মজুরি বাড়ানোর দাবি যৌক্তিক

রোজ ভোরে দুগ্ধফেননিভ শয্যায় অর্ধ-উন্মিলিত চোখ নিয়ে যাঁরা চায়ের কাপে হালকা ফুঁ এবং আলতো চুমুক দিতে দিতে ‘বেড টি’র মৌতাত উপভোগ করেন, তাঁদের মধ্যে খুব কম লোকই আছেন যাঁরা বলতে পারবেন এই চা কত মানুষের শ্রমে উৎপন্ন হয় বা তাঁদের জীবনমান কোথায় ঠেকে আছে। অথবা তঁাদের শ্রমের মজুরি কত।

চা উৎপাদনের সঙ্গে যে এই খাতের শ্রমিকদের শত শত বছরের বঞ্চনার ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে, বহু শ্রমিকের রক্তে যে ইতিহাস ভিজে আছে, সে কথা অধিকাংশেরই অজানা।

ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখিয়ে দক্ষিণ ও মধ্য ভারত থেকে হাজার হাজার মানুষকে আসাম ও বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে আনা হয়েছিল। তাঁদের গহিন জঙ্গলে চা-বাগান তৈরির কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। বিনিময়ে মালিকেরা তঁাদের নিয়মিত পেটপুরে খেতেও দিতেন না। এ অবস্থায় তাঁরা ‘দেশে’ ফিরে যাওয়ার জন্য ‘মুল্লুকে চলো’ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। এই লক্ষ্যে ১৯২১ সালের ২০ মে তঁারা চাঁদপুর নদীবন্দরে গিয়ে স্টিমারে উঠতে চেয়েছিলেন। গোর্খা সৈন্যরা এই শ্রমিকদের স্টিমারঘাট ও রেলস্টেশনে গুলি করে মেরেছিল।

সেই থেকে ২০ মে মহান ‘মুল্লুকে চলো’ দিবস পালন করা হচ্ছে। ফি বছর এই দিবসে চা-শ্রমিকদের ভাগ্য ফেরানোর প্রত্যয় ঘোষণা করা হচ্ছে, নানা রকম দাবি তোলা হচ্ছে, কিন্তু চা-শ্রমিকদের অবস্থার তেমন বদল হয়নি। তাঁরা যে তিমিরে ছিলেন, এখনো সেই তিমিরেই আছেন। তাঁদের পুত্ররা হয়েছেন পিতার চেয়ে দরিদ্র। তাঁদের জীবনে আসেনি আশাবহ পরিবর্তন।

এ বছর ‘মুল্লুকে চলো’ দিবসে চা-শ্রমিকেরা সাত দফা দাবি তুলেছেন। দাবির মধ্যে আছে চা-শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ৪০০ টাকা নির্ধারণ, সপ্তাহে ৫ কেজি চাল রেশন দেওয়া, প্রতি মাসে ২ কেজি চা-পাতা দেওয়া, নিরিখের অতিরিক্ত কাঁচা পাতার দ্বিগুণ মূল্য ধরা, চা-শ্রমিকের সন্তানদের উচ্চশিক্ষার ব্যয়ভার বহন করা, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে চা-শ্রমিকের সন্তানদের জন্য কোটা বরাদ্দ করা ইত্যাদি।

চা-শ্রমিকদের প্রতিটি দাবি যেকোনো বিবেকবান মানুষের কাছে ন্যায়সংগত বলে মনে হওয়ার কথা। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় কোনো বিবেচনাতেই দৈনিক মজুরি ১০২ টাকা হতে পারে না। কিন্তু এই মজুরি দেওয়া হচ্ছে শ্রীমঙ্গল ও আশপাশের চা-বাগানে। এ অবস্থা থেকে কোম্পানিগুলোকে বেরিয়ে আসতে হবে।

চা-শ্রমিকেরা মৌলিক চাহিদা পূরণে দীর্ঘদিন ধরে মজুরি বৃদ্ধি, ভূমি অধিকার, বাসস্থান, চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নয়নসহ বিভিন্ন দাবি জানিয়ে আসছেন। এসব বাস্তবায়ন না হওয়ায় তাঁরা কার্যত মানবেতর জীবনযাপন করে যাচ্ছেন। এখন দেশ অনেক এগিয়ে গেছে। চা-বাগানের এই শ্রমিকেরা যদি এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে না পারেন, তাহলে দিন শেষে দেশেরই ক্ষতি।