এত মৃত্যুর শোক সইতে পারবে উন্নয়ন?

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

এই মুহূর্তে দৃশ্যটি খুব মনে পড়ছে। বিনা ভিসায় ইউরোপে যাওয়ার পথে সাগরে মারা যাওয়া দুই ভাইয়ের লাশ এসেছে বিমানবন্দরে। কফিনের কোণে ঝুলছে ছোট্ট ছবি, যেন বুঝতে সহজ হয় কোন কফিনে কার লাশ। অনেক বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন। বাবা এসেছেন লাশ নিতে। বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে ছবি দুটো। দরিদ্র বাবা গামছা দিয়ে বারবার করে ছবি দুটো মুছছেন, আঁকড়ে ধরছেন, যেন কিছুতেই না ভিজে যায় ছেলের ছবি।

কথাটা মনে পড়ল এই খবরটা পড়ে—ইতালি যাওয়ার সময় ভূমধ্যসাগরে নৌকা ডুবে একটি অভিবাসনপ্রত্যাশী দলের অন্তত ৬০ জন মারা গেছেন। নৌকার আরোহীদের মধ্যে ৫১ জন বাংলাদেশি ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ৩৭ জন প্রাণ হারিয়েছেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, জীবিত উদ্ধার হওয়া ১৬ জনের মধ্যে ১৪ জন বাংলাদেশি। ৭৫ জন যাত্রী নিয়ে নৌকাটি লিবিয়া থেকে ইতালি যাচ্ছিল। দুটো খবরই কেমন করে যেন পরপর চোখে পড়ল।

অন্য খবরটি এই—বাংলাদেশের অর্থনীতিকে কানাডা ও থাইল্যান্ডের সঙ্গে তুলনা করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন কানাডা ও থাইল্যান্ডের সমান ( দৈনিক প্রথম আলো, ১২ মে ২০১৯)।

আরেকটি ঘটনাও মনে পড়ে। বেশ কয়েক বছর আগে ঘটনাটি ঘটেছিল ঢাকা বিমানবন্দরেই। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে এক কিশোর উড়োজাহাজের চাকায় নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিল। লন্ডনগামী উড়োজাহাজটি চলা শুরু করলে ছেলেটি মারা যায়। না, এটা কোনো শখ বা অভিযান ছিল না। নিত্যদিনের দরিদ্রতা থেকে বাঁচার জন্য সেই কিশোর জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিল। লুকিয়ে কোনোভাবে বিদেশ যেতে চেয়েছিল। আজ হয়তো অনেকেরই মনে নেই। এ দেশে নিত্যদিন, প্রতি ঘণ্টায় এত্তসব হৃদয়ছেঁড়া ঘটনা ঘটে যে মানুষ আগেরগুলো ভুলে যেতে বাধ্য হয়।

‘প্রত্যক পরিবারের একজনকে চাকরি দেওয়া হবে, সরকারের এই স্লোগান শুধু যে আওয়াজই ছিল, তার প্রমাণ এই মানুষেরা। কাজের সন্ধানে, একটু অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের আশায় বৈধ-অবৈধ পন্থায় বিদেশে যেতে চেষ্টা করছেন বাংলাদেশের মানুষ। এর প্রধান কারণ বেকারত্ব। এ থেকে মুক্তি পেতে দালালের খপ্পরে পড়ছেন তাঁরা আর চরম অনিশ্চয়তার পথে ঘর ছেড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও যেতে চাইছেন বিদেশে। ২০১৫ সালে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে সাগরে ডুবে কয়েক হাজার মানুষ মারা যান। এ ছাড়া থাইল্যান্ডে কয়েকটি বড় গণকবরের সন্ধান মেলে, যেখানে বাংলাদেশের অনেক মানুষের কবর আছে বলে অনুমান করা হয়। শুধু নৌকাডুবিই নয়, বিভিন্ন দেশের সীমান্ত পুলিশের হাতে ধরা পড়েন অনেকেই। এর ফল হিসেবে চরম নির্যাতন ভোগ ও দীর্ঘ কারাবাসের ঘটনা প্রায়ই ঘটে। অবৈধ অবস্থানের অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়ে নিপীড়ন ও কারাভোগ করে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে সর্বস্ব হারিয়ে ফেরত আসতে বাধ্য হন অনেক বাংলাদেশি।

