বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

নব্বইয়ের দশকের শুরুতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যখন ক্রমবর্ধমান শিক্ষার্থীদের জায়গা দিতে পারছিল না, তখনই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়টি সামনে চলে আসে। ১৯৯২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হলে জনগণের মধ্যে এই আশাবাদ সৃষ্টি হয় যে এখন আর উচ্চশিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের বিদেশমুখী হতে হবে না, দেশের ভেতরেই মানসম্পন্ন শিক্ষা পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। প্রথম দিকে যেসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, তার অধিকাংশই মানসম্পন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেদের ভাবমূর্তি তুলে ধরতে পেরেছিল। আবার কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয় শুরুতে সনদ-বাণিজ্য শুরু করেছিল, যা কঠোর হাতে বন্ধ করতে পারলে হয়তো বেসরকারি উচ্চশিক্ষার এমন দুর্দশা হতো না।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ১০৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালু আছে এবং সেখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা সাড়ে তিন লাখের মতো। শিক্ষাবিদদের মতে, ১০৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে গোটা বিশেক মোটামুটি মান বজায় রেখে চলেছে, যদিও সবাই স্থায়ী ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠার কাজ এখনো শেষ করতে পারেনি। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খুব বেশি হলে ৬০ হাজার শিক্ষার্থী আছেন। তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, অন্যরা কী ধরনের শিক্ষা পাচ্ছেন? সেই চিত্র উঠে এসেছে সম্প্রতি প্রথম আলোয় প্রকাশিত দুই কিস্তির প্রতিবেদনে।

তথ্য-উপাত্তে দেখা যায়, সাম্প্রতিক কালে অনুমোদন পাওয়া কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই আইনকানুনের তোয়াক্কা করছে না। অধিকাংশ চলছে খেয়ালখুশিমতো। প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, বিএনপি সরকারের আমলে ৩৪টি এবং আওয়ামী লীগ সরকারের তিন আমলে ৬৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পেয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগের মালিক সরকারি দলের নেতা, সাংসদ, মন্ত্রী বা সাবেক মন্ত্রী। এ ছাড়া সরকারি দলের আস্থাভাজন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ব্যবসায়ীও আছেন। দলীয় লোক হলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন না, এ রকম কোনো কথা নেই। কিন্তু দেখার বিষয় হলো, সেই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে আইন ও বিধিমালা মানছে কি না। ইউজিসির শর্ত পূরণ করছে কি না।

ইউজিসির সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান বলেছেন, অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ও বিধিমালা মানছে না। এ পরিস্থিতিতে শিক্ষার নামে যা হচ্ছে, তা শিক্ষাব্যবসা তথা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতারণা ছাড়া কিছু নয়। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় চলছে ভাড়া বাড়িতে, কোনোটিতে অনেক বিভাগে স্থায়ী ফ্যাকাল্টি নেই। আবার কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চার বছর চলছে উপাচার্য ছাড়াই। এভাবে উচ্চশিক্ষার নামে যাঁরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতারণা করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় তো শুধু সনদ বিতরণের প্রতিষ্ঠান নয়। বিশ্ববিদ্যালয়কে একই সঙ্গে জ্ঞান বিতরণ ও জ্ঞান সৃষ্টি করতে হয়। আর জ্ঞান সৃষ্টির উপায় হলো গবেষণা। কিন্তু বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার সুযোগই নেই। যেখানে স্থায়ী শিক্ষক নেই, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও শিক্ষা সরঞ্জাম নেই, সেখানে শিক্ষা গবেষণা কীভাবে হবে।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ব্যতিক্রম ছাড়া বেশির ভাগ বেসরকারি উচ্চশিক্ষালয়ই চলছে জোড়াতালি দিয়ে। জোড়াতালি দিয়ে যা হয় সেটি শিক্ষা নয়, সনদ বিতরণ। এই প্রেক্ষাপটে সরকারের কাছে আমাদের দাবি, একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠনের মাধ্যমে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ, অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়গুলো তদন্ত করা হোক। তবে শুধু তদন্ত করলেই হবে না, যেসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনকানুন মানছে না এবং শিক্ষার ন্যূনতম মান রক্ষা করতে পারছে না, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। উচ্চশিক্ষার নামে সনদ বিক্রি অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের উচিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির বিষয়ে সচেতন হওয়া; মানসম্পন্ন শিক্ষাদান না করে সনদ বিক্রিতে লিপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এড়িয়ে চলা।