খাদ্যে ভেজাল

বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে খাদ্যে ভেজালের সংবেদনশীল ও ভয়ানক খবরগুলো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আসছে। হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ এবার যেভাবে নিম্নমানের ৫২ খাদ্যপণ্য প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছেন, সেটা খুবই নির্দিষ্ট—এমনটা সম্ভবত এই প্রথম। কিন্তু এর আগে এটা আমরা উদ্বেগের সঙ্গে দেখেছি, হাইকোর্টের হস্তক্ষেপের পরেও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে পরিস্থিতির তেমন হেরফের ঘটেনি। অথচ সরকারি সংস্থার দ্বারা ভেজাল চিহ্নিত হওয়ার পরেই উপযুক্ত সরকারি সংস্থা দায়ী প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে, সেটাই স্বাভাবিক প্রত্যাশা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সরকারি সংস্থার দ্বারা খাদ্যে দুর্নীতি চিহ্নিত হওয়া এবং তা সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হওয়া এবং এরপর হাইকোর্ট হস্তক্ষেপ করার পরেও পরিস্থিতি একই রকম থাকছে। এর ফলে ভোক্তাদের মধ্যে হতাশা, এমনকি অসহায়ত্ববোধ আরও তীব্র হওয়া স্বাভাবিক।

আমরা আশা করব, ভেজাল খাদ্যপণ্য কার্যকরভাবে প্রত্যাহার করে এবং দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে সরকার একটি অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। তবে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দাবি করেছে, তাদের পণ্যের মান যথাযথ রয়েছে এবং এ ব্যাপারে কিছু সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যাও দিয়েছে। তারা বিএসটিআইয়ের পরীক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। আমরা মনে করি, এর একটি যথাযথ সুরাহা হওয়া প্রয়োজন।

দেশে সুশাসন ও আইনের শাসন যে একটা নড়বড়ে অবস্থায় আছে, তার একটি নজির তৈরি হলো এবারের এই ঘটনায়। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) প্রতিষ্ঠাই করা হয়েছিল জনস্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি চিহ্নিত করতে। তাদেরই পরীক্ষায় ৫২টি পণ্যের নিম্নমান প্রমাণিত হয়। এমন নয় যে দেশে ভেজাল খাদ্য উৎপাদন ও কেনাবেচা বন্ধ করার দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রীয় সংস্থার অভাব রয়েছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারই ভোক্তা অধিকার আইন প্রণয়ন এবং আলাদাভাবে নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করেছে। বিএসটিআই আদালতে দাবি করেছে, তারা কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে পণ্যগুলোর উৎপাদন বন্ধ রাখতে বলেছে। ২০১৩ সালের নিরাপদ খাদ্য আইনে খাদ্য কর্তৃপক্ষকে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মতো তাৎক্ষণিক ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার দেওয়া হয়েছে। সারা দেশে বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত আছে। কিন্তু তাতে মামলা নেই। এর বড় কারণ খাদ্য কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া ভোক্তা সরাসরি মামলা করতে পারে না।

সরকারের ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরি এর আগে গরুর দুধ-দইয়ে ভেজাল পেয়েছিল। তিন মাস আগে হাইকোর্ট দুধ-দইয়ে অ্যান্টিবায়োটিক, অণুজীব, কীটনাশক ও সিসা পাওয়ার ঘটনা অনুসন্ধান করে জড়িত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নিতে দুদক চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দিয়েছিলেন; দুধ, দই এবং গোখাদ্যে ভেজাল মেশানোর ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। ২০১১ ও ২০১২ সালে হাইকোর্টের দুটি বেঞ্চ মাছ ও ফলমূলে ফরমালিন মেশানোর বিষয়ে কড়া ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। হাইকোর্টের এ ধরনের নির্দেশনার পরে কাগজে-কলমে ‘অগ্রগতি’ যা–ই ঘটুক না কেন, ভোক্তারা যে বাস্তবে তেমন উপকৃত হচ্ছে না, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ কম।

প্রতিবছর রমজানে বা ঈদের আগে ঘটা করে খাদ্যে ভেজাল নিয়ে একটু হইচই হয়, এরপর আবার সুনসান নীরবতা নামে। ১৩ মে পচা-বাসি খাবার রাখায় গুলশান ও বনানীর তিনটি রেস্তোরাঁকে জরিমানা করা এবং নামীদামি পণ্য উৎপাদনকারীরা অভিযুক্ত হওয়ার ঘটনা নির্দেশ করছে যে বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। ২০১৪ সালে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা বলেছিলেন, খাদ্যে ভেজাল রোধে বঙ্গবন্ধুকন্যার ইচ্ছা ও আন্তরিকতাই যথেষ্ট। পাঁচ বছর পরে মনে হয়, তাঁর উক্তিটি প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি।