বিত্তশালী বাংলাদেশ এখন চালের ব্যাপারী

মহাসড়কের পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে চালক একটু দূরে ইটের পাঁজার আড়ালে গেলেন। আমি রাস্তায় পায়চারি করছিলাম। মাঠের ভেতর থেকে একজন লুঙ্গি-গেঞ্জি পরা মধ্যবয়সী ব্যক্তি উঠে এলেন সড়কে। মধ্যদুপুর। আগুনের হলকার মতো গরম। সালাম দিয়ে গামছায় ঘাম মুছে অযাচিতভাবে তিনি বললেন, ‘আপনি আমার পোঁদে লাথি দিবেন, আর আমি দাঁত বাইর কইরা হাসব।’

একটু বিব্রত বোধ করলাম। আমার কোনো লেখায় বা টিভি আলোচনায় অপরিচিত মানুষটি আহত হয়ে থাকবেন। তিনি ধোপদুরস্ত কাপড় পরা ‘ভদ্রলোক’ নন, তাঁর ভাষায় অশিষ্ট শব্দ থাকা স্বাভাবিক। আমি তাঁর ঝাঁজালো কথার মানে খোলাসা করতে বললাম। জানতে চাইলাম, আমার অপরাধ কোথায়?

তিনি শান্ত হলেন। বললেন, ‘দোষ আপনার নয়। দোষ আমার কপালের।’ তিনি তাঁর কপালে আঙুলের মৃদু আঘাত করে বললেন, দোষ বাংলাদেশের আর দেশের ব্যাংকের। তারপর তিনি তাঁর নিজের এবং তাঁর মতো লাখ লাখ কৃষকের মর্মযাতনার কাহিনি মিনিট দশেকে শোনালেন।

তাঁর ওই কাহিনি শোনার দু-তিন দিন পরই এক সুখবর পড়লাম পত্রিকায়। সে এক অতি আনন্দের সংবাদ, বিশেষ করে তাঁদের জন্য, যাঁরা আমাদের মতো চাষাভুষা নন। খুশিতে মনটা ভরে গেল।

খবরটি হলো ব্যাংকের ঋণখেলাপিদের সম্পর্কে। ব্যাংক থেকে যাঁরা শত শত কোটি টাকা ঋণ নিয়ে, টাকাটা বাপ-দাদার অথবা নিজের মনে করে আর ফেরত দেওয়ার নাম মুখে আনেননি, তাঁদের এবং তাঁদের উত্তরাধিকারীদের জন্য অপূর্ব সুখবর। বাংলার মাটিতে বিভিন্ন ব্যাপারে যা ঘটে, তার অনেক কিছুই ঐতিহাসিক অর্থাৎ নজিরবিহীন। বাংলাদেশ ব্যাংক ১৬ মে এক ঐতিহাসিক ফরমানে জানিয়ে দিয়েছে, বঙ্গীয় ঋণখেলাপিরা তাঁদের বকেয়া ঋণের ২ শতাংশ টাকা জমা দিয়েই ঋণ নিয়মিত করতে পারবেন। এতে সুদের হার হবে ৯ শতাংশ এবং ১০ বছরের মধ্যে বাকি টাকা শোধ করতে পারবেন। আরও এক বছর গ্রেস পিরিয়ডও তাঁদের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে।

বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। ঋণখেলাপিদের পত্রপত্রিকা ব্যাংক ডাকাত অভিধায় আখ্যায়িত করে থাকে। অনেক ভাগ্যবান ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করে হতভাগা জন্মভূমি ছেড়ে চিরদিনের জন্য পগারপার হয়েছেন। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে মোগল সম্রাটদের মতো জীবনযাপন করছেন। পরম করুণাময় রাষ্ট্র যে দয়া ঋণখেলাপিদের দেখাচ্ছে, তাতে যে কোনো ফায়দা হবে, সে ভরসা বিশেষজ্ঞরা যেমন করেন না, জনগণের তো করার প্রশ্নই আসে না। কারণ, ২০১৫-তে ১১টি বড় ঋণখেলাপিকে বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়েছিল, তাদের দুটি ছাড়া কেউ টাকা পরিশোধ করেনি।

যে অপরাধ করলে একজনের থাকার কথা শ্রীঘরে এবং তাঁর বাড়িঘর হওয়ার কথা নিলাম, তিনি এ সমাজে চলেন বুক ফুলিয়ে। বাড়িঘর, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক হওয়া তো দূরের কথা, করেন আরও কয়েকটি বাড়ি ও বাগানবাড়ি—দেশে ও ভিনদেশে। ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ছাড়া এ ধরনের ঋণ বিতরণ হতে পারে না। তাঁদের কারও কবজায় হাতকড়া পড়েছে, এমন দৃষ্টান্ত বিরল। খেলাপি ঋণের কারণে বিপুল বিত্তের অধিকারী তাঁরাও। এ এক মনোরম চক্র। করুণাময় রাষ্ট্র যদি দেশপ্রেমিকদের ঐতিহাসিক সুযোগ দেয়, তাতে কারও গা জ্বালা করার কারণ নেই। সচেতন নাগরিকদের মন খারাপ হওয়ার কারণ অন্যখানে। রাষ্ট্র একজনকে করবে দয়াদাক্ষিণ্য, আরেকজনকে করবে জুলুম। একজনের জন্য রাষ্ট্র দাতা কর্ণ, অথবা হাতেমতাই, আরেকজনের ক্ষেত্রে সাক্ষাৎ আজরাইল বা যমদূত।

মোটেই অবিশ্বাস্য নয়, যে রিপাবলিকে হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে মেরে দিলে কিছুই হয় না, সেই দেশেই ১১ হাজার ৭৭০ টাকা বকেয়া পড়ায় একজন কৃষককে হাতকড়া পরিয়ে থানায় নিয়ে হাজতে ঢোকানো হয়। হাজত থেকে জেলখানা। সপ্তাহখানেক পার করে জামিনে ছাড়া পাওয়ার পর হার্ট অ্যাটাকে পরপারে যাত্রা।

এই মুহূর্তে বাংলাদেশে হাজার হাজার কৃষকের বিরুদ্ধে জারি রয়েছে সার্চ ওয়ারেন্ট। কেউ জেলখানায়, কেউ পলাতক বাড়িঘর ছেড়ে। কৃষিঋণ নিয়ে কারও বকেয়া ৫০-৬০ হাজার টাকা, কারও-বা কয়েক লাখ। কৃষক ঋণ নিয়ে নানা অনিবার্য কারণে টাকা পরিশোধ করতে পারেন না। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলহানি হতে পারে। বাজারে কৃষিপণ্যের দাম কম। তখন তাঁর মাথায় হাত। ঋণ পরিশোধ তো দূরের কথা, বউ-ছেলেমেয়েকে দুবেলা খাওয়ানোর সংগতিও থাকে না।

সরকার বলবে, আমরা তো কৃষককে ঋণ দিচ্ছি। অবশ্যই দিচ্ছে। বর্তমান অর্থবছরেও ২২ হাজার কোটি টাকা কৃষিঋণ বরাদ্দ ছিল। সে হিসাবে প্রতিটি উপজেলায় ৪০-৪৫ কোটি টাকা কৃষিঋণ বিতরণের কথা। আমি ব্যক্তিগতভাবে কয়েকটি উপজেলার কৃষি ব্যাংক ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের শাখায় খোঁজ নিয়ে দেখেছি,৫-১০ কোটি টাকার বেশি ঋণ কৃষকেরা পাননি।

সরকারের ভালো উদ্যোগের মধ্যেও নানা রকম ব্যাপার-স্যাপার আছে। পেঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ, ধনে প্রভৃতি মসলার চাষিদের ৪ শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়া হয়ে থাকে। যেহেতু সেই ঋণের সুদের হার কম, কর্তাব্যক্তিদের আত্মীয়স্বজন ও প্রিয়জনেরা মসলা চাষের কথা বলে ওই ঋণ নিয়ে অন্য কাজে খাটান। ছোট ও মাঝারি কৃষকদের পক্ষে মসলার ঋণ পাওয়া খুবই কঠিন। বিষয়টি তদন্ত করে দেখার কেউ নেই।

পাটচাষি ও ধানচাষিদের বেদনা ও বিড়ম্বনার কথা প্রতিদিন পত্রিকায় আসছে। ন্যায্য দাম না পাওয়ায় কৃষক তাঁর পাকা ধানে মই না দিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছেন মাঠে। মন্ত্রী মহোদয়েরা বলছেন, বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। চালের তো কোনো অভাবই নেই। গুদামে রাখার জায়গা নেই বলে কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা সম্ভব নয়। উচ্চকণ্ঠে বলা হচ্ছে—বাংলাদেশ এখন চালের ব্যাপারী। কারণ, সে চাল রপ্তানি করছে। অন্যদিকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকায় মানুষ জানতে পারছে হাজার হাজার লরিবোঝাই চাল ঢুকছে বাংলাদেশে। অর্থাৎ বাংলাদেশ লাখ লাখ টন চাল আমদানি করছে। কোনো দেশ একই সময় একই জিনিস রপ্তানি করছে এবং আমদানি করছে, এমন ঘটনা মানবজাতির ইতিহাসে বিরল।

জিয়াউর রহমানের শেষ দুই-তিন বছর বাংলাদেশ প্রথম কিছু উন্নত মানের চাল রপ্তানি করেছিল। সে খবর শুধু দেশের কাগজে নয়, টাইম, নিউজউইক, ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ, ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর প্রভৃতি কাগজে বড় করে বেরিয়েছিল। কিন্তু তখনো দেশের ২০ শতাংশ মানুষ দুবেলা ভাত খেতে পেত না।

যদি সত্যি বাংলাদেশ চাল রপ্তানিকারক দেশ হয়ে থাকে, সে কৃতিত্ব দেশের কৃষকের, কোনো দল বা সরকারের নয়। সুস্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট ও সুদূরপ্রসারী কৃষিনীতি ছাড়া খাপছাড়াভাবে কিছু পণ্য রপ্তানি করে জাতীয় অর্থনীতির স্থায়িত্বশীল উন্নতি ঘটানো সম্ভব নয়। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে কৃষি খাতে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে গত তিন দশকে। কৃষিতে সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে। এ খাতে যত বেশি বিনিয়োগ হবে, তত বেশি উপকার। কৃষিতে জিডিপির ১ শতাংশ বেশি বিনিয়োগ হলে দারিদ্র্য কমবে ৩ শতাংশ। অন্যদিকে শিল্পে ৭ শতাংশ বিনিয়োগে দারিদ্র্য কমে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বা আধা পারসেন্ট।

কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষিতে বিনিয়োগ না বাড়ালে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব কমানো সম্ভব নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে বাংলাদেশের কৃষক পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে চাষাবাদে পরিবর্তন আনছেন, এখন দরকার সময়োপযোগী কৃষিনীতি। টেকসই মধ্যম আয়ের দেশ হতে হলে পরিবর্তন আনতে হবে কৃষিনীতিতে। আত্মতৃপ্তির জন্য সাময়িক চালের ব্যাপারী হলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ খাদ্যসংকট মোকাবিলা করতে পারবে না।

ঋণ নিয়ে যাঁরা সাদ্দাদের বালাখানা বানিয়েছেন, বাগানবাড়ি করেছেন, ছেলেমেয়ে ও অনাগত নাতি-নাতনিদের জন্য দেশে-বিদেশে সুব্যবস্থা করে রেখেছেন, তাঁদের জন্য রাষ্ট্রের গভীর মমতা থাকলে বলার কিছু নেই। গৌরী সেনের টাকা দরিয়ায় ঢালতে চাইলে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু কৃষকের যে হাত ফসল ফলায়, সেই হাতে কথায় কথায় হাতকড়া পড়লে আমাদের ঘোর আপত্তি। আমাদের প্রত্যাশা, রাষ্ট্র তার সাংবিধানিক ও নৈতিক দায়িত্ব পালন করবে।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক