজার গানে পিঞ্জিরায় বন্দী পাখির বাইরের পৃথিবী দেখার জন্য ছটফট করার কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু এ জামানার মরমি উদ্ভাবক মার্ক জাকারবার্গ আমাদের ফেসবুক নামে যে পাখির সন্ধান দিয়েছেন, সেই পাখি আর কোনো মানুষকে যেন উড়তেই দিতে চায় না। বাইরের পৃথিবীর রূপ-রস-সুধা তার কাছে তুচ্ছ। বরং খাঁচাই তার কাছে প্রিয়। বিছানায় কিংবা সোফায় মটকা দিয়ে পড়ে থেকে, অফিসের ডেস্কে ঠ্যাং এলিয়ে দিয়ে, বাসে-ট্রেনে-লঞ্চে-বিমানে চলতে চলতে, রিকশায় হুট তুলে বা নামিয়ে দিয়ে নিবিষ্টচিত্তে, রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, রাস্তা পারাপার হতে হতে, রেলক্রসিংয়ে দাঁড়িয়ে এক হাত ঊর্ধ্বপানে বাড়িয়ে, মোটরসাইকেলের পেছনে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসে থেকে একটাই কাজ করছেন ফেসবুকে বুঁদ হয়ে পড়ে থাকা মানুষগুলো।

‘নতমুখ’ শব্দটির সঙ্গে আমরা পরিচিত। একসময় আমরা মুরব্বিদের প্রতি শ্রদ্ধায় নতমুখ থাকতাম। আমরা অনেকে এখনো নতজানু না হলেও আছি—তবে তা মুরব্বিদের প্রতি শ্রদ্ধায় নয়, ফেসবুকের প্রতি আসক্তি বা ভালোবাসায় নতমুখ। মাথা নিচু করে মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকা ছাড়া যেন আর কোনো কাজ নেই। এই ফেসবুকে নতমুখ একটি প্রজন্মই তৈরি হয়ে গেছে। আগে প্রেয়সীর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার একটা ব্যাপার ছিল। এখন প্রেয়সী থেকে সরে গিয়ে সব অপলক দৃষ্টি যেন ফেসবুকে নিবদ্ধ হয়ে গেছে। আত্মীয়স্বজন কিংবা বন্ধুবান্ধবের আড্ডাগুলো ম্লান হয়ে যাচ্ছে ফেসবুকের ‘কল্যাণে’। পাশাপাশি পাঁচ–সাতজন বন্ধু কিংবা আত্মীয়স্বজন বসেও কেউ কারও সঙ্গে খুব বেশি কথা বলছে না। সবাই ফেসবুকে মগ্ন। গাড়িতে মা-বাবার সঙ্গে ছেলে-মেয়ে বসা। তারা প্রত্যেকে ডুবে আছে ফেসবুকে।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মহীনের ঘোড়াগুলি ব্যান্ড প্রায় ৪০ বছর আগে একটি গান গেয়েছে। ‘পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে’ শিরোনামে গানটির উদাহরণ এ প্রসঙ্গে খুব জুতসই। এই গানের ব্রিজলাইন দুটো হলো ‘ভেবে দেখেছ কি, তারারা যত আলোকবর্ষ দূরে/ তারও দূরে, তুমি আর আমি যাই ক্রমে সরে সরে।’ তাদের গানে ‘বোকা বাক্স’ বা টেলিভিশনের কথা বোঝানো হয়েছে। সেই টেলিভিশনই যদি পারস্পরিক সম্পর্কগুলোর মধ্যে আলোকবর্ষ দূরের ব্যবধান সৃষ্টি করে, তাহলে ফেসবুক এখন সেই দূরত্ব কোথায় নিয়ে গেছে, তা ভাবনার বিষয়।

একটি আবিষ্কারের ইতিবাচক দিকগুলো গ্রহণ করব কি না, সেটি একান্তই ব্যক্তির ওপর নির্ভর করে। সেই ব্যক্তি যখন আবিষ্কারটির নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ে মত্ত হয়ে যান, তখন তা একাধারে পরিবার, বড়জোর সমাজের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। আবিষ্কারটির ইতিবাচক দিকগুলো গ্রহণ কখনো কখনো রাষ্ট্রের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। এর অন্যতম উদাহরণ ‘আরব বসন্ত’।

মাত্র ২৮ দিনের ক্রমাগত প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশের মুখে ২০১১ সালের ১৪ জানুয়ারি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান ২৩ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট বেন আলী। এর মাসখানেক পরে ৩০ বছরের শাসনের অবসান ঘটে মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের। এর আগে তিউনিসিয়ায় ২০১০ সালের ডিসেম্বরে শুরু হওয়া প্রতিবাদ সমাবেশ, ধর্মঘট ও মিছিলের ঢেউ বৃহত্তর আরবের প্রায় সব দেশকেই ছুঁয়ে গিয়েছিল। এই বিপ্লবের ফলে তিউনিসিয়া, মিসর, লিবিয়া ও ইয়েমেনের শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতাচ্যুত হয়। আলজেরিয়া, ইরাক, জর্ডান, কুয়েত, মরক্কো ও ওমানে বড় ধরনের প্রতিবাদ শুরু হয়। এসব প্রতিবাদ-আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রাণভোমরার কাজ করেছে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষত ফেসবুক। ওই আন্দোলনকে তখন অনেকে ‘ফেসবুক অভ্যুত্থান’ বা ‘টুইটার বিপ্লব’ বলেও আখ্যা দিয়েছেন।

প্রতিটি আবিষ্কারের নেতিবাচক ও ইতিবাচক দিক থাকে। ফেসবুক সারা পৃথিবীকে এক করে দিয়েছে। কেউ ২০ বছর, কেউ ৩০ বছর পর খুঁজে পেয়েছেন আপনজনকে। আমি দীর্ঘ ২৮ বছর পর আমার এক বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছি এই ফেসবুকে। এটি এক অসাধারণ ব্যাপার। অদ্ভুত ভালো লাগা তৈরি করে মন ও মননে। বিভিন্নভাবে লতায়-পাতায় জড়ানো বহু সম্পর্কের সূত্র ধরে চার-পাঁচ হাজার মানুষকে বন্ধু বানানো যায়। এই বন্ধুদের জীবনের নানা গল্প, ঘটনা, দুর্ঘটনার খবর জানা যায়। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে তাঁদের সঙ্গে কথা বলা যায়। চেনা-অচেনা পৃথিবীর সীমানা ঘুরে আসা যায় মুহূর্তেই। এগুলো কি কম পাওয়া? এত এত পাওয়ার আধার এই ফেসবুকে আমরা যা খুশি লিখে যাচ্ছি। আমাদের এসব লেখার প্রভাব পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে কীভাবে কতটুকু পড়ছে, তার তোয়াক্কা করছি না। শিশুর রক্তাক্ত শরীরের ছবি থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে নানা ট্রল করছি। বাড়ির পোষা বিড়াল ও কুকুরকে কম্বলে মুড়িয়ে তার পাশে শুয়ে নানান আহ্লাদী স্ট্যাটাস দিচ্ছি। কী অদ্ভুত!

এই অদ্ভুতুড়ে পরিস্থিতির অবসান যত তাড়াতাড়ি ঘটবে, ফেসবুক আমাদের জন্য ততই কল্যাণ বয়ে আনার পথ তৈরি করে দেবে।

সাজেদ ফাতেমী: ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির জনসংযোগ পরিচালক ও নকশীকাঁথা ব্যান্ডের ভোকাল