অবৈধ উপায়ে বিভিন্ন দেশে যাওয়ার জন্য নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়টাকে বেছে নেওয়া হয়। কারণ এই সময়টাতে সাগর অনেকটা শান্ত থাকে। ভূমধ্যসাগর ব্যবহৃত এই ভয়ংকর পথে প্রায় সময়ই শরণার্থীসহ নৌকাডুবির খবর পাওয়া যায়। এই পথ দিয়েই আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে লিবিয়া থেকে শরণার্থীরা নৌকাযোগে ইউরোপের দেশগুলোতে প্রবেশের চেষ্টা করে থাকে। ইউএনএইচসিআরের হিসাব অনুযায়ী জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত লিবিয়া থেকে ইউরোপে যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে ১৬৪ জন নিহত হয়েছেন। তবে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এই যে, ইওএমের ২০১৭ সালে করা একটি জরিপে দেখা গেছে, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি ঢোকার চেষ্টা করেছে যেসব দেশের নাগরিকেরা, সে রকম প্রথম পাঁচটি দেশের তালিকায় বাংলাদেশিরা রয়েছেন। সুতরাং সহজেই বোঝা যায়, বাংলাদেশ থেকে কত মানুষ জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে এই ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে যেতে চান বিদেশে একটু ভালোভাবে বাঁচার স্বপ্নে।

এক বছর ধরেই গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে সৌদি আরব গিয়ে অবর্ণনীয় শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরছেন আমাদের অনেক নারী। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৭ লাখ ৩৫ হাজার ৫৭৫ জন বাংলাদেশের নারী কর্মরত আছেন। তাঁদের মধ্যে সৌদি আরবে গেছেন ২ লাখ ৩৪ হাজার ৮৩১ জন নারী। বিশেষ করে ২০১৫ সালে সমঝোতা হওয়ার পর দুই লাখের বেশি নারী বিদেশে গেছেন। তাঁদের অনেকেই নানা ধরনের সংকটে পড়ে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। তবে এ পর্যন্ত কতজন নারী শ্রমিক দেশে ফেরত এসেছেন এবং দেশে ফিরে এসে তাঁরা কেমন আছেন, তার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য কারও কাছে নেই । কারণ দেশে ফিরে আসার পর অনেকের পরিবারই তাঁদের গ্রহণ করেনি।

দেশে বেকারত্ব ক্রমাগত বাড়ছে। কর্মসংস্থান ও সচ্ছল জীবনের নিশ্চয়তা না পাওয়ায় দিশেহারা মানুষ রোজগারের আশায় এদিক-ওদিক ছুটছেন। বৈধ-অবৈধতার পার্থক্য মাপতে পারছেন না। কিন্তু তাঁদের অনেকেই লাশ হয়ে ফিরছেন, নির্যাতিত হয়ে ফিরছেন কিংবা শোষণ, জেল-জরিমানার অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরছেন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোর একমাত্র কাজ লাশ পাঠানো। সেই কাজেও গাফিলতির অভিযোগ বিস্তর।

‘বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল’ দাবি করছে সরকার। কিন্তু এই দাবিতে বাদ সাধছেন বড্ড বেয়াড়া ডুবে যাওয়া মানুষগুলো। ওই দাবির দেমাগের প্রতি কেমন যেন এক অস্বস্তি তৈরি করছেন এই মানুষগুলো, মৌলিক প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছেন তাঁরা। দেশ যদি উন্নয়নের রোল মডেলেই হবে, তবে তাঁদের কেন করতে হয় অবৈধভাবে আরেক দেশে গিয়ে রোজগারের চিন্তা, যেতে হয় মৃত্যুর ঝুঁকিতে। দেশে কাজ না পেয়ে বা উপার্জনের কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে যখন এই মানুষগুলো ছুটতে থাকেন বিদেশের পানে, দেশে উন্নয়নের জোয়ারের দাবি আছড়ে পড়লেও সেই জোয়ার তাঁদের জীবনে কোনো পরিবর্তন আনে না, তাই তাঁরা ছুটে যান মৃত্যুর দুয়ারে।

লাশ আনতে যাঁরা যান সেসব মা-বাবার কথা আবারও মনে পড়ে।বুকে কাঁপন লাগানো সেই স্মৃতি আমাকে আজও তাগাদা দেয় জানতে, অনেক তো উন্নয়ন হলো, মানুষ কেন তবে পালাচ্ছে? কেন নিচ্ছে করুণ মৃত্যুর পথ? কেন কাজ অথবা মৃত্যুর শপথ করছে আমাদের যুব প্রজন্মের অনেকে? কানাডা বা লস অ্যাঞ্জেলস আসলে কোথায়?

জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]