মোদির আত্মকেন্দ্রিকতায় বিজেপির ক্ষতি

নরেন্দ্র মোদি
নরেন্দ্র মোদি

ভারতের এই নির্বাচনী মৌসুমে একটি কৌতুক বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে যে নরেন্দ্র মোদি ভারতকে কংগ্রেসমুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিভিন্ন সভা–সমাবেশে বারবার তিনি ‘কংগ্রেসমুক্ত ভারত’ গড়ার কথা বলায় বোধ হয় এই কৌতুকের জন্ম। কিন্তু তিনি আসলে এটাকে ‘বিজেপিমুক্ত’ ভারত বানিয়ে ফেলেছেন।

এটা অবশ্যই অতিরঞ্জন। ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) গায়েব হয়ে যায়নি। হারিয়ে যায়নি তার মাতৃসংগঠন ও পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘও (আরএসএস)। বিজেপি ও আরএসএসের কর্মীরা ভারতজুড়ে মোদির অসংখ্য মিছিল–সমাবেশের আয়োজন করেন; ভোটের দিন ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও তাঁরাই প্রধান ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু সব কৌতুকের মতোই মোদির এই কৌতুকেও কিছুটা সত্য আছে এবং ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরেছে। সেটা হলো, নরেন্দ্র মোদির প্রচণ্ড প্রভাব।

নির্বাচনী প্রচারণায় দলের নেতারা সব সময় একটি বড় ভূমিকা পালন করেন এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতা–কর্মীরা আরেক মেয়াদে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তাঁদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নামে ভোট চান। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৪ সালের নির্বাচনের সময় বিজেপির স্লোগান ছিল ‘আবকি বারি, অটল বিহারি’, মানে এবার অটল বিহারির পালা। ২০০৯ সালে কংগ্রেসের প্রার্থীরা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের নামে ভোট চেয়েছিলেন, যদিও তখন সোনিয়া গান্ধী ছিলেন দলের প্রধান নেতা।

কিন্তু একটি সংসদীয় গণতন্ত্রের নির্বাচনে একজন ব্যক্তি সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছেন, এমনটা আগে কদাচিৎ দেখা গেছে। নির্বাচনী প্রচারণায় নরেন্দ্র মোদির, আমি, আমাকে ও আমার বলাটা এর পেছনে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। তাঁর বক্তব্যের মধ্যে বিজেপির অন্য কোনো নেতার নাম থাকে না, স্থানীয় কোনো প্রার্থীর নামও থাকে না, এমনকি তাঁর দলের নামেরও কোনো উল্লেখ থাকে না। শুধু বিজেপির প্রতীক ‘পদ্ম’ শোভা পায়। হয়তো সেখানেও কয় দিন পর নরেন্দ্র মোদির মুখ দেখা যাবে।

নিজেকে অতি ক্ষমতাবান বলে ভাবার কারণে তিনি কখনো তাঁর দলের প্রার্থীর জন্য ভোট চান না। তিনি সব সময় কেবল নরেন্দ্র মোদির জন্য ভোট চান।

নির্বাচন যখন শেষ পর্বে প্রবেশ করছে, তখন এটা স্পষ্ট হয়েছে যে মোদির এই কৌশল কাজ করেছে। এই নির্বাচনকে ‘প্রেসিডেনশিয়াল ইলেকশন’ বললেও কম বলা হবে; এটা যেন নরেদ্র মোদিকে নিয়ে গণভোটে পরিণত হয়েছে। ভোটাররা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছেন, এক পক্ষ হচ্ছে যাঁরা মোদির প্রশংসা করেন এবং অপর পক্ষ হচ্ছে যাঁরা তাঁকে পছন্দ করেন না। মোদির প্রশংসাকারীদের মতে, তিনি একজন ত্রাণকর্তা ও শক্তিশালী নেতা, যিনি ভারতকে গর্বিত করেছেন এবং দেশের ভেতরে ও বাইরে তার ‘শত্রুদের’ হাত থেকে নিরাপদ রেখেছেন। মোদিকে যাঁরা পছন্দ করেন না তাঁদের মতে, তিনি মানুষের জীবন, জীবিকা, প্রতিষ্ঠান এবং মূল্যবোধের ধ্বংসকারী এবং ভারতকে আরও বিভ্রান্তি ও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য তাঁকে আরেকটি মেয়াদের জন্য প্রত্যাখ্যান করা জরুরি।

