আসামে হিংসার বিষবৃক্ষ

আসাম নিয়ে যেকোনো আলোচনা শুরু হলেই অবধারিতভাবে নাগরিকপঞ্জি ও ডি ভোটার প্রসঙ্গ আসবেই। স্বাভাবিক। ইউরোপে এমন অনেক ছোট দেশ আছে, যার পুরো জনসংখ্যার চেয়ে বহুগুণ বেশি লোক আসামের এনআরসি তালিকা থেকে পুরোপুরি বাদ গেছেন। এ মুহূর্তে সংখ্যাটা চমকে দেওয়ার মতো—৪০ লাখ।

যেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে এই ৪০ লাখ লোককে না-নাগরিক বলে চিহ্নিত করে তাঁদের সম্পূর্ণ অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া হলো, ঘটনাচক্রে আমি তখন করিমগঞ্জে। ঘোষণা করা হয়েছিল আগেই, ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই নাগরিক তালিকা চূড়ান্ত করে জানিয়ে দেওয়া হবে কত মানুষ আদতে ভারতের নাগরিক নন; বিদেশি অনুপ্রবেশকারী। আসামে হিন্দুত্ববাদী বিভিন্ন সংগঠন দীর্ঘ সময় ধরে বলে আসছে, আসামের জেলায় জেলায় লাখো বিদেশি ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁদের দেশ থেকে না তাড়ালে আসামের সামাজিক কাঠামো ধ্বংস হয়ে যাবে। বিদেশি হটাও—এই দাবি সামনে রেখে ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৫ সাল অবধি অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন, সংক্ষেপে আসু রাজ্য জুড়ে যে ভয়ংকর রক্তক্ষয়ী তাণ্ডব চালিয়েছিল, তার পরিণামেই আজকের এই কয়েক লাখ সাধারণ মানুষের বিপন্ন হওয়া। গোয়েবেলসের তত্ত্ব আজও কত শক্তিশালী, তার বড় উদাহরণ আসামের ছাত্র আন্দোলন। চূড়ান্ত দক্ষিণপন্থী এই রাজনীতির বর্শামুখ বলা বাহুল্য ছিল বাঙালি। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে।

‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলনের প্রবক্তাদের উত্থাপিত ‘বিদেশি’ সংখ্যা সেনসেক্সের মতো প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল। এক-একদিন একেক স্বঘোষিত নেতা একেক রকম শোনাচ্ছিলেন। কেউ বললেন, ২০ লাখ। পরের দিন শোনা গেল সংখ্যা ৩০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এইভাবে গল্পের গরু গাছে উঠতে উঠতে একসময় সংখ্যা ৯০ লাখ পেরিয়ে গেল। অর্থাৎ আসামের তিনজন নাগরিকের মধ্যে অন্তত একজন বিদেশি। সর্বনাশ থেকে বাঁচতে আসু নিদান দিল এই অনুপ্রবেশকারীদের অবিলম্বে পুশব্যাক করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিতে হবে। কখনো কখনো এই ‘মহৎ’ কাজটি আসুর ভলান্টিয়াররা নিজেরাই করতে লাগলেন। হিন্দু-মুসলিমনির্বিশেষে অনেক বাঙালিকে তারা নো ম্যানস ল্যান্ডে ছুড়ে ফেলে দিয়ে এলেন। শুধু আসু বা তাঁদের সমর্থক মিডিয়া, বুদ্ধিজীবী, অসমিয়া জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ কেন, সরকার ও প্রশাসনের এক প্রভাবশালী গোষ্ঠীও বাঙালিবিরোধী এই গাজাভিত্তিক ষড়যন্ত্রে অনৈতিকভাবে শামিল হয়েছিল, যা পরিস্থিতি আরও জটিল আরও ঘোরালো করে তুলেছিল।

এর পেছনে আছে অদ্ভুত এক মনস্তাত্ত্বিক ব্যাধি। সরকারের এবং তাদের উচ্চপদস্থ আমলাদের গুজবে বাঙালি, বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানবিদ্বেষ ছড়ানোয় ইন্ধন জোগানোর বিষয়টি । ছয় বছর ধরে আসু আন্দোলন স্রেফ গুজবের ওপর ভিত্তি করে যে হিস্টিরিয়ার জন্ম দিয়েছিল, তার পরিণতিতে একের পর এক জায়গায় গণহত্যা হয়েছে। প্রাণ হারিয়েছেন অসংখ্য নিরীহ মানুষ। ১৯৮৫ সাল আসামের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আসু ও তাঁদের সহযোগী সংগঠন গণসংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে তৎকালীন কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারের এক চুক্তি হলো। বলা হলো, ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ মাঝ রাতের পর যাঁরাই আসামে ঢুকেছেন, তাঁদের বিন্দুমাত্র সহানুভূতি না দেখিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। এক ‘বিদেশি’ আদালত তৈরি করে সেখানে সন্দেহভাজন বিদেশিদের বিচার হবে। চুক্তির পরপরই আসুর বিদেশি ঘৃণা সম্বল করে জন্ম নিল নতুন উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল অসম গণপরিষদ (অগপ)।

