শিক্ষকদের এই লাঞ্ছনার শেষ কোথায়?

অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের প্রতিবাদে ছাত্রছাত্রীদের মানববন্ধন
অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের প্রতিবাদে ছাত্রছাত্রীদের মানববন্ধন

একজন উপাচার্য কলেজশিক্ষকদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্তীকরণ করে সমালোচিত হয়েছিলেন, আরেকজন উপাচার্য এই শিক্ষকদের প্রাপ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে হয়েছেন প্রশ্নবিদ্ধ। এই দুই উপাচার্যের বিপরীতমুখী আচরণ ও অবস্থানের কারণে বিপন্ন আজ ১৮ জন শিক্ষকের জীবন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) ১৮ জন শিক্ষক বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না ১১ মাস ধরে। এমনকি ভবিষ্য তহবিল (প্রভিডেন্ট ফান্ড) থেকে টাকা তুলে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করবেন, সেই সুযোগও নেই তাঁদের। এ রকম একটি অবস্থায় ১৮টি পরিবার কী দুঃসহ জীবন কাটাচ্ছে, তা সহজেই অনুমেয়। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ালেও এই জটিলতা কিছুতেই কাটছে না।

২০১২ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদনক্রমে খোলা হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজকে এই ইনস্টিটিউটের আওতায় আনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং এই কলেজের ১৮ জন শিক্ষককে ইনস্টিটিউটে আত্তীকরণ করা হয়। এর ফলে এই শিক্ষকেরা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের সমান বেতন-ভাতাসহ যাবতীয় মর্যাদা ভোগ করে আসছিলেন। তখন কথা উঠেছিল তৎকালীন উপাচার্য আনোয়ারুল আজিম আরিফের ছেলে কলেজের শিক্ষক ছিলেন বলে তাঁকে সুবিধা দেওয়ার জন্যই এই পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। অবশ্য কলেজশিক্ষকদের ইনস্টিটিউটে আত্তীকরণের উদাহরণ এটিই প্রথম নয়, এর আগে ২০১০ সালে চারুকলা কলেজের শিক্ষকদেরও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা ইনস্টিটিউটে আত্তীকরণ করা হয়েছিল।

অনুমোদন দেওয়ার প্রায় ছয় বছর পর ইউজিসির তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল আইইআরের বিদ্যমান জনবলের খরচ এবং বেতন-ভাতা খতিয়ে দেখতে আসে। তদন্ত প্রতিবেদনে তারা উল্লেখ করে, ইউজিসির অনুমোদনের সময় কলেজে কর্মরত শিক্ষকদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অঙ্গীভূত করার কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়নি। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার জন্য নির্ধারিত সব যোগ্যতা পূরণ না হওয়ায় কলেজশিক্ষকদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অঙ্গীভূত করার কোনো সুযোগ নেই।

ইউজিসির এই পর্যবেক্ষণ নতুন করে জটিলতার সৃষ্টি করে। কারণ, কলেজের সেই শিক্ষকেরা ইতিমধ্যেই ছয় বছর ইনস্টিটিউটে কর্মরত থেকে পাঠদান করেছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষকদের সমমর্যাদার বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা পেয়েছেন। জটিলতা আরও গভীর হয় ২০১৮ সালের মে মাসে সিন্ডিকেট সভায় তাঁদের কলেজে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে। সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত বছরের জুন মাসে এ শিক্ষকদের পূর্বের কর্মস্থল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে (ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ) ফেরত পাঠানোর বিষয়ে অফিস আদেশ জারি করা হয়।

