অরক্ষিত রোহিঙ্গা শিবির

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে কতজন আশ্রয়শিবিরে আছে আর কতজন শিবির থেকে পালিয়ে গেছে, তার সুনির্দিষ্ট হিসাব সরকারের কোনো সংস্থার কাছে নেই। যদিও আগত রোহিঙ্গাদের পরিচয়পত্র তৈরি করেছিল সরকার। আশ্রয়শিবির থেকে পালিয়ে যাওয়ার পথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ৫৮ হাজার ৫৮৪ জন আটক হয়েছে। কিন্তু যারা ধরা পড়েনি, তাদের সংখ্যা কখনো জানা যাবে না।

গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোয় রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরগুলোর যে চিত্র উঠে এসেছে, তা উদ্বেগজনক। রোহিঙ্গা আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা ১১ লাখ ২৮ হাজার ৫২৯ জন। তাদের রাখা হয়েছে ৩৪টি শিবিরে। এদের নিরাপত্তা রক্ষায় আছে সাতটি টহলচৌকি কিংবা ৯৫০ জন পুলিশ সদস্য। এই সীমিত লোকবল দিয়ে এত বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর ওপর নজরদারি করা সম্ভব নয়। তদুপরি এসব শিবিরে কোনো সীমানাপ্রাচীর বা কাঁটাতারের বেড়া না থাকায় কে কখন বের হলো বা প্রবেশ করল, সেটি যাচাই করা সম্ভব হয় না।

২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযান ও হামলার মুখে যখন রোহিঙ্গা জনস্রোত বাংলাদেশে আসে, তখন ধারণা করা গিয়েছিল, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তারা মিয়ানমারে ফেরত যাবে। কিন্তু গত দেড় বছরে তার কোনো লক্ষণ নেই। মিয়ানমার সরকার সেখানে পোড়ামাটি নীতি নিয়েছে। ফলে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা মনে করছে না যে তারা সহজে সেখানে ফিরে যেতে পারবে। এই অনিশ্চয়তার সুযোগে একশ্রেণির দালাল তাদের নানাভাবে প্রলুব্ধ করে শিবিরের বাইরে নিয়ে আসছে। অনেককে পাচার করা হয়েছে বিদেশে। আগে বাংলাদেশে আসা বেশ কিছু রোহিঙ্গা স্থানীয় লোকজনের যোগসাজশে পাসপোর্ট বানিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। সম্প্রতি ঢাকার খিলক্ষেত এলাকায় অভিযান চালিয়ে পুলিশ ২৪ রোহিঙ্গাকে আটক করে, যাদের মালয়েশিয়ায় পাঠানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। এর আগে সমুদ্রপথে পাচারের সময় ১৭০ জন নারী, ১০৭ জন পুরুষ ও ৮৫টি শিশুকে উদ্ধার করা হয়েছে। পত্রিকান্তরের খবর অনুযায়ী, গত এক বছরে চার শতাধিক রোহিঙ্গা নারীকে বিদেশে পাচার করা হয়েছে, যাদের বেশির ভাগের ঠিকানা হয়েছে সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া।

শুধু বিদেশে পাচার নয়, শিবির থেকে বেরিয়ে আসা রোহিঙ্গারা দেশের ভেতরেও নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে পরিচয় লুকিয়ে কাজ করছে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর ১১ লাখ ২৮ হাজার ৫২৯ জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে। এর আগেও অনেকে এসে বাংলাদেশের সামাজিক জীবনে মিশে গেছে। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে ভাষা, খাদ্য ও পোশাকে মিল থাকায় রোহিঙ্গারা একবার শিবিরের বাইরে যেতে পারলে তাদের ধরা কঠিন। শিবিরের বাইরে থাকা রোহিঙ্গাদের সহায়তায়ই শিবিরের বাসিন্দারা বাইরে আসছে। আশ্রয়শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের ওপর নজরদারি থাকলেও শিবিরের বাইরে থাকা রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। এদের কারণে সামাজিক অপরাধও বেড়েছে।

রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার বিষয়ে যে আলোচনা চলছিল, তারও কোনো অগ্রগতি নেই। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর নীরবতাও দুঃখজনক। বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার আগমন আমাদের ওপর শুধু অর্থনৈতিক চাপই সৃষ্টি করেনি, সামাজিক অস্থিরতাও বাড়িয়ে দিয়েছে। রোহিঙ্গা শিবিরগুলো অনিরাপদ থাকতে পারে না। রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরগুলোর নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। টহলচৌকি ও নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত পুলিশের সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে। ভুয়া পরিচয় দিয়ে যাতে কেউ এখান থেকে বের হতে না পারে, সে জন্য নজরদারি বাড়াতে হবে। দ্বিতীয়ত, সরকারকে সেসব দালাল চক্রকে খুঁজে বের করতে হবে, যারা রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন দেশে পাচার করছে।

রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা তো বটেই, বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সামাজিক শৃঙ্খলার স্বার্থেই এই দালাল চক্রকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।