গত পাঁচ বছরে নিজেকে ক্ষমতাবান ব্যক্তিত্বে পরিণত করার প্রক্রিয়াতে মোদি তাঁর নিজের দলের গুরুত্বকেও ধীরে ধীরে কমিয়ে দিয়েছেন। দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে সাংবাদিকদের করা প্রতিবেদন একই রকম তথ্য তুলে ধরে। সবখানে ভোটারদের একটাই কথা, দল কোনো ব্যাপার নয়, প্রার্থী কোনো ব্যাপার নয়, তাঁরা কেবল মোদিকে ভোট দিচ্ছেন। প্রায়ই তাঁরা কোনো বিজেপির প্রার্থীর নাম বলতে পারেন না। তবে এটা ঠিক যে কোনো বিজেপির প্রার্থী বা স্থানীয় নেতা এখন এ নিয়ে অভিযোগ করছেন না। তাঁদের সেটা করার কোনো কারণ নেই। আসলে তাঁরা নির্বাচনী প্রচারণা নিয়ে খুব একটা ভাবেননি। কারণ, তাঁরা জানেন যে তাঁদের জয় বা পরাজয় সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করছে নরেন্দ্র মোদির ওপর। তাঁরা ইতিহাসের এই শিক্ষা বিস্মৃত হয়েছেন, যে সংসদীয় গণতন্ত্রে কোনো রাজনৈতিক দলের নেতার প্রতি অতি ভক্তি, সেই রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক শক্তিকে দুর্বল করে দেয় এবং ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন করে ফেলে। আর এটা বিরোধীদের নিজেদের দলগুলোকে গণতান্ত্রিক করার সুযোগ করে দেয়।

অনেকে নরেন্দ্র মোদিকে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তুলনা করেন। এটা ঠিক নয়। তাঁর অনেক ভুলত্রুটি সত্ত্বেও ইন্দিরা গান্ধী নিজের মর্যাদা বজায় রেখেছিলেন। তিনি কখনোই মোদির মতো আত্মপ্রচারে নামেননি।

তবু নির্বাচনসংক্রান্ত যেকোনো আলোচনায় ইন্দিরা গান্ধীর নাম চলে আসে। তিনিই একমাত্র নেতা, মোদির সমর্থকেরা যাঁকে ‘স্ট্রং লিডার’ বলে প্রায়ই প্রকাশ্যেই প্রশংসা করেন।

যদিও ইন্দিরা গান্ধীর ব্যক্তিত্ব ও রাজনীতি উভয় ক্ষেত্রেই মোদির চেয়ে আলাদা ছিল, তবু তিনি বহু বছর ধরে নিজের দলের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিলেন। সেটা কংগ্রেসের জন্য ক্ষতিকর হয়েছিল।

যাহোক, ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর মোদি তাঁর নিজ দলের নেতাদের নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছেন। এখন এটা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই নির্বাচনে তিনি সফল বা ব্যর্থ যা–ই হন না কেন, এটা সত্যি যে তিনি এই নির্বাচনকে একেবারেই মোদিকেন্দ্রিক বিষয়ে পরিণত করার মধ্য দিয়ে বিজেপিকে দুর্বল করেছেন এবং তাঁর প্রার্থীদের অনাবশ্যক করে ফেলেছেন।

দ্য টেলিগ্রাফ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
মানিনী চট্টোপাধ্যায়: ভারতীয় সাংবাদিক ও লেখক