তৃতীয় ধাঁধাটির উত্তর কে মেলাবে?

‘কানাডার মতো অর্থনীতি’র দেশ ছেড়ে তরুণেরা ভূমধ্যসাগরে মরে কেন

এ মাসে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রথম ধাপ শুরু হওয়ার কথা। এ বছর শিক্ষক হতে চাওয়া প্রার্থী ২৪ লাখ। নেওয়া হবে ১৩ হাজার মতো। প্রতিটি পদের বিপরীতে প্রতিযোগী ১৮৫ জন।

একই সময়ে প্রচারমাধ্যমে খবর এসেছে, ৪০তম বিসিএসে প্রতিটি পদের জন্য প্রতিযোগী ২১৬ জন। দুই হাজারেরও কম পদের জন্য চার লাখের ওপর গ্র্যাজুয়েট আবেদন করেছেন।

একটি পদের জন্য ২০০ থেকে ৩০০ জনের এই যে প্রতিযোগিতা, তা তরুণ-তরুণীদের জন্য চরম এক মানসিক নির্যাতনেরও মতোই। চাকরির বাজার যে কত খারাপ, কত তীব্র এবং কত হতাশাজনক, তারই চুম্বক ইঙ্গিত পাওয়া যায় ওপরের সাম্প্রতিক দুটি নিয়োগপ্রক্রিয়া থেকে।

গত বছর জুনে শেষ হওয়া ৩৭তম বিসিএসের নিয়োগপ্রক্রিয়ার শুরুতে প্রার্থী ছিলেন ২ লাখ ৪৩ হাজার। পরের বিসিএসে প্রার্থী বেড়ে দাঁড়ায় ৩ লাখ ৪৬ হাজারে। ৩৯তমটি ছিল একটা বিশেষ বিসিএস। দেখা যাচ্ছে, ৩৭ ও ৪০তম বিসিএসে প্রার্থী সংখ্যার ফারাক প্রায় ১ লাখ ৬৯ হাজার। শতকরা বৃদ্ধি ৭০ ভাগ। মাত্র দুই থেকে তিন বছরে কর্মপ্রত্যাশী গ্র্যাজুয়েটদের এ রকম সংখ্যাগত উল্লম্ফন উদ্বেগজন বৈকি।

একই সময়ে মে মাসেই খবর বের হলো, বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ গত বছরের চেয়েও ৬৮ শতাংশ বেড়েছে। এও বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ এটা।

একদিকে রেকর্ড পরিমাণ বিনিয়োগ, ফুলে ওঠা রিজার্ভ, আরেক দিকে কর্মপ্রত্যাশীদের উল্লম্ফন। বিপরীতমুখী দুই দৃশ্য। চলতি বাংলাদেশের প্রধান প্রহেলিকা এটা। কেন ‘কানাডার মতো অর্থনীতি’র দেশটি ছেড়ে তরুণেরা চাকরি খুঁজতে গিয়ে ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরছে, তার উত্তর মেলানো সত্যি কঠিন।

অতীতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান না বাড়ার কারণ হিসেবে রাজনৈতিক অস্থিরতাকে দায়ী করা হতো। দেশে এখন শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র—কোনো রাজনীতিই প্রায় নেই। রাজনৈতিক পরিমণ্ডল বহু দিন থেকে পূর্ণ শান্ত। শান্তিতে ব্যবসা না করতে পারার পুরোনো বাণিজ্যিক অজুহাত এখন আর সামান্যতমও অবশিষ্ট নেই। যে সেক্টরে কর্মজীবীদের যা দেওয়া হচ্ছে, তাঁরা সেটাই মুখ বুজে মেনে নিচ্ছেন। এ রকম মালিকবান্ধব কর্মপরিবেশ বিশ্বজুড়ে বিরল। ফলে, বিনিয়োগ হচ্ছে। বিনিয়োগ আসছেও। জিডিপি বাড়ছে। মাথাপিছু আয় বাড়ছে। বাজেটের আকার বাড়ছে। ব্যাংক বাড়ছে। ভবন বাড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয় বাড়ছে। রিজার্ভ বাড়ছে। অর্থনীতি নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সব আলোচনায় প্রবৃদ্ধির গল্প সামনে থাকছে। কিন্তু তরুণ-তরুণীদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক খাতগুলোতে চাকরি বাড়ছে না। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের বাইরে শ্রমঘন নতুন খাতের দেখা মিলছে না। তরুণ-তরুণীরা যে হারে চাকরি খুঁজছেন, সে হারে কাজের সুযোগ নেই। কোথায় যেন মাঠপর্যায়ে রাষ্ট্রীয় নীতিসহায়তার একটা ঘাটতি পড়েছে। সামনের দিনগুলো তাই যুবসমাজের সামনে অনিশ্চয়তায় মোড়ানো। তাদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়াদের মধ্যে বাড়ছে আত্মহত্যার হার। রুটিরুজির সংগ্রামে মফস্বল থেকে তরুণেরা এখন ইরাক, লিবিয়ার যুদ্ধাক্রান্ত দেশেও পাড়ি দিতে দ্বিধাহীন।

একসময় শোনা যেত, ব্যাংকে অলস অর্থ পড়ে আছে, বিনিয়োগ হচ্ছে না। এখন সংবাদ প্রকাশিত হয়, অর্থ বাইরে চলে যাচ্ছে। তরুণ-তরুণীদের জন্য কাজের ক্ষেত্র তৈরি হবে কীভাবে তাহলে?

জাতীয় পরিসরে এসব নিয়ে আলাপ-আলোচনা নেই। কেন কথিত প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশিত মাত্রায় চাকরি তৈরি করছে না—চলিত সময়ের সবচেয়ে জরুরি এই ধাঁধার উত্তর মিলাতে আগ্রহী নয় অনেকেই। অথচ পার্শ্ববর্তী ভারতে চলমান নির্বাচনে প্রধান এক ইস্যু হয়ে উঠেছিল কাজের প্রশ্নটি।

দেশে স্বাস্থ্যকর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় কর্মসংস্থান বিষয়ে রাজনীতিবিদদের মধ্যে দায়বদ্ধতার বোধ ও সৃজনশীল উদ্যোগেও এসেছে চরম খরা। সাম্প্রতিক প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলোয় আবেদনকারীর সংখ্যা এত বেশি যে শতকরা ১ ভাগও এখন আর চাকরি পাচ্ছে না। প্রশ্ন হলো, বাকিরা যাবে কোথায়?

বাংলাদেশের শান্ত সভ্যতা সমাজবিজ্ঞানের অসাধারণ এক ধাঁধা
বাজারমুখী অর্থনীতিতে কাজের সুযোগ তৈরি হয় মুখ্যত বেসরকারি খাতে। কিন্তু রাজনীতির দীর্ঘ ছায়া পড়লে বেসরকারি খাতও সাবলীলতা হারায়। সেখানে মুনাফা এখন যতটা বহির্মুখী,Ñততটা বিনিয়োগমুখী নয়। সরকারের কৌশলগত বিনিয়োগই সচরাচর বেসরকারি খাতকে বিনিয়োগে টানে। এভাবেই কর্মসংস্থান বাড়ে। বাংলাদেশে তেমন ঘটছে না। কেন ঘটছে না, সেটাই বড় ধাঁধা।

রাজনীতিবিদেরা এসব প্রশ্নে নিশ্চুপ। টিভি টক শোতে এসব কখনো বিষয় হয়ে ওঠে না। প্রহেলিকার ভেতরে ঢুকতে চাইছে না কেউই।

দেশের একজন জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ স্বপন আদনান এই প্রহেলিকার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ভারতে তাঁর গবেষণার উদাহরণ টেনে বলেন, বিনিয়োগ যা আসছে, তা যতটা উচ্চ প্রযুক্তিবান্ধব, ঠিক ততটাই কম কর্মজীবীনির্ভর। বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় থাকতে উদ্যোক্তারা কম খরচে ভালো মানের পণ্য তৈরি করার দিকে ঝুঁকছে। সবাই সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে যাচ্ছে। এ রকম বিনিয়োগকারীদের যে ধরনের মানবসম্পদ দরকার, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তার জোগান দিতে পারছে না। চলতি শিক্ষাকাঠামো থেকে প্রয়োজনীয় কাজের দক্ষ লোক মিলছে না। পুরোনো সিলেবাস, ক্লাসরুম ও মুখস্থনির্ভরতার ভেতর দিয়ে যে তরুণ-তরুণী বের হচ্ছেন, তাঁরা কর্মজগতের প্রতিমুহূর্তের অপ্রত্যাশিত সমস্যার সমাধান দিতে অপ্রস্তুত। ফলে, ‘চাকরি’ যা তৈরি হচ্ছে, তার বড় এক অংশ পূরণ হচ্ছে বিদেশিদের দ্বারা। স্থানীয় স্নাতকেরা অগ্রাধিকার হারাচ্ছেন। উচ্চ বিনিয়োগের মধ্যেও চাকরির বাজারটি দেশীয় জন্য সংকুচিতই থাকছে। স্বপন আদনান চলতি বইনির্ভর প্রশ্ন-উত্তর পদ্ধতির শিক্ষাকাঠামোর খোলনলচে বদলে তাকে গবেষণা ও আলোচনা-পর্যালোচনামূলক করার তাগিদ দেন। তাঁর বিবেচনায় আমাদের উচ্চশিক্ষাকাঠামো পদ্ধতিগতভাবে অদক্ষ জনবল তৈরি করছে। অথচ অর্থনীতির একটি বড় অভিমুখ হচ্ছে উচ্চ প্রযুক্তিনির্ভরতা। তবে কর্মহীনতার পেছনে এটাই একমাত্র কারণ নয়। কর্মসংস্থান সংকটের আরেক গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে স্বপন আদনান অনুৎপাদনশীল পুঁজির প্রাধান্যকেও চিহ্নিত করতে আগ্রহী। তাঁর মতে, এই পুঁজি পাটিগণিতের হিসাবে জিডিপি বাড়ায় বটে, মজুরি শ্রমিকের সুযোগ ও সংখ্যা বাড়ায় না।