প্রশ্ন ওঠে, ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা ও ১৮ জন শিক্ষককে বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্তীকরণের ছয় বছর পর কেন ইউজিসি তদন্ত করতে এল কিংবা এই পর্যবেক্ষণ তুলে ধরল? সিন্ডিকেট সভাও কেন শিক্ষকদের ছয় বছর সময়কালের শ্রম ও নিষ্ঠাকে বিবেচনায় না নিয়ে আগের কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার নির্দেশনা দিল। এতে একদিকে এই শিক্ষকদের দীর্ঘ ছয় বছরের কর্মজীবনকে মুছে দেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে উপেক্ষিত হয়েছে তাঁদের সামাজিক মর্যাদাও।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করেছেন এই শিক্ষকেরা। হাইকোর্ট শুনানি শেষে ছয় মাসের স্থগিতাদেশ দেন। হাইকোর্টের এই স্থগিতাদেশের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সুপ্রিম কোর্টে গেলে সুপ্রিম কোর্ট স্থগিতাদেশ বহাল রাখেন এবং মামলাটি হাইকোর্টে দ্রুত নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন। তার মানে, জুলাই ২০১৯ পর্যন্ত ১৮ জন শিক্ষকের ইনস্টিটিউটে পাঠদান অব্যাহত রাখা ও বেতন-ভাতা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকে না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই আদেশ মানেনি, বরং মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষকদের কলেজে ফিরে যেতে বলেছে।

নির্দিষ্ট আয়ের ওপর নির্ভরশীল একজন পেশাজীবীর পক্ষে দীর্ঘ ১১ মাস বেতন-ভাতাহীন জীবন যাপন করা কতটা কঠিন ও করুণ, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর্থিক অনটনের সঙ্গে বোঝাপড়ায় ক্লান্ত ও পর্যুদস্ত তিনজন শিক্ষক ইতিমধ্যে কলেজে ফিরে গেছেন। কিন্তু বাকিরা সামাজিক মর্যাদার কথা ভেবে দিন কাটাচ্ছেন আর্থিক দৈন্য ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে।

ইউজিসির পর্যবেক্ষণ, সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত এবং সর্বোপরি আইনি জটিলতার কথা বলে নিজের নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখতে পারতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য ইফতেখার উদ্দীন চৌধুরী। কিন্তু আদালতের স্থগিতাদেশ উপেক্ষা করে তিনি তাঁর পক্ষ ও অবস্থানকেই যেন তুলে ধরলেন।

আইন-আদালতের বাইরে একধরনের সম্মানজনক সমঝোতার জন্য উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করেছিলেন এই শিক্ষকেরা। তাঁরা এমনকি এ প্রস্তাবও দিয়েছিলেন যে আপাতত জীবিকা নির্বাহের স্বার্থে ভবিষ্য তহবিল থেকে নির্দিষ্ট হারে টাকা উত্তোলনের সুযোগ তাঁদের দেওয়া হোক। মামলার রায় যদি তাঁদের বিপক্ষে যায়, তাহলে বেতন-ভাতার সঙ্গে তা সমন্বয় করার সুযোগ তো থাকছেই। কিন্তু উপাচার্য এই আবেদনে সাড়া দেননি এবং মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কোনো ধরনের আর্থিক সুবিধা দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন।

আগেই বলেছি, পূর্বতন উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ১৮ জন শিক্ষককে বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্তীকরণ করে তখন সমালোচিত হয়েছিলেন। স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে। সেই সমালোচনার পেছনে যে যুক্তি ছিল, ইউজিসির তদন্ত ও পর্যবেক্ষণের মধ্যেই তা প্রতিফলিত। কিন্তু এর দায় তো শিক্ষকদের ওপর বর্তায় না। বর্তমান উপাচার্য উদার মানবিকতার পরিচয় দিতে পারতেন অন্তত আদালতের স্থগিতাদেশের প্রতি সম্মান দেখিয়ে। তিনি তা করেননি এবং মামলার জয়-পরাজয়ের ওপরই জোর দিয়েছেন। মামলার নিষ্পত্তি কখন হবে, এর ফলাফলই-বা কী হবে, আমরা জানি না। কিন্তু এটা জানি, এই প্রক্রিয়ায় মানুষের মন জয় করা যায় না। আর্থিক কষ্ট, সামাজিক অবমাননার দিনগুলো দীর্ঘকাল দুঃসহ স্মৃতি হয়ে থাকবে এই শিক্ষক, তাঁদের পরিবার-পরিজন, এমনকি তাঁদের সহকর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছেও।

