ট্রাম্প: এ কালের মিয়ার ব্যাটা ফেলু মিয়া

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প

‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’—কথাটার অর্থ, আই মিন মর্মার্থ যা দাঁড়ায় তা হলো— ‘আমেরিকা এক সময় গ্রেট ছিল, তার জ্বলজ্বলা শান-শওকত ছিল, কিন্তু এখন তার দিনকাল খারাপ যাচ্ছে। তাই আমেরিকাকে আগের অবস্থা ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করুন, তাকে আবার গ্রেট বানান।’

তিন বছর আগে এই স্লোগান দিয়ে ভোট চাওয়া শুরু করেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ভোটভিক্ষার পিরিয়ডে ট্রাম্প শিবিরের লোকজনের মাথায় টকটকা লাল ক্যাপ থাকত। তার ওপর গোটা গোটা বড় হাতের রোমান হরফে লেখা ছিল, ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’।

ট্রাম্প গদিতে বসার পর জানা গেল এই ক্যাপ তৈরি হয়েছিল চীন, ভিয়েতনাম আর বাংলাদেশে। বাংলাদেশের ‘বস্ত্রবালিকারা’ জানতেও পারেননি, তাঁরা কী মারাত্মক একজন নেতার ইলেকশনে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা না বুঝলেও রাশিয়ার সাইবার বাহিনী আগে থেকে ঠিকই বুঝেছিল ট্রাম্প কী ‘জিনিস’। তারা হিলারি ক্লিনটনের ইমেইল–টিমেইল সব হ্যাক করে ভোটের আগে ফাঁস করে দিল। যা লাভ হওয়ার তা ট্রাম্পেরই হলো। তিনি প্রেসিডেন্ট হয়ে গেলেন।

কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের পর থেকে এখন পর্যন্ত সেখানে ট্রাম্পের মতো এমন ‘বোম্ব বাস্টিক’ নেতা যে আসেনি, তা বোঝার জন্য গুগলে সার্চ দেওয়ার দরকার হয় না। গত তিন বছরে তিনি যা করে দেখিয়েছেন এবং এখনো করে যাচ্ছেন, তা আমেরিকার আগের কোনো প্রেসিডেন্ট করতে পারেননি। ভবিষ্যতে কেউ পারবেন এমন ‘আশঙ্কাও’ আপাতত দেখা যাচ্ছে না।

ইলেকশনে খাড়ানোর পরের দিন থেকে ট্রাম্প ধুমায়ে মিথ্যা কথা বলা শুরু করেছিলেন। বক্তৃতার মধ্যে হিলারিকে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের আকথা-কুকথা বলছিলেন। দেখা গেল, মিটিংয়ের মধ্যে তিনি বলা শুরু করলেন, আমেরিকায় ‘কামলা খাটতে’ আসা যেসব লোকের কাছে কাগজপত্র নাই, তাদের সবাইকে বের করে দেওয়া হবে। মেক্সিকোর বর্ডারের এমন বেড়া দেওয়া হবে যে, তা ডিঙিয়ে আসার ক্ষমতা কারও নেই। তিনি বললেন, ‘আমেরিকা ফার্স্ট’, মানে ‘আগে আমেরিকার স্বার্থ’।

ইলেকশনের আগে ট্রাম্প টুইটারে সমানে ‘টাউটারি’ পোস্ট দিচ্ছিলেন। উঠতি বয়সের ছেলেপেলের মতো তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভোররাতেও টুইট করছিলেন। এসব দেখে একদল মনোবিদ ওই সময় বলেছিলেন, এগুলো বালখিল্য আচরণ, পোলাপানের কাজ কারবার; এই লোকের মাথায় নির্ঘাত ‘দোষ’ আছে। বাঘা বাঘা বিশ্লেষকেরা নানান ধরনের অঙ্ক করে-টরে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, ভোটে ট্রাম্প ডাহা ফেল করবেন।

নিয়তির লীলা বোঝা বড় দায়। দেখা গেল আমেরিকার ভোটাররা এই পাগলামি গিললেন। তাঁর উল্টোপাল্টা কাজ কারবারই ভালো লাগল তাঁদের। ট্রাম্প ঠাস করে পাশ করে গেলেন। আক্ষরিক অর্থে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে বিদায় নিলেন হিলারি ক্লিনটন।