অবস্থাটা সমাজের জন্য বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ। দীর্ঘ মেয়াদে সমাজের বিপুল মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমছে, যা দেশীয় উৎপাদকদের সম্ভাবনা সংকুচিত করবে। আবার সমাজবিজ্ঞানে তাত্ত্বিকভাবে অন্তত মনে করা হয়, কোনো দেশে তরুণেরা যখন মোটাদাগে বেকারিতে ভোগেন, সেই সমাজে অস্থিরতা বাড়ে। রাজনীতি ও রাষ্ট্রনৈতিক পরিসরেও ছাপ পড়ে তার। কিন্তু সে রকম কোনো প্রকাশ্য অস্থিরতাও নেই এখানে। যাকে বলা যায় বাংলাদেশের সমাজের ‘দ্বিতীয় ধাঁধা’। রাজনীতি এখানে শান্ত, সমাজ এখানে নিশ্চুপ। কর্মসংস্থান নেই, ভবিষ্যৎ অস্পষ্ট; কিন্তু তরুণেরা শান্ত ও নমনীয়ই আছেন। নিজেদের অংশগ্রহণহীন উন্নয়নেও সবাইকে সন্তুষ্টই মনে হয়।

সমাজবিজ্ঞানের জন্য ব্যতিক্রমী এই দৃষ্টান্তের ব্যাখ্যা কী? স্বপন আদনানের কাছে এ বিষয়েও জানতে চেয়েছি। মানুষকে ‘সিস্টেম’-এর সঙ্গে রাখার নানান উদ্যোগের বিবরণ দিলেন তিনি। তাঁর ভাষায়, ‘অফিসগুলোয় কোনো এক ব্যক্তি দুর্নীতি করে—এমন নেই আর। হয়তো দুর্নীতির অর্থ একজনের হাতেই দিতে হয়। কিন্তু পুরো ব্যবস্থাপনায় সেটা বণ্টিত হয়। সামগ্রিক একটা বণ্টনকাঠামো এভাবে সব স্তরে প্রাতিষ্ঠানিকতা পেয়েছে। ফলে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কেউ দাঁড়ালে তাকে থামানো হবে এখন সবাই মিলে।’

অসৎ সিস্টেম সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষকে প্রতিনিয়ত ‘কো-অপ্ট’ করে নিচ্ছে। ট্রেড ইউনিয়ন নেতা থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধি সবাই ‘কো-অপ্ট হওয়া’কে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এটা একটা পশুবৎ সমাজের লক্ষণ। কিন্তু এটাই ‘শহরের নিয়ম এখন’। ‘সিস্টেম’-এর পক্ষে বিশাল এক মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রিও কাজ করছে। যারা সমাজের মূল সংকট থেকে মানুষকে খেলাধুলার উত্তেজনায়, শো-বিজনেসের আকর্ষণে, টিভি সিরিয়ালের মোহে মুগ্ধ রাখতে তৎপর। ‘কো-অপশন’ এবং ‘মুগ্ধ রাখা’র মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ‘উুঁচতলা’ এমন এক শান্ত সভ্যতার জন্ম দিয়েছে, সমাজবিজ্ঞানের জন্য যা অসাধারণ প্রহেলিকা।

সমাজ-পরিসরের এই দ্বিতীয় ধাঁধা এবং স্থানীয় অর্থনীতির প্রথম ধাঁধা মিলে তৃতীয় আরেক প্রহেলিকাও অনিবার্যভাবে সামনে আসছে। তা হলো, কর্মহীনতা ও উদ্যোক্তাহীন একটি নিশ্চুপ ‘সমাজ’ শেষ বিচারে কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়? একটি দেশ যখন শিক্ষিত সমাজকে দেশ গঠনে ধারণ করতে পারে না, জনগণ যখন সাদাকে সাদা না বলার শিক্ষা আত্মস্থ করাকে প্রয়োজনবিদ্যা বানিয়ে নেয়, তখন সেই দেশের জন্য মহাকালের দরবারে কী পরিণতি অপেক্ষা করে? তৃতীয় এই ধাঁধার উত্তর খোঁজার মতো সময় ও সাহস কার কার আছে? কিন্তু ইতিমধ্যে দেশের অনেক ‘খ্যাতনামা’ প্রচারমাধ্যম আক্ষেপের সঙ্গে নিজেদের অপাঙ্‌ক্তেয় অবস্থায় দেখছে। কতিপয়তন্ত্রের ‘সমাজ’-এ তাদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে।

অল্প কিছু ক্ষমতাশালীর হাতে সম্পদ ও কর্তৃত্বের পুঞ্জীভবনকে পাহারা দিতে থাকলে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো এভাবে ক্রমে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় কি না, সেই উদ্বেগ জমছে ও বাড়ছে।

আলতাফ পারভেজ: গবেষক