হাইকোর্ট বেঞ্চের আদেশটি বিভ্রান্তিকর: শফিক আহমেদ

>১৬ মে আপিল বিভাগ একটি বিচারিক আদেশে সংক্ষুব্ধ হন। ২০ মে প্রথম আলোয় এ বিষয়ে আইনমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার ছাপা হয়। এই প্রেক্ষাপটে সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদের সঙ্গে কথা বলে প্রথম আলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান

প্রথম আলো: শুনানি না করেই ১৮৪ কোটি টাকা ও ২ লাখ বর্গফুটের একটি বন্ধকি বহুতল ভবন দিয়ে দিতে হাইকোর্টের একটি আদেশ নিয়ে কথা উঠেছে। আপনি রিটকারীর জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ছিলেন। ফাইলিং আইনজীবী মো. হুমায়ুন বাশার আপনার চেম্বারের?

শফিক আহমেদ: আমি শুধু রুল নিয়েছি। হাইকোর্টের ওই আদেশের আমি শুধু রুলের দায় নেব। এখন ফুল রিলিফ যদি জজ সাহেব দিয়ে থাকেন এবং ফাইলিং আইনজীবী যদি এটাকে ডিসচার্জ করিয়ে নিয়ে যান, আমার তো এখানে কিছু বলার কোনো স্কোপ নেই। আমি তো এই মামলার আর শুনানি করিনি। সাধারণভাবে এটাই হয়ে আসছে যে জুনিয়ররা এসে বলেন, ‘স্যার, দরখাস্তটা একটু মুভ করে দেন।’ সেভাবেই আমরা রুল পেতে চেষ্টা করেছি। এটুকুই আমার দায়। রুলের পরের আদেশ, মামলা তুলে নেওয়া—এসবে আমার ভূমিকা নেই। আমার সঙ্গে আলাপ করা হয়নি, আমি এসবের কিছুই জানি না। হুমায়ুন বাশার আমার চেম্বারের কেউ নন।

প্রথম আলো: কিন্তু হাইকোর্টের যে আদেশে আপনি রুল নিয়েছেন, সেই একই আদেশে ন্যাশনাল ব্যাংককে সম্পূর্ণ প্রতিকার, মানে ১৮৪ কোটি টাকা এবং বন্ধকি বহুতল ভবন ফিরিয়ে দেওয়ার ডিক্রি জারি করতে নিম্ন আদালতের ওপর নির্দেশনার কথা আছে, আপিল বিভাগ তা ক্ষোভ ও বিস্ময়ের সঙ্গে বাতিল করেছেন।

শফিক আহমেদ: দরখাস্ত দেওয়াই হলো শুধু রুল জারির প্রার্থনা করে। রুলের অর্থ হলো একটা বিষয় কেন অবৈধ হবে না। এই তো। তার বাইরে যদি কিছু অর্ডার লেখার সময় লেখা হয়, তাহলে সেটা রুলের আওতার বাইরে। তাই আমরা যারা কেবল রুল চেয়েছিলাম, তাদের তো দায়িত্ব থাকে না। আইনমন্ত্রী কী বলেছেন?

প্রথম আলো: আইনমন্ত্রী বলেছেন, ঘটনাটি দুঃখজনক। সুপ্রিম কোর্টের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য যথেষ্ট। তিনি বিচারপতি ও আইনজীবীকে জবাবদিহির আওতায় আনতে বলেছেন।

শফিক আহমেদ: আইনজীবী, যিনি পরে এই রিট মামলাটি হাইকোর্ট থেকে প্রত্যাহার করিয়ে নিয়েছেন, তিনি তো এখানে ‘আইনজীবীদের’ বলেননি। তাই আমার মনে হয়, বিষয়টি নিয়ে—

প্রথম আলো: আইনমন্ত্রী আরও বলেছেন, আইনজীবীর আদালতকে বিভ্রান্ত করা বা আদালতের কাছে তথ্য গোপন করা উচিত নয়।

শফিক আহমেদ: ৬০ বছরের ওকালতি জীবনে আমি বহু মামলা করেছি, আদালতকে বিভ্রান্ত করার অভ্যাস আমার কখনোই ছিল না। আদালত কেন বিভ্রান্ত হবেন, এটা তো আমি বুঝতে পারলাম না। আইনমন্ত্রী তাঁর মতো করে বলেছেন। উনি তো ক্রিমিনাল কেস করতেন। রিট বিষয়ে তাঁর চর্চা নেই। আমি যেটুকু আপনাকে বললাম, এর বাইরে আমার বলার কিছু নেই। অর্ডার তো আমি লিখিনি, আমি রুল নিয়েছি। আইনমন্ত্রী মহোদয় কতটুকু বুঝে বলেছেন, আমি জানি না।

প্রথম আলো: আইনমন্ত্রী বলেছেন, এ রকম প্রতিকার পেলেও আইনজীবীর বলা উচিত, ‘আমি এটা নিতে পারব না’। কারণ, আইন তা সমর্থন করে না। আপনার সামনে আদালত যদি ডিক্রি দিতেন, তাহলে আপনি কি তা–ই বলতেন?