মেরুকরণের রাজনীতির মধ্যে দিয়ে সে বছর নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এল দক্ষিণপন্থী অগপ। পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার সময় স্বাভাবিকভাবেই তাদের মুখ্য কাজ ছিল জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুত ‘৯০ লাখ’ বিদেশি খুঁজে বের করে সবাইকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো। কিন্তু ওই কথায় আছে, যত গর্জে তত বর্ষে না। গুজব টুজব তো ক্ষমতা দখলের লোভে। পাঁচ বছর পর এত কাণ্ড করে মেরে-কেটে ৯ হাজারের কাছাকাছি ‘বিদেশি’ খুঁজে বের করা হলো।

গ্যাস বেলুন ফেটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরের নির্বাচনে অগপ শোচনীয়ভাবে কংগ্রেসের কাছে হেরে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিল। বলা যায়, এখানেই আসু অধ্যায়ের প্রথম পর্ব শেষ। কিন্তু আসু বিভাজনের যে বিষের চারা তারা পুঁতল তা ক্রমে ক্রমেই মহিরুহ হয়ে আসামকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

যুদ্ধই বটে। এনআরসির ফাইনাল তালিকায় নাম আছে কি নেই জানার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে করিমগঞ্জ। গত বছরের জুলাই ৩১। সীমান্ত লাগোয়া শহর নিঝুম। জনজীবন কেমন মন্থর গতিতে এগোচ্ছে। রাত নামতে না নামতেই অন্ধকার গভীরভাবে নেমে এসেছে। শব্দ করে সাঁজোয়া বাহিনীর আর্মাডা ছুটে চলেছে। রাস্তায় রাস্তায় রুট মার্চ করছে আধাসামরিক বাহিনীর জওয়ানেরা। শূন্য রাস্তা। সারা শহরে অঘোষিত কারফিউ। নিজের নাগরিকদের বিরুদ্ধেই বিদেশি সন্দেহে যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে সরকার। দেশের মধ্যে আর এক দেশ দেখতে হলে আপনাকে নিশ্চিত একবার আসামে যেতে হবে। পরের দিনদুপুরের মধ্যে জানা হয়ে গেল, ৪০ লাখ লোক আর ভারতের নাগরিক নন। গ্রামে, শহরে সাধারণ মানুষের চোখে জল। যাঁদের নাম তালিকায় উঠেছে, তারা কাঁদছেন আনন্দে। এরপর অন্তত তাঁদের দিকে, সন্তান, প্রিয়জনদের কেউ বিদেশি বলে বাঁকা চোখে তাকাবে না। আর অন্যেরা ভেঙে পড়েছে আইন-কানুনের মারপ্যাঁচে কলমের এক খোঁচায় নিজ বাসভূমে মুহূর্তে পরবাসী হওয়ার যন্ত্রণা ও অপমানে।

দিনের পর দিন এই যন্ত্রণা বিধ্বস্ত আসামকে দেখা এক অন্য অভিজ্ঞতা। আমরা যখন নাগরিকত্ব বাতিলের কথা বলি, তখন সরকারি আমলাদের মতোই স্রেফ সংখ্যার হিসাব-নিকাশ করি। ব্যক্তিজীবনের হাহাকার শুনতে পাই না। আসামের বিস্তীর্ণ এলাকায় ঘুরতে ঘুরতে মহল্লায়-বস্তিতে, গ্রামে-শহরে এই ভেঙে পড়া বিষণ্ন আসামকে খুঁজে পাবেন। বিপুলসংখ্যক মানুষ, যাঁরা নব্বই শতাংশ গরিবস্য গরিব, যেদিন ‘বিদেশি’ হয়ে গেলেন, সেদিন গৌহাটির দপ্তরে বসে আনন্দে মিষ্টি বিতরণ করতে লাগলেন আসু নেতারা । যাঁদের দাবি এত দিন বাদে রাষ্ট্রের মান্যতা পাওয়ার আনন্দে।

একই শহরে একদল কাঁদছে সর্বস্বান্ত হওয়ার ব্যথায়, অন্য দল আনন্দে উদ্বেল সহনাগরিকদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করতে পেরে। এই বিরল দৃশ্যও আপনি আসাম ছাড়া আর কোথাও পাবেন না।

এ আসামের সঙ্গে অদ্ভুত সাদৃশ্য পাবেন ফিলিস্তিন, গাজার। সাবেক অধিবাসীদের তাড়িয়ে ১৯৪৮ সালে যেমন নতুন জাতিরাষ্ট্র ইসরায়েল জন্মেছিল স্থানীয় জনতার ন্যায্য অধিকার কেড়ে নিয়ে, তেমনি আসামেও উগ্র অসমিয়া জাতীয়তাবাদের একাংশ আসাম শুধুই অসমিয়াদের, এই দাবি সামনে রেখে বহু ভাষা, বহু জাতি, বহু সংস্কৃতির আসামকে একমাত্রিক করতে চাইছে গায়ের জোরে। দুঃখ এই অন্যায্য দাবি মান্যতা পাচ্ছে দেশের সরকার, ক্ষমতাসীন দলের কাছ থেকে ।

