পশ্চিমবঙ্গেও গেরুয়া শাসন আসছে!

১৯ মে ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ভোটপর্ব শেষ হওয়ার পর এখন ফলের প্রতীক্ষা। ২৩ মে ফলাফল ঘোষিত হবে।

ক্ষমতাসীন বিজেপি ও তার বিরোধীরা উভয়ই জয় পাওয়ার আশা করছে। বুথফেরত জরিপে বিজেপি এগিয়ে থাকলেও বিরোধীরা তা বিশ্বাস করছে না। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, বিজেপি জিততে পারবে না। মোদি ক্ষমতায় আসবেন না। এটি কতটা বিশ্বাসের আর কতটা অঙ্কের কথা, জানা যাবে ২৩ মে।

বুথফেরত জরিপ সব সময় ঠিক হয় না। ফলে কোনো দলই সরকার গঠনের বিষয়ে নিশ্চিত নয়। ১৯৯৬ ও ১৯৯৯ সালের জরিপে বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোটকে এগিয়ে ছিল এবং তারা জয়ী হয়ে সরকারও গঠন করে। কিন্তু ২০০৪ সালের জরিপ ভুল প্রমাণিত হয়। ২০০৯ সালের ভোটেও চূড়ান্ত ব্যর্থ হন বুথফেরত সমীক্ষকেরা। মনমোহন সিং সরকার দ্বিতীয়বার ক্ষমতাসীন হয়।

বুথফেরত জরিপ অনুযায়ী, বিজেপি ও তার জোট সবচেয়ে বেশি ৩০৬ এবং সবচেয়ে কম ২৬৭ আসন পেতে যাচ্ছে। গতবার এই সংখ্যা ছিল ৩৩৬। আবার ২০১৪ সালে কংগ্রেস ও জোটসঙ্গীরা পেয়েছিল ৫৯টি আসন। এবার এই জোটের সবচেয়ে কম প্রাপ্তি ১২৭, সবচেয়ে বেশি ১৪১। এর অর্থ, বিজেপি গতবারের মতো ভালো না করলেও সরকার গড়ার মতো গরিষ্ঠতা পেতে চলেছে। অন্যদিকে, কংগ্রেসসহ বিরোধীরা আগেরবারের চেয়ে অনেক ভালো করলেও সরকার গড়ার মতো ততটা ভালো করতে পারেনি।

প্রথম আলোর দিল্লি প্রতিনিধি সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, ৫৪৩ কেন্দ্রেই শাসক দল ভোট চেয়েছে মোদির নামে। একের বিরুদ্ধে অন্য অনেকের এই অনন্য লড়াই-ই এবারের ভোটকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। ভোট শুরু হয়েছিল মোদি সরকারের পাঁচ বছরের ‘সাফল্য’ ঘিরে। কিন্তু প্রচার যত এগিয়েছে, ততই বড় হয়ে উঠেছে পুলওয়ামা-বালাকোট-পাকিস্তান। সবকিছু ছাপিয়ে বড় করে তোলা হয়েছে দেশের নিরাপত্তার প্রশ্ন। কাজেই অভূতপূর্ব এই ভোট ঘিরে কোনো মহলই ভবিষ্যদ্বাণী করতে সাহস পাচ্ছে না। যদিও গত শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী মোদি এবং বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ দাবি করেছেন, ৩০০-এর বেশি আসন একা জিতে মোদি দ্বিতীয়বারের মতো দেশের দায়িত্ব হাতে নেবেন। গতবার বিজেপি একাই পেয়েছিল ২৮২ আসন।

বিজেপি ও এনডিএ গতবারের মতো আসন পাবে না ধরে নিয়ে বিরোধীরাও তৎপর। ইউপিএ চেয়ারপারসন সোনিয়া গান্ধী বিরোধী নেতাদের চিঠি দিয়ে ২৩ মে বৈঠকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। অন্ধ্র প্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও তেলেগু দেশম নেতা চন্দ্রবাবু নাইডু সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। তিনি ইতিমধ্যে দেখা করেছেন আম আদমি পার্টির নেতা দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল, এনসিপি নেতা শারদ পাওয়ার, জনতা দল নেতা শরদ যাদব ও কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীর সঙ্গে। বিরোধীদের একজোট করতে তিনি সচেষ্ট।

ভারতে কে জিতবেন, মোদি না বিরোধী দল? বিরোধী দলে একজন মোদি নেই। আবার বিজেপিতেও মোদি ছাড়া সারা ভারতকে প্রতিনিধিত্ব করার মতো কোনো নেতা নেই। মোদির নামেই নির্বাচন করেছে বিজেপি। এবারের লোকসভা নির্বাচনটি ছিল গণভোটের মতো। আপনি মোদিকে চান, না মোদির বিকল্প? মোদির বিকল্প একক কোনো ব্যক্তি নেই। আছেন কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী। তৃণমূলের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তেলেগু দেশম পার্টির চন্দ্রবাবু নাইডু। এনসিপির শারদ পাওয়ার, জনতা দলের শরদ যাদব। বিএসপির ময়াবতী। রাহুল গান্ধী বলেছেন, তাঁরা সর্বোচ্চ ছাড় দিতে রাজি। অর্থাৎ ঐক্যের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রী পদ শরিকদের দিতে রাজি। কিন্তু নির্বাচনের আগে বিরোধী শক্ত জোট করতে পারেনি। আসন ভাগাভাগিও হয়নি।

১৯৯৪ সালে কংগ্রেস ও বিজেপির দ্বৈরথে জাতি ফ্রন্ট সরকার গঠন করেছিল। প্রথমে দেব গৌড়া প্রধানমন্ত্রী হন। পরে আই কে গুজরাল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু প্রধানমন্ত্রীর পদ পেয়েও নিতে পারেননি সিপিএমের বিরোধিতার কারণে। এখন বামদের অবস্থা খুবই নাজুক। কেরালা ছাড়া বামদের হাতে কোনো রাজ্য নেই। পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় তিন দশকেরও বেশি সময় শাসন করেছে বামফ্রন্ট। কিন্তু এখন দুই রাজ্যেই তাদের অবস্থা শোচনীয়। ২০১৪ সালে পশ্চিমবঙ্গে দুটি আসন পেয়েছিল বামেরা। এবারে সেই দুটি ধরে রাখতে পারবেন কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। ত্রিপুরার খবরও ভালো নয়। দুটোই বিজেপির দখলে যেতে পারে।

বিরোধীরা মোদির বিরুদ্ধে চড়া গলায় কথা বললেও নির্বাচনী যুদ্ধে এক হতে পারেননি। সারা ভারতে কিংবা পশ্চিমবঙ্গেও নয়। মমতা বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাম ও কংগ্রেসকে সঙ্গে নিলে বিজেপিকে ঠেকানো যত সহজ ছিল, এখন তা হবে না। সারা ভারতে নির্বাচনী ফলাফল যা–ই হোক না কেন, বাংলাদেশের সীমান্তঘেরা রাজ্যগুলোর ফলাফল আমাদের জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

সীমান্তবর্তী সব রাজ্যে একসময় কংগ্রেস ও বামদের শাসন ছিল। কিন্তু এখন ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়ে বিজেপি সরকার প্রতিষ্ঠিত। বুথফেরত জরিপ অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি যদি ১২ থেকে ১৬ আসনে জয়ী হয়, তাহলে পরের বিধানসভা নির্বাচনে তাদের সরকার গঠন করতে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না। দিদির জনপ্রিয়তা এখনই ভাটির দিকে। চলতি লোকসভা নির্বাচনেও তৃণমূলের অনেক নেতা-কর্মী পক্ষ ত্যাগ করে বিজেপিতে গিয়েছেন। শুধু তৃণমূল নয়, বাম জোটের কর্মীরাও সেখান নাম লিখিয়েছেন। নীতি-আদর্শের দুর্ভিক্ষ সবখানে।

তবে সবকিছুই নির্ভর করছে লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের ওপর।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]