ওয়াসা, ন্যাড়া ও ভিস্তিওয়ালাদের কথা

‘রাজা’ বিরাট টেনশনে। সে ইটের পাঁজার ওপর বসা। হাতে ‘ঠোঙা ভরা বাদাম ভাজা’। সেগুলো সে ‘খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না’। রাজার কথা হলো, ন্যাড়া বেলতলায় যায়, তা সবাই জানে। ‘কিন্তু প্রশ্ন, ক’বার যায়?’ এই প্রশ্নের জবাব কোনো পণ্ডিত দিতে পারেনি। দিয়েছিল, ‘রোগা এক ভিস্তিওয়ালা’। সে বলেছিল, ন্যাড়া বেলতলা যায় ‘হরেদরে হয়তো মাসে নিদেনপক্ষে পঁচিশবার’। শুনে রাজা বিরাট খুশি।

এই হলো সুকুমার রায়ের ‘ন্যাড়া বেলতলা ক বার যায়’ ছড়ার ভেতরকার গল্প। এই একুশ শতকে নিরীহ ঢাকাবাসী হলো এই ছড়ার ‘ন্যাড়া’। আর ‘ভিস্তিওয়ালা’ হলো ঢাকা ওয়াসা (কিংবা বলা যায় ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান)।

তাকসিম খান ওয়াসার পানিকে ‘শতভাগ সুপেয়’ বলেছেন এবং তা শুনে এক ভদ্রলোক তাঁকে ওয়াসার পানির শরবত খাওয়াতে চেয়েছেন—এটা পুরোনো খবর। নতুন খবর হলো, যে এমডি তাকসিম খান ওয়াসার পানিকে ‘শতভাগ সুপেয়’ বলেছিলেন, সেই তিনিই তাঁর প্রতিবেদনে বলেছেন, ঢাকা ওয়াসার ১০টি জোনের ৫৯ এলাকার পানিতে ময়লা থাকার প্রবণতা বেশি। আরও নতুন খবর হলো, ওয়াসার গাফিলতি নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে সংসদীয় কমিটি তাকসিম খানকে ডেকেছিলেন। তাদের সে তলবকে মিস্টার খান পাত্তা দেননি। তিনি কমিটির সামনে যাননি, কাউকে তাঁর পক্ষ থেকে সেখানে পাঠানওনি। এতে কমিটি ক্ষুব্ধ হয়েছে। কমিটি ঢাকায় সুপেয় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে সিটি করপোরেশনের আদলে ঢাকা উত্তর ওয়াসা এবং ঢাকা দক্ষিণ ওয়াসা গঠন করার সুপারিশ করেছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনও একই ধরনের প্রস্তাব দিচ্ছেন। তিনিও মনে করছেন, ওয়াসাকে দুই ভাগ করলে ঢাকার মানুষ ঠিকঠাক পানি পাবে। সত্যি সত্যি সেই পানি দিয়ে লেবুর শরবত বানিয়ে খাওয়া যাবে।

মোগলদের সময় বা তারও পরে, ব্রিটিশ আমলে দিল্লি বা কলকাতার মতো এই শায়েস্তা খানের ঢাকায়ও চামড়ার মশকে পানি ভরে তা বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিতেন একশ্রেণির লোক। মাস শেষে তাঁরা পানির বিল নিয়ে যেতেন। মশক কাঁধে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় পানি ফেরি করেও বেড়াতেন তাঁরা। ওই মশককে বলত ‘ভিস্তি’ আর পানি বিলানোর কাজ করা লোকগুলোকে বলত ‘ভিস্তিওয়ালা’। অবশ্য অনেক সময় ‘ভিস্তিওয়ালা’ বোঝাতেও শুধু ‘ভিস্তি’ বলা হয়। সে সময় কলকাতা এবং ঢাকাতে রীতিমতো ‘ভিস্তিপল্লি’ ছিল। কবি শামসুর রাহমান শৈশবের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, তাঁদের বাড়িতে পানি দিয়ে যেত ভিস্তিওয়ালা। রবীন্দ্রনাথের ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতায় রাস্তার ধুলো মারতে এসেছিল ‘মশক কাঁখে একুশ লাখ ভিস্তি’। আর চৌসার যুদ্ধে পরাজিত সম্রাট হুমায়ুনের জীবন বাঁচানোর পুরস্কার হিসেবে ভিস্তিওয়ালা নিজামকে এক দিনের বাদশাহ বানানোর কথা তো ইতিহাসে আছেই।

