অর্থনীতির একটা নীতি থাকা প্রয়োজন

আওয়ামী লীগ সরকার ১৩০ দিনের বেশি সময় পার করে ফেলেছে। রেওয়াজ হচ্ছে, একটা আত্মপর্যালোচনার মাধ্যমে কৌশলগুলোর ভুলত্রুটি ঠিক করা। এ কাজটা করার প্রধান দায়িত্ব সংসদীয় কমিটিগুলোর। আদি ব্রিটিশ মডেলে আমরা মন্ত্রণালয়গুলোকে এত শক্তিশালী করেছি যে সংসদীয় কমিটিগুলো দুর্বল ও অপরিচিত হয়ে থাকছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় মডেল ঠিক এর উল্টো। কংগ্রেস কমিটিগুলো সদর্পে উচ্চবাক—কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। রাষ্ট্রের অনেক বিষয়ে সরকারের দক্ষতা প্রমাণিত হলেও অর্থনীতির অনেক বিষয়ে কিছু অসংগতি দিন দিন প্রকট হচ্ছে। এগুলোর ব্যাপারে সঠিক নীতির পথে অগ্রসর না হলে স্বল্প মেয়াদে সাময়িক সাফল্য দেখাতে পারলেও দীর্ঘ মেয়াদে বড় মাশুল দিতে হবে।

আমাদের মতো দেশে উন্নয়নের চালিকা শক্তি দুটো প্রতিষ্ঠান: ব্যাংকিং ও পুঁজিবাজার। হালে দুটোই আজ কমবেশি বিপদগ্রস্ত। এর মূল কারণ অর্থনীতির প্রধান তাত্ত্বিক দিকগুলোকে অগ্রাহ্য করা এবং পারলে আনাড়ি লোক দিয়ে ওগুলোকে রীতিমতো অপমান করা। সুদের হার হচ্ছে অর্থনীতির সবচেয়ে ক্ষমতাধর চালিকা হাতিয়ার বা অপারেন্টিং টুল। বিশেষত একটি বাজার অর্থনীতিতে যেদিকে আমরা যাচ্ছি। যেকোনো সুস্থ অর্থনীতিতে এর নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে থাকে এবং সরকার তা অনুসরণ করে। এখানে ব্যাপারটা উল্টো। সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে সরকার একটা আকাশছোঁয়া সুদের হার বেঁধে রেখেছে, যা নড়েচড়ে না। যার সঙ্গে বাজারের কোনো সম্পর্ক নেই, যা গরিবের বা মধ্যবিত্তের নামে উৎসর্গিত কিন্তু উচ্চবিত্ত ও গুপ্তধনীদের সেবা দিচ্ছে, যা ব্যাংকিং খাতের আমানত হারকে দুর্বল ও অপ্রয়োজনীয় করে দিচ্ছে, যা শেয়ারবাজারকে অনাকর্ষণীয় করে দিচ্ছে যা, এ দেশে একটা শক্ত বন্ড মার্কেট গড়তে দিচ্ছে না, যা সরকারকে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ঘাটতি অর্থায়ন বা ডেফিসিট ফিন্যান্সিংয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে—তা নিয়ে অনেক অর্থনীতিবিদ আজকাল কথা বলতে ভয় পান। অথবা আত্মসুবিধায় চুপচাপ থাকেন।

সুদের হারের অনাচারী এই দৈত্যকে প্রতিহত না করলে ব্যাংকিং ও পুঁজিবাজারকে কোনোভাবেই আসন্ন দুর্বলতা বা বিপদ থেকে রক্ষা করা যাবে না। বিধবা ও অবসরপ্রাপ্ত আমলা বা শিক্ষকদের দোহাই দিয়ে সেখানে কারা কারা টাকা রাখছে তার একটা শ্বেতপত্র প্রকাশিত হওয়া উচিত। পাঁচ বছর আগেই অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রাথমিক জরিপে দেখা গেল এর ৬৫ ভাগই কোটিপতি। এখন তো এ হিসাব আরও বাড়বে—কারণ বাংলার উর্বরভূমি সবচেয়ে দ্রুত হারে ধনী উৎপাদন করছে। অবশ্যই অনেক অক্ষম ও অবসরভোগীরা সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু সে জন্য সরকারের নিরাপত্তা জাল ও পেনশন ফান্ড থাকবে। অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দ্রুত সিদ্ধান্ত হবে কী করে একটা জাতীয় পেনশন প্ল্যান তৈরি করা যায়। বিধবার নাম করে সঞ্চয়পত্রের ঘাড়ে পেনশনের জোয়াল চাপিয়ে দিলে চলবে না। সঞ্চয়পত্র এখন খেলাপিদের লুটিত অর্থেরও পার্কিং প্লেস।

তাহলে কি সঞ্চয়পত্রে সুদের হার একটু কমিয়ে দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে? তা নয়। ওই সঞ্চয়পত্রের অধিদপ্তর যত দিন থাকবে, তত দিন সুস্থ ব্যাংকিং খাত গড়ে উঠবে না। এ হচ্ছে খেলার মাঠে স্বয়ং রেফারির একটা পক্ষ নিয়ে খেলা শুরু করা। যেখানে সুদের হার প্রতি মাসে ওঠা–নামা করে, সেখানে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ঠিক করতে মন্ত্রণালয়ের গোটা বিশেক মিটিং ও গোটা তিরিশেক আশ্বাসের পরও বছরের পর বছর সুদের হার নড়েচড়ে না। এভাবে অর্থনীতি চলে না। এই অধিদপ্তর তুলে দিয়ে আমানত সংগ্রহের পুরো কাজটা ব্যাংকিং খাতকে দেওয়া উচিত। এটা কোনো করুণার দান নয়। এটা নীতি।

ব্যাংকিং কাকে বলে? সঞ্চয় ও বিনিয়োগের সমন্বয় করার জন্যই তো এ প্রতিষ্ঠানের জন্ম। সরকার যদি সমান্তরালভাবে সঞ্চয়ের কাগজ বেচে, তাহলে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত ও বাজারব্যবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে একজন বৃদ্ধাও ঘরে বসে সরকারি সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন। কিন্তু ওটার সুদহার মূল্যস্ফীতি ও সামান্য প্রকৃত হার যোগ করে গতিশীলভাবে নির্ধারিত হয়। কতগুলো ১০, ২০ বা ৩০ বছর মেয়াদি, যার সুদের হার অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি প্রকৃত সুদের হারের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়, যা বহু মার্কেটের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ এবং এ জন্যই বহু মার্কেট সেখানে এত বিশাল ও বর্ধমান। কি উন্নত কি উদীয়মান সব অর্থনীতিতেই স্টকমার্কেটের রিটার্ন সরকারি সঞ্চয়পত্রের হারের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি। এ জন্য স্টকমার্কেটও কত চাঙা। আমাদের দেশে এর ঠিক উল্টো।

সঞ্চয় অধিদপ্তর আমাদের স্টক মার্কেটের জন্য এক নিরন্তর ঘুমপাড়ানি গান। এর ইতি হওয়া প্রয়োজন নীতির স্বার্থে। অর্থনীতির দুটো অভিশাপের নাম মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্ব। মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণের মূল দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে থাকে। বেকারত্ব নিরসনে মূলত সরকারের নির্দেশনায় ও প্রণোদনায় রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান একযোগে কাজ করে। ২০১৪ থেকে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি আরও কমে যেত যদি সরকার বিপিসি নামক একটা অদক্ষ ও অবাজারীয় প্রতিষ্ঠানকে তেলের মূল্য নির্ধারণ থেকে সরিয়ে রাখত। সরকারের যুক্তি ছিল যে তেলের উচ্চমূল্যের সময় বিপিসি লোকসান কাঁধে নিয়ে কম দামে বাজারে তেল ছাড়ে। তাই কম দামের সময় ওরা কিছু মুনাফা করবে। এ তো একধরনের আড়তদারি। সরকারি প্রতিষ্ঠান কেন তা করবে? এ তো বাজারমূল্যের সঙ্গে ভোক্তার ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়ার অন্তরায়। তেল একটা পণ্য এবং এর আমদানি–রপ্তানির সুযোগ ব্যক্তি খাতে উৎসাহিত করলে বিশ্ববাজারের মূল্যে ভোক্তা তেল পাবে এটাই তো সুস্থ অর্থনীতির নিয়ম। গত পাঁচ বছরে বিপিসি তেলদর নিয়ন্ত্রণ না করলে জোগানগত মূল্যস্ফীতি আরও কমত, প্রকৃত ভোগ বাড়ত, যা প্রবৃদ্ধিকে চাহিদাগত দিকে আরও বাড়াত। কারণ, ভোগ জিডিপির ৭০ থেকে ৮০ ভাগ। বিপিসি নিয়ে অস্বচ্ছতার অভিযোগ রয়েছে। এককালে আন্তর্জাতিক কোনো অডিট এখানে অপ্রবেশ্য ছিল। কী দরকার একটা অস্বচ্ছ প্রতিষ্ঠান পুষে খামাখা অর্থনীতির গতিময়তা রোধ করা?

অর্থনীতির একটা তাত্ত্বিক নীতিমালা বইয়ে থাকে। তা পড়ে পড়ে দেশ চালাতে হবে এমন কথা নেই। কিন্তু এর মূলনীতিগুলো উল্টিয়ে বা অগ্রাহ্য করে রাষ্ট্রকে বাড়তি কিছু দেওয়া যায় এমন নজির দেখিনি। বাজারব্যবস্থা ও আর্থিক নীতিমালার প্রতি শ্রদ্ধা ও অশ্রদ্ধার ফসল দেখতে হলে দক্ষিণ ও উত্তর কোরিয়ার দিকে তাকাতে হয়।

প্রাতিষ্ঠানিক নিষ্ঠা ও স্বাধীনতা ছাড়া অর্থনীতি আধুনিক হয় না। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি অর্থ মন্ত্রণালয়ের দখলে এবং বিআইডিএস ও পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএস যদি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকে, তাহলে এগুলো থেকে কি অপ্রিয় অথচ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বা গবেষণালব্ধ নীতি প্রস্তাবনা বের হবে? অথচ গবেষণা হচ্ছে অনেকটা ডাক্তার দেখানোর মতো। চিকিৎসক যদি সঠিক রিপোর্ট চাপিয়ে রেখে রোগীকে সব ভালো বলতে থাকেন তাহলে আকস্মিক হার্ট অ্যাটাক অসম্ভব নয়। বিবিএসের প্রবৃদ্ধি তথ্য নিয়ে আজ এত দ্বিমত হচ্ছে কেন? বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ বা এডিবি না হয় কারও কারও সংজ্ঞায় ‘হিংসুক’—কিন্তু স্বদেশি অনেক অর্থনীতিবিদও তো অন্যান্য চলকের সঙ্গে প্রবৃদ্ধির মিল খুঁজে পাচ্ছেন না।

সরকারের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থেই তথ্যমান উন্নত করা প্রয়োজন। এ জন্য তথ্য ও গবেষণার প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীনতা দিতে হবে। যোগ্য ও সাহসী লোক বসাতে হবে। শুধু অনুগত অবসরপ্রাপ্তদের পুনর্বাসন করলে সংস্কার ও উদ্ভাবন হবে না। ইতিমধ্যে আমরা উদ্ভাবনী সূচকে এ অঞ্চলে সর্বনিম্ন স্থান দখল করেছি। গবেষণার অবস্থাও তথৈবচ। এশিয়ার চার শতাধিক মানী বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় আমাদের একটিও আসেনি। পাকিস্তানের এসেছে ৯টি—নেপালেরও একটি। ভারতের গোটা পঞ্চাশেক। শ্রীলঙ্কাও কম যায় না।

স্বাধীনতা–উত্তর আর্থিক দুরবস্থার সময়ে বঙ্গবন্ধু কৃষি গবেষণা উৎসাহিত করেছেন। তার ফল আমরা আজ পাচ্ছি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও গবেষণায় আগ্রহী ও তৎপর। কিন্তু অর্থনৈতিক গতিময়তার স্বার্থে কিছু অপ্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানকে সরাতে হবে এবং বাকিগুলোকে স্বীকয়তায় কোমর সোজা করে দাঁড় করাতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ালে আলাদা ব্যাংকিং ডিভিশনের কী দরকার আছে? প্রয়োজন পড়লে গভর্নরকে জবাবদিহির জন্য খোদ পার্লামেন্টে ডাকা হবে। পৃথিবীর সব উন্নত দেশেই তো এ প্রথা আছে। আমরা কি সে পথে হাঁটতে পারি না? সব কৃতকর্মের জবাবদিহি কেন তোপখানার সচিবালয়ে গিয়ে ঢুকবে। বঙ্গবন্ধুও চাইতেন না। আমরা ক্রমান্বয়ে একটা আমলানির্ভর সমাজে পরিণত হই। নীতি ও প্রতিষ্ঠান ঠিক না করে শুধু প্রবৃদ্ধির দিকে দৃষ্টি টানলে বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের কাঙ্ক্ষিত সমাধান সম্ভব নয়।

ড. বিরূপাক্ষ পাল স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক অ্যাট কোর্টল্যান্ডের অর্থনীতির অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