মহাসমারোহে শপথ পড়ে গদিতে বসেই একের পর এক ভেলকি দেখানো শুরু করলেন ট্রাম্প। প্রথমেই মুসলিম প্রধান দেশগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন। নিজের ডান হাত, বাম হাত হিসেবে নিয়োগ দিলেন স্টিভ ব্যানন, রেক্স টিলারসনের মতো কট্টর রক্ষণশীলদের। এরপরই তিনি দেখাতে থাকলেন ‘এক্সিকিউটিভ পাওয়ার’ কাকে বলে। তাঁর নির্বাহী ক্ষমতা খাটানোর স্টাইল দেখে তাঁকে শহীদুল্লাহ কায়সারের ‘সংশপ্তক’ উপন্যাসের মিয়ার ব্যাটা ফেলু মিয়া ভাবা ছাড়া উপায় থাকে না। বাকুলিয়া গ্রামে ফেলু মিয়ার ওপরে কথা চলত না। কেউ গাঁইগুঁই করলেই তার চাকরি নট। ট্রাম্পের কাছে গোটা আমেরিকা এখন বাকুলিয়া গ্রাম আর তিনি সেখানকার মিয়ার ব্যাটা ফেলু মিয়া। তাঁর যেটি ঠিক মনে হচ্ছে সেটিই তিনি করছেন। কেউ উঁহু আহা করলেই তাঁকে সরিয়ে দিচ্ছেন।

গদিতে বসার পর ট্রাম্প যে কথাটি অন্যকে বলতে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন, সেটি হলো, ‘ইউ আর ফায়ারড্!’ এই সংলাপ দিয়ে গত তিন বছরে তিনি যার–তার চাকরি খেয়েছেন। কাউকে তিনি সরাসরি বরখাস্ত করেছেন, কেউ আবার মনে মনে ‘ভিক্ষা চাই না, কুত্তা ঠ্যাকাও’ বলে ‘মান সম্মান নিয়ে’ পদত্যাগ করেছেন।

চার তারকা পাওয়া মেরিন জেনারেল জিম ম্যাটিস ওরফে ‘ম্যাড ডগ’ ম্যাটিসকে আদর করে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বানিয়েছিলেন ট্রাম্প। ট্রাম্প সিরিয়া থেকে মার্কিন সেনা সরিয়ে আনার কথা বলার পরই ম্যাটিস তা মানতে পারেননি। তাঁর আপত্তির কথা জানিয়েও ছিলেন। ট্রাম্প পাত্তা দেননি। তাই ম্যাটিস সরে গেলেন।

জাতিসংঘে মার্কিন দূত নিকি হ্যালি এবং ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইকেল ফ্লিনও একইভাবে জিম ম্যাটিসের মতো পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে চাকরি ছাড়লেন।

ট্রাম্পের ইলেকশনে রাশিয়া কদ্দুর সাহায্য সহযোগিতা করেছিল, তা খতিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন এফবিআইয়ের পরিচালক জেমস কোমি। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কেউটে বের হয়ে পড়তে পারে—সেই আশঙ্কায় ট্রাম্প জেমস কোমিকে সরাসরি ‘ইউ আর ফায়ারড্’ বলে বিদায় দিয়েছেন। একইভাবে বরখাস্ত হয়েছেন, অ্যাটর্নি জেনারেল সালি ইয়েটস।

এভাবে বরখাস্ত হওয়া ও নিজ থেকে সরে যাওয়া ব্যক্তিদের নাম বলতে গেলে রেক্স টিলারসন, স্টিভ ব্যানন, শন স্পাইসার, প্রিট ভারারা, ওয়াল্টার শাউব, মাইকেল ডুবাকি, রেইন্স প্রিবাস, মাইকেল শর্ট, অ্যান্থনি স্কারমুচ্চি, টম প্রাইস, অ্যান্ড্রু ম্যাককাবেসহ ডজন দুয়েক লোকের নাম বলা যাবে। এঁদের সবাইকে ট্রাম্পের অতি ঘনিষ্ঠজন বলেই সবাই জানত। কিন্তু ট্রাম্প জানিয়ে দিয়েছেন ‘ঘনিষ্ঠজন’ বলে তাঁর কেউ নেই। এই দিক থেকে তিনি নিঃসঙ্গ, একা।

