ধানের দামের সমাধান সরকারের হাতে

দেশে এখন ধান কাটার মৌসুম চলছে। কৃষকের দিনে দিনে যত দেনা হয়েছিল তা এখন শোধ করার সময়। কিন্তু বিধিবাম। দ্রুত ধনী হওয়ার আলাদিনের চেরাগ যে দেশে থাকে, আর তার সুফলভোগীরা যখন রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করে, তখন দেশে কৃষকদের ভালো থাকার কথা নয়। ভালো যে নেই তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন টাঙ্গাইলের এক কৃষক। তিনি তাঁর পাকা ধানে আগুন লাগিয়ে সংবাদের শিরোম হয়েছেন। সোচ্চার করেছেন আমাদের মতো নগরে বসবাস করা আলাদিনের চেরাগের উচ্ছিষ্টভোগীদের। ফলে পত্রপত্রিকার পাতা, ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকের ‘কলমের আগা ফাটিয়া রক্ত ঝরিতেছে’। এতে আবেগ আছে, যুক্তিও আছে, কিন্তু কৃষকের প্রতি, তাঁদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্যের প্রতি আমাদের এই আবেগ কতক্ষণ থাকবে? সেই আবেগ আদৌ কোনো ফল বয়ে আনবে কি? 

পাকা ধানে আগুন দিয়ে প্রতিবাদের ভাষা সবাই একইভাবে পাঠ করেছেন, তা বলা যাবে না। বিষয়টি দেশের খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার ভিন্নভাবেই নিয়েছেন। তাঁর মতে, ধানের দাম কম...। কিন্তু তাই বলে কৃষক তাঁর উৎপাদিত ধানে আগুন দেবেন, এটা হতে পারে না। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। (প্রথম আলো, ১৫ মে ২০১৯)। পত্রিকায় প্রকাশিত এ সংবাদে একজন মন্তব্য করেছেন, তদন্ত করে সেই কৃষককে নাশকতা অথবা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় ফাঁসিয়ে দেন। অতি উৎসাহী পুলিশের দেশে তা মোটেও অসম্ভব নয়। যেমন টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শফিকুল ইসলাম বলেন, এটা শুধুই প্রতিবাদ, নাকি এর পেছনে অন্য কারও কোনো উদ্দেশ্য আছে, সেটি খতিয়ে দেখছে পুলিশ। (প্রথম আলো, ১৩ মে ২০১৯)।

সন্দেহ নেই, বাংলাদেশে এখন কৃষক সম্প্রদায়ই সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণি। কৃষকের বঞ্চনা অথবা সুবিধাপ্রাপ্তি—এটা যতটা বাজারের ব্যাপার তার চেয়েও বেশি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার। সারা পৃথিবীতে বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোতে রাজনৈতিক দলগুলো এবং সরকার কৃষকদের সুবিধার ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক। যে কারণে দেখা যায় যে পৃথিবীর প্রায় সব উন্নত দেশেই কৃষকদের বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দেওয়া হয়। মূলত ভর্তুকির কারণেই উন্নত দেশে এখনো কৃষি বেঁচে আছে। এর মধ্যে শীর্ষে আছে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশসমূহ, যেমন নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড। এর ঠিক পরেই আছে জাপান ও কোরিয়ার মতো এশিয়ার দেশ। একজন নরওয়ের কৃষক তাঁর মোট আয়ের শতকরা ৬০ ভাগ সরকারি ভর্তুকি হিসেবে লাভ করে থাকেন। জাপানে এর পরিমাণ শতকরা ৫০ ভাগের ওপরে। রাজনৈতিক দলগুলোকে এ ব্যাপারে সব সময় কৃষিবান্ধব নীতি গ্রহণ করতে হয়। অন্যথায় ভোটের রাজনীতিতে পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নব্বইয়ের দশকে গণমুখী নীতির লক্ষ্যে কিছুটা হলেও একধরনের প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছিল। এতে সরকারগুলো যেকোনো সময়ের তুলনায় অধিক কৃষিবান্ধব নীতি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল। যার সুবিধা হিসেবে বর্তমানে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা লাভ করেছে। আগের মতো ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারেও আওয়ামী লীগ কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি, কৃষি উপকরণ সহজলভ্য করা এবং কৃষি আধুনিকায়নের ব্যাপারে অনেক বেশি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। সর্বশেষ নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ অতীতের সাফল্যের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। একই সঙ্গে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে যে সময়মতো মানসম্পন্ন কৃষি উপকরণের ওপর ভর্তুকি অব্যাহত রাখা হবে।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীরা এ ব্যাপারে দায়সারা গোছের মন্তব্য করছেন। ইতিমধ্যে খাদ্যমন্ত্রী ও কৃষিমন্ত্রী পৃথক পৃথকভাবে ধানের মূল্য বৃদ্ধি করার জন্য ধান রপ্তানির ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, দেশের চাহিদা মিটিয়ে বাংলাদেশে উৎপাদিত চাল বিদেশে রপ্তানি করার পরিকল্পনা করছে সরকার। তিনি বলেছেন, ‘আমরা সরকারিভাবে প্রান্তিক কৃষক এবং মিলারদের কাছ থেকে ধান ও চাল কেনার যে বরাদ্দ দিয়েছি, তা যেন নিয়ম মেনে কেনা হয়, যেন বাজারে তার প্রভাব পড়ে।’ (প্রথম আলো, ১৫ মে ২০১৯)। অন্যদিকে অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম চাল রপ্তানির ব্যাপারে তাঁর অজানা শঙ্কার কথা প্রকাশ করেছেন এবং তথ্য-উপাত্ত সহকারে উল্লেখ করেছেন যে চাল রপ্তানির আগে এ বিষয়ে ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। (দেখুন, প্রথম আলো, ১৬ মে ২০১৯)।

অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যেতে পারে, এই মুহূর্তে বাজার থেকে সরকার চাল সংগ্রহ করে রপ্তানি করলেও কৃষক ন্যায্যমূল্য পাবেন বলে মনে হয় না। গবেষণায় দেখা গেছে, যে প্রক্রিয়ায় সরকার খাদ্যশস্য সংগ্রহ করে থাকে তাতে নানা কায়দায় মিলারদের একটি ‘সিন্ডিকেট’ লাভবান হয়। এতে কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হয় না। বরং এতে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

ধানের বাজারমূল্য বাড়িয়ে কৃষকদের সুবিধা দেওয়া এবং একই সঙ্গে যেসব দরিদ্র মানুষ খাদ্যদ্রব্যের জন্য বাজারের ওপর নির্ভরশীল, তাদের জন্য বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা একটি অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কেননা মনে রাখতে হবে ধানের মূল্যবৃদ্ধি মানেই বাজারে দ্রুত চালের মূল্যবৃদ্ধি। এতে কম আয়সম্পন্ন মানুষের ওপর চাপ পড়বে। এ বিষয়টিকে খাদ্য নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞগণ ‘ফুড প্রাইস ডিলেমা’ হিসেবে অভিহিত করে থাকেন। এ কারণে বাংলাদেশের মতো দেশসমূহে সরকার সব সময় খাদ্যমূল্য কম রেখে শহরের দরিদ্র ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বার্থ রক্ষায় সচেষ্ট থাকে। ফলে এটা আশা করা মোটেই ঠিক হবে না যে ধানের মূল্য বাড়িয়ে সরকার কৃষকদের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করবে।

তাহলে করণীয় কী? দুই ধরনের পরিকল্পনায় যুগপৎভাবে চলতে হবে। প্রথমত, কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি উচ্চ মূল্যে ধান সংগ্রহ করা এবং তা খোলা বাজারে ট্রাক সেলের মাধ্যমে ভর্তুকি দিয়ে বিক্রি করে বাজারমূল্য স্থিতিশীল রাখা। এতে দরিদ্র ক্রেতাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, কৃষকেরাও পাবেন বাড়তি মূল্য। দ্বিতীয়ত, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আলোকে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুসারে সরকার যদি এখন থেকে কৃষি উপকরণসমূহের ওপর ভর্তুকি চালু করে তাহলেই কেবল দেশের কৃষক বাঁচবে, কৃষি বাঁচবে। এই ভর্তুকি এমনভাবে হতে হবে যেন কৃষকের মোট আয়ের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ ভর্তুকি থেকে আসে। মনে রাখা প্রয়োজন কৃষি উপকরণে ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমেই কেবল সরাসরি কৃষক লাভবান হতে পারেন। অন্য কোনো প্রক্রিয়ায় ইতিপূর্বে এ দেশের দরিদ্র কৃষকেরা কখনো লাভবান হননি।

ড. মোহাম্মদ মোজাহিদুল ইসলাম: অধ্যাপক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]