৩০ ডিসেম্বরের পরের বাংলাদেশ

গত ৩০ ডিসেম্বর ভোটকেন্দ্রে ভোট দিচ্ছেন এক নারী
গত ৩০ ডিসেম্বর ভোটকেন্দ্রে ভোট দিচ্ছেন এক নারী

৩০ ডিসেম্বর যে নির্বাচনটি হয়েছে, তা আমাদের ইতিহাসে বিরল ও ব্যতিক্রম হয়ে থাকবে। এ রকম নির্বাচন বাংলাদেশের মানুষ আর দ্বিতীয়বার প্রত্যক্ষ করেনি। 
বাংলাদেশে সামরিক শাসন কাঠামোর মধ্যে একাধিক নির্বাচন হয়েছে, পর পর দুই সেনা শাসক নিজেদের অবৈধ শাসনকে জায়েজ করার জন্য গণভোট করেছেন; যাতে শাসক একমাত্র প্রার্থী, আর কেউ প্রার্থী ছিলেন না। এ ধরনের গণভোটের ফলাফল আগেই নির্ধারিত হয়ে থাকে। দুই সেনা শাসক জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ গণভোটে নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেছেন। 
অনেকের মতে, ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামরিক শাসকদের সেই গণভোটকেও হার মানিয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমসসহ অনেক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম নির্বাচনকে প্রহসন বলে অভিহিত করেছে। এমনকি ক্ষমতাসীন জোটের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) অতি উৎসাহী সরকারি কর্মকর্তারা রাতে ব্যালটে সিল মেরে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বলে অভিযোগ এনেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ (টিআইবি) ৫০টি আসনে জরিপ করে নির্বাচনকে ‘অভূতপূর্ব’ ও ‘অবিশ্বাস্য’ বলে অভিহিত করেছে। টিআইবি ৪৭টি সুনির্দিষ্ট অনিয়ম চিহ্নিত করেছে, যার মধ্যে আছে: নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল দেওয়া, প্রতিপক্ষের এজেন্টদের কেন্দ্রে প্রবেশের সুযোগ না দেওয়া। অনেক ভোটারের ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না পারা, বুথ দখল করে প্রকাশ্যে সিল মারা, জোর করে নির্দিষ্ট মার্কায় ভোট দিতে বাধ্য করা, ভোট শুরুর আগে ব্যালট ভর্তি বাক্স, ভোট শেষের আগে ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যাওয়া, গণমাধ্যমের জন্য ‘অভূতপূর্ব’ কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। 
৩০ ডিসেম্বর ২৯৯টি আসনে নির্বাচন হয়। একজন প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে গাইবান্ধার একটি আসনে সেদিন নির্বাচন হতে পারেনি। 
ভোটগ্রহণের আগের পরিবেশও বিরোধী দলের জন্য বিপজ্জনক ছিল। গায়েবি মামলায় বিরোধী দলের অনেক নেতা-কর্মী পালিয়ে বেড়িয়েছেন। প্রার্থীরা পদে পদে হয়রানির শিকার হয়েছেন। বেশির ভাগ আসনে বিরোধী দলের প্রার্থীকে প্রচার কাজ করতে দেওয়া হয়নি। 
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত এগারোটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে। এর মধ্যে দলীয় সরকারের অধীনে হয়েছে ১৯৭৩, ১৯৮৮, ১৯৯৬ (১৫ ফেব্রুয়ারি), ২০১৪ ও ২০১৮ সালে। সামরিক শাসনের আমলে নির্বচন হয় ১৯৭৯ ও ১৯৮৬ সালে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় ১৯৯১, ১৯৯৬ ( ১২ জুন), ২০০১ ও ২০০৮ সালে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন ছাড়া কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হয়নি। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়, যাতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২৯৩টি আসনে জয়ী হয়। বিরোধী দল ও স্বতন্ত্ররা পান মাত্র ৭টি আসন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, তিয়াত্তরের নির্বাচন সুষ্ঠু হলেও আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করত। বিরোধী দল খুব বেশি হলে ৩০–৩৫টি আসন পেত। কিন্তু ক্ষমতাসীনেরা অতটুকু ঔদার্য দেখাতে পারেননি। ব্যালট বাক্স হেলিকপ্টারে ঢাকায় এনে গণনা করে খোন্দকার মোশতাক আহমদে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছিল। আর সামরিক শাসনামলে যেসব নির্বাচন হয়েছে, সেগুলো সুষ্ঠু হওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। 
তবে এই দুই সেনা শাসক নিজের ক্ষমতা জায়েজ করতে সংসদ নির্বাচন করলেও চরিত্রগত কিছু পার্থক্য ছিল। ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের আমলে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দল অংশ নিলেও ১৯৮৬ সালে এরশাদের শাসনামলে তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ অধিকাংশ দল বর্জন করে। একই ঘটনা ঘটে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। 