আমেরিকাকে আবার ‘গ্রেট’ বানাতে এবং ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে ট্রাম্প আমেরিকাকে যদ্দুর পারা যায় বন্ধুহীন করে চলেছেন। চীনের সঙ্গে তিনি বাণিজ্যযুদ্ধ ঘোষণা করেছেন, সিরিয়া ও আফগানিস্তানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিকঠাক না করেই সেখান থেকে সেনা সরিয়ে এনেছেন, মার্কিন দূতাবাস তেলআবিব থেকে জেরুজালেমে সরিয়ে নিয়েছেন। ন্যাটো থেকে সরে আসারও হুমকি দিয়েছেন ট্রাম্প। তিনি বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তন–টরিবর্তন কিছু না, এসবের নামে গরিব দেশগুলো আমেরিকার মতো বড়লোকের কাছ থেকে চাঁদা তুলে খায়। এই কারণে তিনি চাঁদা দেওয়া বন্ধ করবেন।

দেশের মধ্যেও কম প্যাঁচ লাগাননি ট্রাম্প। এর আগে বারাক ওবামা একটা স্বাস্থ্য সেবা প্রকল্প রেখে গিয়েছিলেন যেটি ‘ওবামা কেয়ার’ নামে পরিচিত। কোনো রকম বিকল্প ব্যবস্থা না করেই ‘ওবামা কেয়ার’ বাতিল করেছেন ট্রাম্প। যে শিশুদের জন্ম আমেরিকায় কিন্তু তাদের বাবা–মা বৈধ নাগরিক নন, সেই শিশুদের বাবা–মা থেকে বিচ্ছিন্ন করার মতো কাজও তিনি করেছেন।

তাঁর আরেকটি নজিরবিহীন বড় কাজ হলো টানা তিন সপ্তাহ ধরে কেন্দ্রীয় সরকারের কাজকর্ম অচল করে রাখা। যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল তোলার খরচ বাবদ ট্রাম্প ৫৭০ কোটি ডলার বরাদ্দের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। প্রতিনিধি পরিষদ সেই প্রস্তাবকে কুপ্রস্তাব বিবেচনা করে তাতে আপত্তি দিয়েছিল। এতে রাগ হয়ে ট্রাম্প কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয় বরাদ্দের বিল ভাউচারে সই করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ট্রাম্প বলেছেন, তার কথায় প্রতিনিধি পরিষদ রাজি না হলে তার হাতে নির্বাহী ক্ষমতা আছে। সেই ক্ষমতা দিয়ে দিয়ে তিনি জাতীয় দুর্যোগ ঘোষণা করে মেক্সিকোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণের সীমান্তে দেয়াল তোলার অর্থ পাশ করবেন।

এত বড় একজন লোক, যিনি এক সময় ক্যাসিনো, মানে জুয়ার কারবার চালাতেন; যিনি এক সময় বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতার আয়োজক ছিলেন, যিনি টেলিভিশনে উপস্থাপনা করতেন, সেই লোকের নামে একটু স্ক্যান্ডাল থাকতেই পারে। এর আগে বেশ কয়েকজন নারী নানাভাবে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনেছিলেন। সবাইকে ট্রাম্প সুন্দরভাবে ‘ম্যানেজ’ করেছেন। তবে ‘বড়দের ছবি’তে অভিনয় করা স্টর্মি ড্যানিয়েল তাঁকে বেশ ভালোই বেকায়দায় ফেলেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবকিছুই ঝেড়ে ফেলেছেন ট্রাম্প।

ট্রাম্পের সামনে আরও এক বছর আছে। শরীর-স্বাস্থ্য ঠিক থাকলে এই এক বছরে আরও কত কী করবেন, তা বোধ হয় ট্রাম্প নিজেও জানেন না। তবে একটা বিষয় তিনি নিশ্চয়ই টের পেয়েছেন, আমেরিকাকে ‘গ্রেট’ বানাতে গিয়ে তিনি আসলে দেশটিকে ক্রমাগত একঘরে বানিয়ে ফেলছেন। আন্তর্জাতিক মহলের বিচার সালিসে আগে আমেরিকা ‘মুরুব্বি’ হিসেবে কথা বললে সবাই যেভাবে আমলে নিত, আস্তে আস্তে আমেরিকার সেই ওজন কমের দিকে যাচ্ছে। বাকি দুনিয়া থেকে আমেরিকা যত বেশি ফারাক হবে, এই ওজন তত কমতে থাকবে। আমেরিকা নামক বাকুলিয়ার ট্রাম্প নামক মিয়ার ব্যাটা ফেলু মিয়া কি সেটা টের পাচ্ছেন?