এবার একজন প্রবীণ শিক্ষকের নিগ্রহের কথা বলি। প্রায় ৪০ বছর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সুনামের সঙ্গে শিক্ষকতা করে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (ইউএসটিসি) ইংরেজি বিভাগে যোগ দিয়েছিলেন অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদ। সম্প্রতি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী অভিযোগ করেছেন, শ্রেণিকক্ষে ‘অপ্রাসঙ্গিকভাবে’ যৌনতা বিষয়ে আলোচনা করে পক্ষান্তরে ছাত্রীদের যৌন হয়রানি করেছেন তিনি।

দীর্ঘ ৪০ বছর যাঁর বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অভিযোগ ওঠেনি, দেশ-বিদেশে যাঁর হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী তাঁদের শিক্ষাজীবনে এমন একজন শিক্ষককে শ্রেণিকক্ষে পেয়েছিলেন বলে এখনো গৌরব বোধ করেন, তাঁর বিরুদ্ধে এ রকম একটি অভিযোগকে অজ্ঞতাপ্রসূত অথবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে বিবেচনা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

অজ্ঞতাপ্রসূত বলছি, কারণ, সাহিত্যের ক্লাসে নর-নারীর সম্পর্ক নিয়ে কথা উঠতেই পারে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যের পাঠ আমাদের এই সম্পর্কবৈচিত্র্যের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ করে। এখন এ বিষয়ে কোনো কথা বলা যাবে না, এমন নিয়ম জারি করা হলে তো চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্লাসে অ্যানাটমি ফিজিওলজির পাঠদানও প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পড়বে! তা ছাড়া মাসুদ মাহমুদের মতো অভিজ্ঞ শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে আলোচনার পরিধি কতটা বিস্তৃত করা দরকার, আর কোথায় সীমারেখা টানা দরকার, সেটুকু বুঝতে পারবেন না, এ কথাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। আবারও বলছি, এই জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দিয়েই দীর্ঘ ৪০ বছর একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুনাম ও মর্যাদার সঙ্গে শিক্ষকতা করেছেন তিনি।

কিছু শিক্ষার্থী নালিশ করেছেন শিক্ষা উপমন্ত্রীর কাছে। মন্ত্রী এ বিষয়ে খতিয়ে দেখতে বলেছেন পুলিশকে। কেন? এ দেশে কি শিক্ষা-বিশেষজ্ঞের অভাব পড়েছে? শিক্ষা বিষয়ে অভিযোগ তদন্তের ভার যদি পুলিশের ওপর ন্যস্ত হয়, তাহলে এ দেশের উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎ কী, তা সহজেই অনুমেয়।

আমরা জানতে পেরেছি, ইউএসটিসির ইংরেজি বিভাগের অনিয়ম দূর করার জন্য কিছু কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন বিভাগীয় উপদেষ্টা মাসুদ মাহমুদ। এতে একটি মহলের স্বার্থে আঘাত লেগেছে। শিক্ষার্থীদের দিয়ে তাঁকে বেকায়দায় ফেলার অপকৌশল নিয়েছে এই মহল।

ঘটনার পর স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন প্রবীণ অধ্যাপক। এদিকে খোদ ইউএসটিসির শিক্ষার্থীরাই এই শিক্ষকের অবমাননার বিরুদ্ধে মিছিল ও মানববন্ধন করেছেন, মানববন্ধন করেছেন তাঁর প্রাক্তন ছাত্ররাও। দেশ ও বিদেশের ৫০৭ শিক্ষক মাসুদ মাহমুদের চরিত্রহননের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছেন।

আমরা মনে করি, শিক্ষক নাজেহালের এই ঘৃণ্য সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক,

কবি ও সাহিত্যিক