নার্স ও মিডওয়াইফরা অসাধ্য সাধন করতে পারেন

প্রথম আলো ফাইল ছবি।
প্রথম আলো ফাইল ছবি।

আমরা অনেকে খেয়াল করি না, বর্তমানে দেশে গড়ে প্রতি তিনজন ডাক্তারের সহযোগিতার জন্য নার্স আছেন একজন। মিডওয়াইফ বা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধাত্রী আরও কম। অথচ অনুপাতটা হওয়া উচিত ঠিক উল্টো। একজন ডাক্তারের সহযোগিতায় থাকবেন তিনজন নার্স। বিশ্বের উন্নত বা এমনকি আমাদের মতো উন্নয়নশীল অনেক দেশেও এ রকম ব্যবস্থাই দেখা যায়। দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশে ডাক্তারের তুলনায় নার্স ও মিডওয়াইফের সংখ্যা বেশ কম। কিন্তু বিশেষভাবে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু কমানোর জন্য নার্স ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মিডওয়াইফ বা ধাত্রী আরও বেশি দরকার।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকে কথাগুলো বলছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা। ওই আলোচনায় নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক তন্দ্রা শিকদার বলেন, এখন ঘাটতি পূরণের বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শুধু সংখ্যা বৃদ্ধিই নয়, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন বলে এখন নার্স ও মিডওয়াইফারি পেশায় দক্ষতা বৃদ্ধি ও মানসম্পন্ন পেশাদারি বেড়েছে। এখন এ পেশার মর্যাদাও বাড়ছে। ফলে উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তিনি জানান, সুইডিশ ইউনিভার্সিটির সহযোগিতায় কয়েকজন পিএইচডি করেছেন। ৩০০ জন মাস্টার্স করেছেন।

সাধারণভাবে মনে করা হয়, ডাক্তারই আসল, মিডওয়াইফ শুধু সহকারী হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু আসলে তা নয়। শুধু জটিল কিছু ক্ষেত্র ছাড়া প্রসূতি মায়ের দেখাশোনা ও সন্তান জন্মের সময় মিডওয়াইফদের ভূমিকাই প্রধান। সন্তান জন্মের সময় যদি প্রসূতি মায়ের অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়, খিঁচুনি হয়, তাহলে কখন তা বিপজ্জনক মাত্রায় পৌঁছেছে এবং কখন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে রোগীকে পাঠাতে হবে, সেটাও কিন্তু মিডওয়াফই ভালো বোঝেন। জরুরি ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের ব্যবস্থা থাকতে হবে। আর যদি মানসম্পন্ন লেবার রুম থাকে, হাতের কাছে অ্যানেসথেটিস্ট বা অবেদনবিদ থাকেন, প্রয়োজনে রক্ত দেওয়া বা অপারেশনের ব্যবস্থা থাকে, তাহলে মা ও শিশু মৃত্যুহার পরিকল্পিত লক্ষ্যমাত্রায় নামিয়ে আনা সম্ভব।

বর্তমানে দেশে প্রতি লাখ জীবিত জন্মে (জীবিত সন্তান জন্ম দেওয়া) মাতৃমৃত্যু হার প্রায় ১৭২। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতি লাখ জীবিত জন্মে মাতৃমৃত্যু হার ৭০-এর নিচে নামিয়ে আনতে হবে। এটা কি সম্ভব? অবশ্যই সম্ভব। ইতিমধ্যে কাজ জোরেশোরে শুরু হয়েছে। আগামী ১১ বছরে বর্তমান মাতৃমৃত্যু হার অর্ধেকের নিচে নামিয়ে আনা কঠিন নয়।

তবে এ জন্য অনেক বেশি কাজ করতে হবে। প্রথমত, দক্ষতাসম্পন্ন মিডওয়াইফ ও নার্স দরকার। তাঁদের পেশার মর্যাদা বাড়ানো খুব দরকার। তাঁদের চাকরির যোগ্যতা অনুযায়ী প্রথম শ্রেণিও হতে পারে, সে ব্যবস্থা করা উচিত। একই সঙ্গে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত মাতৃস্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র যেন কার্যকর থাকে, সেটা নিশ্চিত করা হলে মা ও নবজাতকের মৃত্যুহার নাটকীয়ভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব। এখানে প্রয়োজন নার্স-মিডওয়াইফদের নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা। আর দরকার জরুরি ক্ষেত্রে যেন কোনো প্রসূতি মাকে ইউনয়ন পর্যায় থেকে উপজেলা বা জেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া যায়, সে জন্য অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা।

সবকিছু যে সরকার করবে তা নয়। যেমন অ্যাম্বুলেন্স ব্যক্তিমালিকানায়ও চলতে পারে। এখন গ্রামপর্যায় পর্যন্ত পাকা রাস্তা হয়েছে। সবার কাছে মোবাইল ফোন আছে। যেকোনো জরুরি পরিস্থিতিতে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া কঠিন নয়। সমস্যা হলো, এখনো অনেক গ্রামের পরিবারের সদস্যরা প্রসূতি মাকে সন্তান জন্মের সময় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেতে চান না বা খুব উৎসাহ দেখান না। এ কারণে জটিলতা সৃষ্টি হলে শেষ মুহূর্তে জরুরি সেবা দেওয়া সম্ভব হয় না। অনেক ক্ষেত্রে মা ও শিশুর জীবন ঝুঁকির মুখে পড়ে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে শিশু জন্মের হার এখনো ৪০ শতাংশের মতো, অথচ অনায়াসে এটা ৮০ শতাংশে নিয়ে যাওয়া যায়। এটাই আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ।

অবশ্য এখানে একটা কথা আছে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কেন যেতে চাইবেন না। সেখানে যদি সার্বক্ষণিক নার্স-মিডওয়াইফ, মানসম্পন্ন লেবার রুম ও অন্যান্য জরুরি সেবার ব্যবস্থা থাকে, তাহলে অবশ্যই সবাই সেখানে যাবেন। এসব ক্ষেত্রে যে ঘাটতি আছে, তা পূরণ করতে হবে। তাহলে ৮০ শতাংশ কেন, ১০০ ভাগ প্রসূতি মা স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাবেন। এতে সন্দেহ নেই।

পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) এক্সিকিউটিভ চেয়ারপারসন হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, সবাইকে যে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতেই হবে, তা নয়। মূল ব্যাপার হলো দক্ষ নার্স ও মিডওয়াইফের উপস্থিতিতে সন্তান জন্মদানের ব্যবস্থা। সেটা নিজের বাসায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশে হলেও চলে। তাই ইউনিয়ন পর্যায়ে যে নার্স ও মিডওয়াইফ থাকবেন, তাঁদের গ্রামের বিভিন্ন পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে। যেসব বাসায় সন্তানসম্ভবা মা থাকবেন, তাঁদের খোঁজখবর রাখতে হবে। শিশু জন্মের আগে-পরে কখন কী করা দরকার এবং তাদের স্বাস্থ্যের নিয়মিত খোঁজখবর রাখাই হবে নার্স ও মিডওয়াইফদের কাজ।

দক্ষ মিডওয়াইফ তৈরির জন্য দরকার দক্ষ শিক্ষক। সে ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারি যে ব্যবস্থা আছে, তার পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগের প্রসারও চাই। প্রকৃতপক্ষে দেশেই শুধু না, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দক্ষ মিডওয়াইফের চাহিদা রয়েছে। আর আমাদের দেশে মিডওয়াইফরা সম্প্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছেন। এখনো করছেন। বিদেশি বিশেষজ্ঞরাও তা দেখেছেন। এ অবস্থায় দেশে দক্ষ নার্স ও মিডওয়াইফ তৈরির জন্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সুযোগ ও চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। সরকার তো অবশ্যই উদ্যোগ নেবে; সেই সঙ্গে বেসরকারি উদ্যোগও আসবে।

এখানে একটি বড় সমস্যা রয়েছে। আমাদের দেশে বেসরকারি উদ্যোগে অনেক সমস্যা থাকে। অনেক বেসরকারি ক্লিনিকে মানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিত করার প্রতি তেমন মনোযোগ দেখা যায় না। দক্ষ মিডওয়াইফের পরিবর্তে অনেক সময় গ্রামের অদক্ষ ধাই নিয়োগ দেওয়া হয়। সরকারের এদিকে নজরদারি দরকার। তা না হলে পরিস্থিতির উন্নতি কঠিন।

আশার কথা যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নার্সিং ও মিডওয়াইফারি সেবার মান বৃদ্ধি এবং তাদের কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা দিচ্ছে। ইউএনএফপিএ কয়েক বছর ধরে এ ক্ষেত্রে কাজ করছে। ফলে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে। সরকারও তাদের সহযোগিতা কাজে লাগিয়ে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কাজ করছে। চ্যালেঞ্জ কঠিন, সন্দেহ নেই। আমাদের এই জনবহুল দেশে প্রায় সোয়া দুই লাখ নার্স ও মিডওয়াইফ দরকার। আর এখন বছরে ১২ থেকে ১৩ হাজার নার্স প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে কাজে যোগ দিচ্ছেন। এই হারে আমাদের প্রয়োজন মেটাতে অন্তত ২০ বছর লাগবে। তাহলে তো চলবে না।

তাই এখন আমাদের দরকার মানসম্পন্ন শিক্ষক ও শিক্ষাকেন্দ্র। সব দৃষ্টি এদিকে কেন্দ্রীভূত করতে হবে।

আব্দুল কাইয়ুম প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক