'বাঁচিবার একটা উপায় কহ বাহে'

ভূরুঙ্গামারীতে যাওয়ার কথা থাকলেও কাস্তে হাতে ধান কাটতে যাওয়া ছেলেমেয়েরা বামনডাঙ্গাতে নেমে যায়। দুধকুমারের গাঘেঁষা এই গ্রাম পড়েছে নাগেশ্বরী উপজেলায়। আধিয়ার (ভাগচাষি) করম আলী এতটা আশা করেননি। ছাত্ররা তাঁর ধান কেটে দিতে চায় নিজের গরজে। কী তাদের ঠ্যাকা? ছাত্র মতিনের (ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিন) কথা করম আলী শুনেছিল তাঁর বাবার মুখে। পুলিশের তাড়া খেয়ে তাঁদের বাড়িতে লুকিয়ে ছিলেন কৃষক সেজে, মাঠে কিষানদের সঙ্গে কাজ করতেন, হাল বাইতেন চৌহালীর ছাওয়াল ছাত্র মতিন। করম আলী শুনেছেন, টাঙ্গাইলে, ঠাকুরগাঁওয়ে চাষিরা নাকি নিজেদের খেতে নিজেরাই আগুন দিয়েছে; তাই দেখে ছাত্ররা এই গরমে রোজার দিনে ধান কেটে দিতে এসেছে। করম আলী ‘না’ করেননি। তবে দিনের শেষে দলটাকে বিদায় জানানোর সময় একটা জব্বর প্রশ্ন করে বসে, ‘ধান তো কাটি দিলে, কিন্তু বাঁচিবার একটা উপায় কহ বাহে।’ নাই নাই, বাঁচিবার কোনো উপায় নাই। ছাত্ররা বলেনি সে কথা। তবে করম আলী বুঝেছে সেটাই। বারবার এসে কেউ তাঁর ধান কেটে দেবে না। তাঁর মুক্তির পথ তাঁকেই খুঁজতে হবে।

ধর্ষণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলেছে কৃষকের ধান সর্বনাশের খবর। তার সর্বস্বান্ত হওয়ার বাঁশি বেজেই চলছে, যা কেবল নিরো বাজাতে পারতেন জ্বলন্ত রোমের সামনে বসে। খাদ্যমন্ত্রী ধানে দেওয়া আগুনে ঘি ঢেলে বলেছেন যে, এটা সহজ-সরল কৃষকের কাজ নয়। একাত্তরে অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়া কৃষকের বেটা এখন কৃষক, সে ভারতের কৃষকের মতো গলায় দড়ি বা সক্রেটিসের মতো রাষ্ট্রের কথায় রাজি হয়ে বিষের পেয়ালায় চুমুক দেয়নি। নিজের ধানখেতে নিজের হাতে আগুন দিয়েছে। দিয়েছে তো দিয়েছে, আবার তার ছবিও তুলতে দিয়েছে সাংবাদিকদের। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অসহায় কৃষকের এ রকম অখাদ্য আচরণ খাদ্যমন্ত্রীর পছন্দ হয়নি। তিনি নাশকতার গন্ধ পেয়েছেন। নাকের ধরনের ওপর গন্ধ পাওয়ার তারতম্য ঘটে। যার যেমন নাক, তিনি তেমন গন্ধ পান। এসব দেখে-শুনে চেতেছেন সংসদ-সচেতক (হুইপ)। তিনি কৃষকদের নিয়ে মশকরা না করার পরামর্শ দিয়েছেন মন্ত্রীকে। খাদ্যমন্ত্রী কৃষকের মতলব নিয়ে কথা বলে কৃষকদের যতটা না কষ্ট দিয়েছেন, তার চেয়ে অনেক ক্ষতি করেছেন একদমে আরেকটি তথ্য দিয়ে। তিনি বলেছেন, ধান-চাল কিনে রাখব কোথায়? গুদামে জায়গা নেই। এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি কাদের কাছে কী বার্তা পৌঁছে দিলেন, সে প্রশ্ন করে কে তাঁকে পেরেশান করবে? সচেতকও সে প্রশ্ন করেননি!