শফিক আহমেদ: অবশ্যই, অবশ্যই।

প্রথম আলো: ১৮৫০ সালের জুডিশিয়াল অফিসার্স প্রটেকশন অ্যাক্ট বলে, আদালত ‘ইন গুড ফেইথ’ ভুল আদেশ দিতে পারেন। এখানে কি সেই যুক্তি খাটবে?

শফিক আহমেদ: ভুলক্রমে ঘটলে খাটবে না কেন। অনেক সময় বেঞ্চ অফিসাররা ডিকটেশন নিতে ভুল করেন, টাইপের ভুল হয়, অনেক কিছু হতে পারে।

প্রথম আলো: ন্যাশনাল ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখা দিলকুশার ২৩ তলা সানমুন টাওয়ার, বঙ্গভবনের নিরাপত্তাজনিত কারণে যেটির ৫ তলা ভাঙা হয়েছিল, তার মালিককে (রিটকারী) আপনি ব্যক্তিগতভাবে জানতেন? আইনমন্ত্রী থাকতে ওই ভবনের বিষয়ে জানাশোনা?

শফিক আহমেদ: না। মক্কেল হিসেবে কে কখন এসেছেন।

প্রথম আলো: আইনমন্ত্রী মনে করেন, বার কাউন্সিল ব্যবস্থা নিতে পারে।

শফিক আহমেদ: বার কাউন্সিল নিলে নেবে। উনি যদি মনে করেন, মিসকন্ডাক্ট হয়েছে, তাহলে লেট হিম রাইট ইট। বাধা দেওয়ার কিছু নেই।

প্রথম আলো: আপনি রুলে ডিক্রি চাননি, অথচ সেটা আদেশে এখন দেখছেন। তাহলে আপনি এর প্রতিকারে ব্যবস্থা নেবেন না?

শফিক আহমেদ: না, সেটা প্র্যাকটিস নয়। আমাকে নির্দিষ্টভাবে আদেশটি নিয়ে কেউ কিছু না বললে আমি কিছুই বলব না। রুল মুভ করার পরে আমার কাজ শেষ। এরপর আদেশ কীভাবে লেখা হয়েছে, আমি তা দেখিনি।

প্রথম আলো: কিন্তু আপনার এবং আপনার আইনজীবী ছেলের নাম তো চূড়ান্ত ডিক্রি দেওয়ার আদেশে লেখা আছে। আপনি কখনো এ রকম আদেশ শুনেছেন?

শফিক আহমেদ: শুনিনি। আমরা ছিলাম, সেটা অস্বীকার করি না। কিন্তু আমরা রুল চাইলাম, রুল হলো। এর পরে যতক্ষণ রুলের ওপর শুনানি না হবে, ততক্ষণ ডিক্রি দেওয়ার সুযোগ নেই। পক্ষসমূহকে নোটিশ দিয়ে তাদের শুনেই তবে সিদ্ধান্ত হবে বাদীর পক্ষে চূড়ান্ত রায় হবে কি হবে না। এ জন্য বিবাদীকে (ন্যাশনাল ব্যাংক) তো নোটিশ দিতে হবে। রুল বিচারাধীন থাকতে আদেশ হবে কীভাবে? আমি যখন রুল চাইব, তখন আমি আশাই করব, আদালত বলবেন, কেন এ রূপ হবে না, কেন অবৈধ হবে না ইত্যাদি। এটা অনেকটা শোকজের মতো। এটা একটা অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ, এখানে সম্পূর্ণ প্রতিকার দেওয়া যায় না। এটা আমার কাছে বিভ্রান্তিকর মনে হচ্ছে।

প্রথম আলো: একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অবৈধ আদেশপ্রাপ্তি যখন জানবেন, তখন তাঁর কী করণীয়?

শফিক আহমেদ: সিনিয়র আইনজীবীরা সবাই যা করেন, সেভাবে আমি তো রুল চেয়েছি, পরবর্তীকালে রুলটা ডিসচার্জ করিয়ে নিয়েছেন বাদীর ফাইলিং আইনজীবী।

প্রথম আলো: যে মামলা বাদী আর চালাবেন না, সেই মামলার আদেশ লঙ্ঘনের কারণে আদালত অবমাননার রুল নেওয়া হয়েছে। এই মামলায় ন্যাশনাল ব্যাংকের এমডিকে তলব করার সূত্রেই এটি প্রকাশ পায়।

শফিক আহমেদ: আদালত অবমাননা মামলার আইনজীবী আর রিটকারীর ফাইলিং আইনজীবী কি একই ব্যক্তি? তিনি কী করছেন?

প্রথম আলো: না। তাঁর নাম মো. ফয়জুল্লাহ। তিনি গিয়ে হাইকোর্টের আরেকটি বেঞ্চকে বলেছেন, হাইকোর্টের রায় অমান্য করার দায়ে কন্টেম্পট করুন।

শফিক আহমেদ: তাঁকে (আইনজীবী) জিজ্ঞেস করুন, তিনি কিসের ভিত্তিতে মামলাটি করেছেন। কারণ, তিনি এখানে ঢুকে আদেশটির কার্যকরতা চেয়েছেন। তাঁকে পান কি না, একটু দেখুন; তাঁকে কে মামলাটি করতে বলেছেন।

প্রথম আলো: আমরা আইনমন্ত্রীকে বললাম, ২৮ এপ্রিল ২০১৯ আদালত অবমাননার রুল জারির সময় (বিচারপতি মামনুন রহমান ও বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাস সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ কর্তৃক) বেআইনি আদেশ নজরে পড়া সমীচীন ছিল কি না। তিনি বললেন, আদেশদানকারী মূল বেঞ্চ (বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের সমন্বয়ে) জ্যেষ্ঠ, তাই তাঁদের ত্রুটি দেখার অবকাশ নেই। আপনি একমত? এই বেঞ্চের এমন ত্রুটি দেখার সুযোগ ছিল?

শফিক আহমেদ: এটা সঠিক নয়। কারণ, এটা যাচাই করার অবকাশ আছে যে এটি আদালত অবমাননার মতো বিষয় কি না। সুযোগ নয়, দেখতে হবে। খামাখা কেন একটা আদালত অবমাননা রুল জারি হবে। আগে খতিয়ে দেখতে হবে।

প্রথম আলো: হাইকোর্টের ২০১৭ সালের আদেশটি বেআইনি হলেও সেটা তো অর্থঋণ আদালত তামিল করেছিলেন। তাহলে অবমাননাটা কী করে হাইকোর্টের, সেটা নিম্ন আদালতের নয় কি?

শফিক আহমেদ: আপনার সঙ্গে একমত।

প্রথম আলো: আপিল বিভাগ আবদুল বাসেত মজুমদারকে প্রশ্ন করেছেন, এমন আদেশ ‘ম্যানেজ’ করলেন কীভাবে? আপনার ৫০ বছরের অভিজ্ঞতায় এমনটা দেখেছেন?

শফিক আহমেদ: প্রশ্ন অনেকেই করেন, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। এটিএন বাংলায় দেখলাম, অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, রায় পরিবর্তন করা হয়েছে। আমার তো জানা নেই। তিনি যদি সমগ্র ব্রিফ পরীক্ষা করেন, তাহলে হয়তো তার ব্যক্তিগত ধারণার ভিত্তিতে বলেছেন।

প্রথম আলো: বিষয়টি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর প্রস্তাবে আপনি একমত?

শফিক আহমেদ: না, যদি ভুলক্রমে ঘটে থাকে, তাহলে রাষ্ট্রপতি কী করবেন? সিনিয়ররা বললে কী হবে? কোন আইনে রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থা নেবেন, সেটা তাঁরা বলেছেন? রাষ্ট্রপতির কি সেই বিচার বিভাগীয় ক্ষমতা আছে?

প্রথম আলো: ষোড়শ সংশোধনী রায় বহাল থাকতে কোনো বিচারপতির আচরণের বিষয় সরাসরি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাতে আইনি বাধা আছে। কারণ, রায়ে অনুমোদিত আচরণবিধি বলছে, অভিযোগ উঠলে আগে ইনহাউস কমিটিকে তদন্ত করতে হবে।

শফিক আহমেদ: সেটাই সঠিক। আমি আপনার সঙ্গে একমত।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

শফিক আহমেদ: ধন্যবাদ।