দিন বদলেছে। এখন আধুনিক ঢাকায় আধুনিক ভিস্তিওয়ালা। তারা পাইপলাইনে বাড়ি বাড়ি পানি দেয়। মাঝেমধ্যে শুধু পানি না, তার সঙ্গে আরও অনেক কিছু দেয়। অনেক সময় ট্যাপের পানির সঙ্গে ‘ওয়াক থু!’ ও আসে। আগের আমলে কোনো ভিস্তিওয়ালার সরবরাহ করা পানি খারাপ হলে তাকে বাদ দিয়ে আরেকজনের কাছ থেকে পানি নেওয়ার সুযোগ ছিল। এখন সে কায়দা নাই। এখন মনোপলি কারবার। পানি ছাড়া যেহেতু বাঁচার উপায় নাই এবং ভিস্তিওয়ালা যেহেতু একজনই, সেহেতু ভিস্তিওয়ালা যে পানি দেবে, সেই পানিই খাওয়া লাগবে। কোনো মোচড়ামুচড়িতে কাজ হবে না।

ঢাকাবাসী যে মোচড়ামুচড়ি করবে না, তারা যে ‘নিদেনপক্ষে পঁচিশবার’ বেল তলায় যাওয়া ন্যাড়া, তা ঢাকা ওয়াসা এবং তার প্রধান ভিস্তিওয়ালা (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) তাকসিম এ খান ভালো করেই জানেন। এই কারণে তিনি নগরবাসীকে ওয়াসার পানিতে নাকানিচুবানি খাইয়ে আসছেন।

সম্প্রতি টিআইবি বলেছিল, ওয়াসার পানি ৯১ শতাংশ গ্রাহকই ফুটিয়ে খান। বাসাবাড়িতে পানি ফোটাতে বছরে ৩৬ কোটি ৫৭ লাখ ৩৭ হাজার ঘনমিটার গ্যাস পোড়াতে হয়। এতে পাবলিকের খরচ হয় ৩৩২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। এ কথা শোনার পর এমডি সাহেবের মেজাজ বিগড়ে গিয়েছিল। তিনি ওই প্রতিবেদনকে ‘আজেবাজে কথা’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছিলেন ‘আমাদের পানি ১০০ ভাগ সুপেয়। কাজেই আপনি গ্যাস পোড়াচ্ছেন, এটা তো আমার কাছে আশ্চর্য কথা!’ ওই দিন তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা বিরাট উদ্যোগ নিয়ে পাইপলাইনগুলো বদলাচ্ছি। ২০২১ সালে আমরা বলব যে আসেন, “ট্যাপ ওয়াটার” খান।’ তিনি বলেছিলেন, তিনি নিজেও ট্যাপের পানি খান। এই কথা শুনে জুরাইনের নাগরিক অধিকার বাস্তবায়ন পরিষদের সমন্বয়কারী মিজানুর রহমান বউ–ছেলে–মেয়ে সবাইকে নিয়ে ওয়াসা ভবনে চলে এসেছিলেন। তিনি এমডি সাহেবকে ওয়াসার পানির শরবত খাওয়াতেও চেয়েছিলেন।

ওয়াসার পানিকে ‘শতভাগ সুপেয়’ বলা তাকসিম সাহেবের এখন নিজের বানানো প্রতিবেদন নিয়ে কী বলার আছে, তা জানা যায়নি। মিডিয়াকে তিনি এ নিয়ে কিছু বলবেন কি না, তা পরিষ্কার নয়। যেখানে সংসদীয় কমিটিকেই তিনি পাত্তা দেন না, সেখানে মিডিয়া–ফিডিয়ার লোকজনকে তিনি ‘গুনবেন’ কোন দুঃখে! সংসদীয় কমিটির তলবকে পাত্তা না দেওয়ার মধ্য দিয়ে উত্তরাধুনিক ‘ভিস্তিওয়ালা’ তাকসিম সাহেবের ক্ষমতা আন্দাজ করা যায়।

ঠান্ডা মাথায় ভাবলে বোঝা যাবে ওয়াসাকে দুই ভাগ করার ভাবনা এক দিনে আসেনি। এর জন্য ওয়াসা নিজেই দায়ী। ঢাকাবাসীকে বছরের পর বছর ‘শতভাগ সুপেয়’ পানির নামে মূত্রবিষ্ঠামিশ্রিত পানি খাওয়ানো হয়েছে। বছরের পর বছর তাঁরা সত্যিকারের সুপেয় পানির জন্য হাহাকার করেছেন। যখনই ওয়াসার কাছে তঁারা অভিযোগ তুলেছেন, তখনই নানা কায়দায় তাঁদের তাইরে-নাইরে বুঝ দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ‘ন্যাড়া’র মতোই তাঁরা বারবার ওয়াসার ‘বেলতলায়’ গেছেন এবং যথারীতি মাথা ফাটিয়ে বাড়ি ফিরেছেন।

এখন কথা হলো ওয়াসাকে দুই ভাগ করা হলে কি তা ঢাকাবাসীর কাজে আসবে? এতে কি তঁারা ওয়াসার নাকানিচুবানি থেকে নিষ্কৃতি পাবেন? উপলব্ধির অন্তর্লোকে এ রকম একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন বারবার ফুচকি মারছে।

সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর জে্যষ্ঠ সহ–সম্পাদক