গত ২৮ মার্চ সচিবালয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির সভা শেষে খাদ্যমন্ত্রী ধান কেনা ও সংরক্ষণ সম্পর্কে সাংবাদিকের অবগত করার সময় বলেছিলেন, ‘২৫ এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত বোরো সংগ্রহ অভিযান চলবে। এরপরও যদি দেখা যায় অ্যাভেইলঅ্যাবেল (ধান আছে) এবং আমাদের গোডাউনে যদি ক্যাপাসিটি (ধারণক্ষমতা) থাকে, তবে আরও কিনব।’ সেদিন বললেন, যদি জায়গা থাকে...আর আজ ধান কেনা শুরু না হতেই বলছেন গুদাম ভরা।

এবার যে ফলন ভালো হবে, সে কথা কি মন্ত্রীদের জানা ছিল না? ওই সভায় খাদ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন কৃষিমন্ত্রী, দুর্যোগ ব্যাবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রীসহ কমিটির অন্যান্য সদস্য আর তাঁদের আমলা-সহযোগীরা। মন্ত্রীরা না হয় নতুন, ‘ভাও বুঝে সারতে পারেন নাই’, কিন্তু আমলারা জানতেন কত ধানে কত চাল হয়। গুদামগুলো প্রস্তুত করা হয়নি কেন। শুধু খাদ্য মন্ত্রণালয় নয়, অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানের অব্যবহৃত-অপব্যবহৃত গুদামের সংখ্যা কিন্তু কম নয়। শুধু বরিশাল বিভাগেই দীর্ঘ এক যুগ ধরে বন্ধ রয়েছে বিভিন্ন জেলার ২৩টি খাদ্যগুদাম (এলএসডি)।

বছর কয়েক আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর তাঁর এক কলামে লিখেছিলেন, ‘জার্মান সহায়তায় অনেক বছর আগে “সগরিব” প্রকল্পের আওতায় ১১৪টি গ্রামীণ গুদাম নির্মাণ করা হয়েছিল কৃষকদের উৎপাদিত শস্য জমা রাখার জন্য। গুদামগুলো বিআরডিবির অধীনে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে বলে শোনা যায়। গরিব দেশে সম্পদের এমন অপচয় দুঃখজনক। এই ১১৪টি গুদাম মেরামত করে ব্যবহারোপযোগী করা হোক এবং বাজেটে এর জন্য বরাদ্দ রাখা হোক। “গ্রামীণ বিপণন সংস্থা” নামে একটি নতুন সংস্থা গঠন করে গুদামগুলো ওই সংস্থার কাছে হস্তান্তর করা যায়। একটি দীর্ঘমেয়াদি সুষ্ঠু পরিকল্পনার আওতায় পর্যাপ্ত পল্লি গুদাম নির্মাণ করা যায়। সমবায়ভিত্তিক পল্লি বিপণনপ্রক্রিয়া গড়ে তুলতে পল্লি গুদামগুলো সহায়ক ভূমিকা রাখবে।’ এই হিসাবের বাইরে তদানীন্তন আইআরডিপির সঙ্গে কেয়ারের করা খাদ্যগুদাম, বিআরডিবির পাইলট প্রজেক্টের অধীনে তৈরি গুদামগুলো কথায় গেল।

এ ছাড়া বিএডিসি, তথা কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের অপহৃত–অব্যবহৃত লিজে ফেলে রাখা গুদামের কথা লিখলে কাগজে কুলাবে না। বিএডিসির অমুক পরিত্যক্ত রেস্ট হাউস ও গুদাম তমুকের দখলে—এমন খবর এখনো ছাপা হয়। নিজেদের মধ্যে একটু সমন্বয় করলে রাখার জায়গা নিয়ে কোনো হায়-আফসোস থাকার কথা নয়।

তারপরও একটা সরকার যদি চায়, তাহলে ধান কৃষকের বাড়িতেও রাখা যায়। যে কৃষক যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে আমাদের গদিতে বসিয়েছে, সে কৃষক সামান্য কটা ধান মেরে দিয়ে পালিয়ে যাবে না, যে বিনা প্রশ্নে অস্ত্র রাজকোষাগারে জমা দিতে পারে, সে আর যা–ই হোক, ধান চুরি করবে না।

কৃষককে এখনই বাঁচিবার একটা উপায় কহিতে হবে। সেটা কী হতে পারে? অবিলম্বে সব ধরনের ধান-চাল আমদানি বন্ধ করতে হবে। কৃষক যতটা ধান বেচতে চায়, তার সবটাই ন্যায্য মূল্যে কিনে নিতে হবে। গুদামের সামনে বসে লাল সালু টাঙিয়ে ধান কেনার মহরত করলে কৃষক ধানের দাম পাবে না—এটা খোদ কৃষিমন্ত্রী স্বীকার করেছেন। ট্রাক নিয়ে তাদের হাটে হাটে যেতে হবে। সরকার না পারলে চাতালমালিকদের এই কাজে লাগানো যায়। ধান কেনার জন্য কম সুদে ঋণ দিলে তারা কালকেই মাঠে নেমে যাবে। তাতে আখেরে চাতালমালিকদের লাভ হবে, তারা আরও মোটা হবে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় কৃষককে বাঁচানোর আর কোনো দরজা তো খোলা রাখা হয়নি।

ন্যায্য মূল্যে ধান কিনলে চালের দাম বেড়ে যাবে বলে যাঁরা যুক্তি দেখাচ্ছেন, তাঁদের জন্য প্রথম আলোর পাঠক তরিকুল ইসলামের পাঠানো এই হিসাবটা এখানে বিবেচনার জন্য পেশ করা হলো:

যদি ধানের মণ ৬০০ টাকা হয়, তাহলে ১ মণ চালের দাম কত? ১ মণ (৪০ কেজি) ধান থেকে কমপক্ষে ২৮ থেকে ৩০ কেজি চাল হয়। ধরুন, ১ মণ ধান থেকে ৩০ কেজি চাল তৈরি করতে খরচ লাগে ১০০ টাকা, তাহলে ৩০ কেজি চালের দাম পড়ে ৬০০ + ১০০ = ৭০০ টাকা। যদি ৩০ কেজি চাল ক্রেতা পর্যন্ত পৌঁছে দিতে আরও ১০০ টাকা খরচ হয়, তাহলে ৩০ কেজি চালের দাম (৬০০ + ১০০ + ১০০) = ৮০০ টাকা হলে ১ কেজি চালের দাম = ৮০০/৩০ = ২৬.৬৬ টাকা, তাহলে এক মণের দাম ২৬.৬৬ X ৪০ = ১০৬৬.৬৬ টাকা।’ অতএব, ১ মণ চালের দাম পড়ে ৪০ ভ্যাট ১৫% = ১৬০ টাকা, তাহলে ১ মণ চালের মোট দাম পড়ে ১০৬৬.৬৬ + ১৬০ = ১২২৬ টাকা। বাংলাদেশে বাজার থেকে ১ মণ চাল কিনতে লাগে কমপক্ষে ২৪০০ টাকা। ১ মণ চাল উৎপাদন করে ক্রেতার কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত খরচ পড়ে ১২২৬ টাকা, কিন্তু বাজার থেকে আমাদের (সাধারণ মানুষের) ১ মণ চাল কিনতে হয় কমপক্ষে ২৪০০ টাকায়। মধ্যবর্তী থাকে ২৪০০-১২২৬ = ১১৭৪ টাকা। আমার প্রশ্ন ১১৭৪ টাকা যায় কোথায়?

আমাদের উচিত ধান নিয়ে আর ধানাইপানাই না করে দাম দিয়ে ধান কেনার ব্যবস্থা করা।

(জনাব ইব্রাহিম খালেদ ও ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিনের নাম ছাড়া অন্যান্য নাম ও স্থানের নাম বদলিয়ে দেওয়া হয়েছে)

গওহার নঈম ওয়ারা: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাবিষয়ক লেখক ও গবেষক।
[email protected]