নব্বইয়ের স্বৈরাচারের পতনের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সব দলের অংশগ্রহণে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেছিলেন, আওয়ামী লীগ জয়ী হবে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে জিতেছিল খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে মাত্র ৮৬টি আসন পেয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। এরপর ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আরেকটি নির্বাচন হয়, যে নির্বাচন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামাতে ইসলামীসহ প্রায় সব বিরোধী দল বর্জন করে। এর আগে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৪৭ জন বিরোধীদলীয় সাংসদ পদত্যাগ করেছিলেন। তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন করেন এবং তা মেনে নিতে সরকারকে বাধ্য করেন। বিএনপি একদিনের জন্য সংসদ অধিবেশন ডেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস করে ষষ্ঠ সংসদ ভেঙে দেয়। 
এরপর বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হলেও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয়। ফলে জাতীয় পার্টি ও জাসদ রবকে নিয়ে তাদের ঐকমত্যের সরকার গঠন করতে হয়। ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসে। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন পায়। আওয়ামী লীগ পায় মাত্র ৬২টি আসন। বিএনপি সুষ্ঠু নির্বাচন করে ক্ষমতায় এলেও তাদের পাঁচ বছরের শাসনকাল ছিল খুবই গোলমেলে। এ সময়ে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটে এবং উপর্যুপরি জঙ্গি হানায় বহু মানুষ নিহত হন। 
২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নির্ধারিত ছিল নবম সংসদ নির্বাচন। কিন্তু এর আগেই ভোটার তালিকা ইত্যাদি নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দল রাজপথে সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তোলে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি এম এ আজিজ বিদায় নিতে বাধ্য হন। তদুপরি ইয়াজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষপাতমূলক ভূমিকার কারণে সেই নির্বাচন হতে পারেনি। ১১ জানুয়ারি সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে। সে সময় সেনাবাহিনী প্রথমে তাদের শাসন দীর্ঘস্থায়ী করার পরিকল্পনা নিলেও পরে নির্বাচন দিয়ে দৃশ্যপট থেকে সরে যায়। ২০০৮ সালের ২৯ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে এবং বিএনপির আসনসংখ্যা ৩০-এ নেমে আসে। 
আওয়ামী লীগ সরকার আদালতের দোহাই দিয়ে ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেয়, যা নির্বাচনী রাজনীতিতে গুরুতর সংকটের দিকে ঠেলে দেয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দলীয় সরকারের অধীনে দশম জাতীয় সংসদ হলেও বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট অংশ নেয়নি। নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত ৩৯টি দলের মধ্যে মাত্র ১২টি দল অংশ নেয়। 
সে সময়ে গঠিত সংসদের স্থায়িত্ব নিয়ে দেশি-বিদেশি অনেক বিশেষজ্ঞ সন্দেহ পোষণ করলেও শেখ হাসিনার সরকার পাঁচ বছর মেয়াদ পূরণ করেছে। এর বিরুদ্ধে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট রাজপথে হরতাল-অবরোধ করেও সুবিধা করতে পারেনি। সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হওয়ার পর দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিকল্প ছিল না। ৩০ ডিসেম্বরের আগে বিরোধী দলের সঙ্গে ধারাবাহিক সংলাপে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনটি সুষ্ঠু হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। নির্বাচন কমিশনও ঘোষণা করেছিল, তারা নির্বাচনে কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতি হতে দেবেন না। নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে নির্বাচন পরিচালনা করবে। কিন্তু বাস্তবে তারা যে নির্বাচন করেছে, সেটি দেশ ও জনগণের সঙ্গে মশকরা ছাড়া কিছু নয়। 
পৃথিবীর সব দেশে নির্বাচনের চরিত্র মোটামুটি এক। কিন্তু বাংলাদেশে যে ১১টি সংসদ নির্বাচন হয়েছে, তার প্রতিটির বৈশিষ্ট্য ভিন্ন। দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেনি কেউই। নির্বাচন নিয়ে রাজনীতিকদের এই অবিরাম যুদ্ধ কবে শেষ হবে? আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায় আছে বলে তত্ত্বাবধায়ক বা বিকল্প কোনো ব্যবস্থা মানতে চাইছে না। কিন্তু তারা যদি কখনো বিরোধী দলে যায়, তখন ১৯৯৫-৯৬ সালের মতো একই দাবিতে মাঠে নামবে না, সে কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। কেননা রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। 
নিউইয়র্কের টু-ইন টাওয়ার ধ্বংসের পর পণ্ডিতেরা বলেছিলেন, ৯/১১-এর আগের পৃথিবী আর পরের পৃথিবী কখনো এক হবে না। গত ১৮ বছরের ঘটনাবলি থেকে নিশ্চিত করে বলা যায়, পণ্ডিতদের সেই ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা হয়নি। ওই পণ্ডিতদের কথার প্রতিধ্বনি তুলে বলতে চাই, ৩০ ডিসেম্বরের আগের বাংলাদেশ আর পরের বাংলাদেশ এক হবে না। গণতন্ত্র চাইলে নির্বাচনী ব্যবস্থায় সংস্কার আনতেই হবে।

সোহবর হাসান: যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো।