মোদি-শাহ জুটির নির্বাচনী কেরামতি

মোদি-শাহ জুটির প্রথম ‘অবদান’ পুরো প্রচারাভিযানকে তাঁরা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আদলে পাল্টে দিয়েছেন। ছবি: এএফপি
মোদি-শাহ জুটির প্রথম ‘অবদান’ পুরো প্রচারাভিযানকে তাঁরা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আদলে পাল্টে দিয়েছেন। ছবি: এএফপি

ভারতের নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে অনুমান করা নিরাপদ হবে না এখন। প্রয়োজনও নেই হয়তো। আর মাত্র দুদিন পরই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। তবে প্রায় দুই মাসব্যাপী চলা নির্বাচনী প্রচারাভিযান নিয়ে কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরাই যায়।

এই নির্বাচনের প্রধান চরিত্র ছিলেন আসলে বিজেপির অমিত শাহ। নরেন্দ্র মোদি তাঁর নির্দেশনামতো অভিনয় করে গেছেন। স্বাধীন ভারতে নির্বাচনী সংস্কৃতির বয়স ৬৭ বছর। কিন্তু এর আগে ভারতীয় রাজনীতিতে এত ভালো নির্বাচনী জুটি আর আসেনি। এই জুটির প্রথম ‘অবদান’ পুরো প্রচারাভিযানকে তাঁরা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আদলে পাল্টে দিয়েছেন। অথচ নির্বাচন হয়েছে পার্লামেন্টের জন্য এবং ৫৪৩ আসনে প্রায় আট হাজার প্রার্থী ছিলেন।

ভোটের জন্য প্রচারকালে অমিত শাহকে সব সময়ই মনে হয়েছে, তাঁরা ক্ষমতার জন্য লড়ছেন। এক বিন্দুও কম কিছু নয়। এই দলের সমগ্র উদ্যম নিযুক্ত ছিল বিজয়ের জন্য। অন্তত তিনটি রাজ্যে (মহারাষ্ট্র, আসাম, বিহার) অমিত শাহ প্রায়শত্রু দলকে মৈত্রী জোটে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন, যেখানে যতটুকু ছাড় দেওয়া দরকার ততটুকু দিয়ে।

অন্যদিকে, কংগ্রেস তাদের ‘প্রায়মিত্র’ হিসেবে চিহ্নিত অনেক দলকে কাছে টানা তো দূরের কথা,বরং তাদের বিরুদ্ধে প্রার্থী দিয়ে লড়েছে। উত্তর প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, দিল্লিসহ বহু স্থানে এটা ঘটেছে। গত পাঁচ বছর সোনিয়া গান্ধী ও রাহুল গান্ধী অনেক জাতীয় নেতার সঙ্গে হরহামেশা হাসি হাসি মুখে বৈঠক করে দেশকে বার্তা দিতেন,তাঁরা একই রাজনৈতিক সত্তা। কিন্তু কার্যত প্রায় অধিকাংশের বিরুদ্ধে কংগ্রেস নির্বাচনে প্রার্থী দিয়েছে। আম আদমি পার্টি থেকে তৃণমূল কংগ্রেস, কেউ বাদ যায়নি এই অদ্ভুত আচরণে।

কংগ্রেসপন্থী বুদ্ধিজীবীরা বরাবর বিজেপির বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্যের তাগিদ দিলেও রাহুল একা একাই প্রচারসভাগুলোয় এক কোটি নতুন চাকরির আশ্বাস নিয়ে ঘুরেছেন। এতে বছর দুয়েক আগের চেয়ে তাঁর ভাবমূর্তি এখন অনেক সবল বটে, কিন্তু দলের সব কর্মীকে তিনি নির্বাচনী কাজে নামাতে পেরেছেন বলে মনে হয়নি, মোদির হয়ে অমিত শাহ যেটা করেছেন।

চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান এবং উদীয়মান পরাশক্তি চীনের উত্তপ্ত নিশ্বাসের সামনে বিজেপি ভারতমাতার কোটি কোটি সন্তানের কাছে মোদিকে তুলে ধরেছিল এক পুরুষালি শক্তিশালী ভাবমূর্তিতে। বিপরীতে, রাহুলের ইমেজ ছিল অনেকটা একজন সুশীল বুদ্ধিজীবীর মতো, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ-তরুণীদের যতটা মুগ্ধ করেছেন, গ্রামের মানুষদের কাছে ততটাই অবোধ্য থেকে গেছেন।

নির্বাচনে অনেক শিক্ষিত তরুণ-তরুণী নিজে থেকেই কংগ্রেসকে সহায়তা করতে আগ্রহ দেখিয়েছেন বিজেপিভীতির কারণে। কিন্তু তাঁদের জন্য হতাশার কারণ ঘটেছিল। প্রচারে কংগ্রেস এবং অন্যান্য বিরোধী দলের কোনো সমন্বিত পরিকল্পনা ছিল না। ছিল না বহুজাতিক চরিত্রের বৈচিত্র্যময় বিষয়সূচি। কেবল ব্যক্তি মোদির দুর্বল বিরোধিতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে একই ধাঁচের পুরোনো আহাজারিই তাদের সম্বল ছিল।

ভারতে ২৯টি রাজ্য এবং ৭টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল রয়েছে। এটা আসলেই ৩৬টি দেশের নির্বাচনের মতো। বিজেপি ঠিক সেভাবেই প্রচার পরিকল্পনা সাজিয়ে রেখেছিল। প্রায় প্রত্যেক রাজ্যে স্থানীয় কোনো না কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিরোধীদলীয় চরিত্রকে দলে টেনে তারা অন্তর্ঘাত চালিয়েছে। পাশাপাশি নিজেকে ৩৬ ভাবে উপস্থাপন করতে চেয়েছে। তাদের প্রচারকাজও শুরু হয়েছিল কংগ্রেসের অনেক আগে।

যেমনটি করেছিল বামপন্থীরাও। নির্বাচনের কয়েক মাস আগে থেকেই কৃষক-শ্রমিকের রুটিরুজির বিষয়গুলো নিয়ে প্রচারাভিযানে নামে তারা। কিন্তু কাশ্মীরের মাত্র একটি ‘আত্মঘাতী হামলা’কে ব্যবহার করে বিজেপি সেগুলোকে অকার্যকর করে দিতে পেরেছে। অমিত শাহ আবারও দেখালেন, বামেরা কৃষক-শ্রমিকের স্বার্থ যতটা বোঝে, জাতীয়তাবাদী ও ধর্মীয় উগ্রতা মোকাবিলার কৌশলে ততটা স্বচ্ছন্দ নয়। পুলওয়ামার ফাঁদটি বিজেপির জন্য বেশ ভালো ফল দেয়। এমনকি বিজেপির পুনঃপুন গরুর ছবিকে কীভাবে মোকাবিলা করা যাবে, এ নিয়েও প্রগতিশীলদের কোনো শক্তিশালী কৌশলের দেখা মেলেনি। বামদের হাতে জাতীয়ভাবে আবেদনময় কোনো নেতাও ছিল না।

তবে নির্বাচনে কংগ্রেস একটা দারুণ ইশতেহার তৈরি করে। কিন্তু অমিত শাহ জানতেন,নির্বাচন এখন আর আর্টস নেই, এটা সায়েন্স হয়ে গেছে। বিজেপি তাই ইশতেহার নয়, নজর দিয়েছে মিডিয়া, অর্থ এবং নির্বাচন কমিশনকে প্রভাবিত করার প্রকৌশলবিদ্যায়। টুইটার থেকে টিভি—র্বত্র তাদের প্রচারকৌশলে ছিল সমন্বিত চিন্তার ছাপ। ভুয়া সংবাদ ছড়ানোতেও তারা ছিল একচেটিয়াভাবে সেরা। এমনকি সশস্ত্র বাহিনীর পোশাকও তারা প্রচারাভিযানে ব্যবহার করেছে। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, বিজেপি গতবারের চেয়ে প্রচারমাধ্যমের জন্য ৭০ ভাগ বেশি খরচ করেছে। অন্যদেরও তাই অনেকখানি খরচ বাড়াতে হয়েছে।

যদিও ভারতে প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষের দৈনিক আয় তিন ডলারের নিচে, তবে এবারের নির্বাচনে জনপ্রতি গড় খরচ প্রায় ৮ ডলার বলে জানিয়েছে ইকোনমিক টাইমস। দেশটির নির্বাচনী আইনে প্রার্থীদের খরচের সীমা বেঁধে দেওয়া হলেও দলের জন্য সেটা নেই। মোদির শিল্পপতি বন্ধুদের সহায়তায় বিজেপি এটার সর্বোচ্চ সুযোগ নিয়েছে।

কেবল খরচের অঙ্কেই নয়, ২০১৪ সালের তুলনায় বিজেপির এবারের নির্বাচনী প্রচারণার বক্তব্যও ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। পাঁচ বছর আগে টিম বিজেপির প্রচারের মূল বিষয় ছিল কর্মসংস্থান ও উন্নয়ন। মোদি এবার ফোকাস করেছেন নিরাপত্তা ইস্যু আর মুসলমানবৈরিতা। ভারতকে সুরক্ষিত করতে বিজেপি মোদিকে ত্রাতার মতো তুলে ধরেছে। অর্থনীতিকে নির্বাচনী প্রচারের মূল বিষয় হয়ে উঠতে দেয়নি। কিন্তু ভারতকে ‘পরাশক্তি’ হিসেবে দেখাতে চেয়েছে।

গ্রামেগঞ্জে ঢেউ তোলার জন্য পাকিস্তানবিদ্বেষী হিস্টিরিয়া থেকে শুরু করে মোদিকে মন্দিরে ধ্যানে বসানো পর্যন্ত—সবই করেছেন অমিত শাহ চুলচেরা পরিকল্পনায়। রাষ্ট্র-সরকার-দল-ধর্ম—এই চারকে একাকার করে উপস্থাপন করতে পেরেছিল তারা। তৃতীয় বিশ্বে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বোধ হয় এ ধরনের ইমেজই তৈরি করতে হয়। অন্তত দক্ষিণ এশিয়ায়।

সর্বত্রই বিজেপি প্রার্থীরা মুসলমান ও খ্রিষ্টানবিদ্বেষ ছড়িয়ে সংখ্যাগুরুদের মধ্যে বিজয়ের বোধ তৈরি করতে চেয়েছে। এতে পুরো দেশ অনেকখানি বিভক্ত হয়েছে। নীতি-নৈতিকতা হিসেবে এটা কতটা খারাপ, সে বিষয়ে বিতর্ক চলতে পারে। কিন্তু নির্বাচনী কৌশল হিসেবে এটা ফলদায়ক ছিল। সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘুর মধ্যে এই বিভক্তির গাণিতিক সমীকরণ ৮০: ২০। বিজেপি জানে, এই সমীকরণের পরিণতি কী।

তবে এটা একটা ফাঁদও ছিল। ২৩ মে দুপুর থেকে বোঝা যাবে, ভারতের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় সেই ফাঁদে কতটা পড়েছে। দেশটির নাগরিকদের রাজনৈতিক সাবালকত্বের বড় এক পরীক্ষা গেল গত দুই মাসে। অমিত শাহ ও আরএসএসের হাতে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ একটা ‘রিপাবলিক’-এর সোয়া শ কোটি মানুষের ভাগ্য ঝুলে আছে এখন।

গুড লাক ভারত।

আলতাফ পারভেজ: গবেষক