আসামে বারবার বিদেশি সন্দেহে পরিস্থিতি জটিল করে তোলা হয়েছে । বস্তুত ১৮৭৪-এ তিন জেলা সিলেট, কাছাড় ও গোয়ালপাড়াকে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য ব্রিটিশ ঢাকা ডিভিশন থেকে কেটে আসামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার পর থেকে। বাঙালি অধ্যুষিত তিন জেলা আসামের সঙ্গে এসে যাওয়ার ফলে জনবিন্যাসেরও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটল। বাঙালি মুসলমানের সংখ্যাই ৫ শতাংশ থেকে ২৮ শতাংশের ওপর হয়ে গেল। যে অনুপ্রবেশ নিয়ে আমাদের এখনকার শাসকেরা জলঘোলা করছে, এমনকি মাঝেমধ্যে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত বাজার গরম করছেন যুক্তির ধারেকাছেও না গিয়ে—বলতে বাধ্য হচ্ছি, তাঁরা হয় আসামের ইতিহাস জানেন না, নয় ইচ্ছে করে আসল ইতিহাস চেপে রেখে অসত্য কথা বলে দেশের একটি প্রদেশের ভাষিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে কার্যত এক অসম অঘোষিত যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছেন। একদিকে রাষ্ট্র, সরকার, আইন, পুলিশ প্রশাসন সবাই, অন্যদিকে অধিকাংশ গরিব মানুষ।

বাদ দেওয়া ৪০ লাখ লোকের মধ্যে কম করে ৬৫ শতাংশের ওপর মহিলা ও শিশু। এমন ঘটনা ঘটেছে, যেখানে মা-বাবা নাগরিক অথচ শিশুর নাম বাদ গেছে বিদেশি সন্দেহে। অথচ আমাদের রাষ্ট্রনেতাদের না জানার কথা নয় যে আসামে মাইগ্রেশন কোনো নতুন বিষয় নয়। ব্রিটিশ পুঁজির স্বার্থে কখনো রেলপথ বা চা-বাগানের কাজে ইংরেজ সরকার বাইরে থেকে লোক এনেছে। পরে রাজস্ব বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে একদা পূর্ববাংলা থেকে দলে দলে কৃষকদের নিয়ে আসা হয়েছিল আসামের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন বাঙালি মুসলমান ও নিম্ন বর্গের হিন্দু। কয়েক বছরের মধ্যে আসামের অর্থনীতিতে জোয়ার এসেছিল ওই প্রবল পরিশ্রমী কৃষকদের হাত ধরে। সমৃদ্ধ অর্থনীতি জন্ম দিল এক সুবিধাভোগী কায়েমি স্বার্থের। নব্য উত্থিত অসমিয়া জাতীয়তাবাদের একাংশ তখন থেকেই বাঙালিবিদ্বেষী জিগির তুললেন। ১৯১৭-১৮ সাল নাগাদ অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে মেরুকরণের রাজনীতি পা রাখল আসামের মাটি ।

দ্বন্দ্ব নিছক জাতিসত্তার নয়। মূলত সামন্ত বনাম কৃষকদের। শোষিত কৃষকদের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে দেখা দিলেন মাওলানা হামিদ খান ভাসানী। অদ্ভুত এক জাদুকাঠির ছোঁয়ায় লাখো লাখো প্রান্তিক, ভূমিহীন, খেতমজুরকে জাগিয়ে তুললেন ভাসান চরের সামান্য এক মাওলানা। হয়ে উঠলেন ব্রিটিশের চক্ষুশূল। সামন্তদের ত্রাস। ১৯৪৭–এর ভারতভাগের পর আসামের সমাজ রাজনীতি বিপুল বদলে গেল ।অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব পেছনে সরে গিয়ে ধীরে ধীরে উগ্র জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের লড়াই আসামের রাজনীতিতে মুখ্য অনুঘটকের ভূমিকা নিতে লাগল। আজ তা বিজেপির হাত ধরে এক চরম মাত্রায় পৌঁছে আসামকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে । ভয়টা সেখানেই। প্রশ্নটা তাই শুধু এনআরসি বা ডিভোটারের নয়, প্রশ্ন নানা বাহানায় এত এত মানুষকে তাড়িয়ে দেওয়ার আসল মতলব নিয়ে। হতে পারে বিরাটসংখ্যক গরিব হিন্দু-মুসলমানকে কৌশলে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে তাঁদের সস্তা শ্রমকে আপাত-উন্নয়নের নামে কাজে লাগানো। মুক্ত অর্থনীতিতে সস্তা শ্রমিকদের গুরুত্ব অপরিসীম। এ-ও হতে পারে, আন্তর্জাতিক অস্ত্র বাজারের স্বার্থে বা প্রতিবেশী চীনকে চাপে রাখতে কাশ্মীরের পাশাপাশি নতুন এক ওয়ার ফ্রন্ট খোলা। আপাতত সবই অনুমান। নির্বাচনের পর ছবিটা স্পষ্ট হবে।

সৌমিত্র দস্তিদার: ভারতীয় লেখক ও চলচ্চিত্রকার।