জন্মই যাদের মৃত্যুর আয়োজন

মানুষের জন্ম সবচেয়ে আনন্দদায়ক ঘটনাগুলোর একটা। কোনো পরিবারে একজন নারী অন্তঃসত্ত্বা হলে সেই পরিবারের সবাই খুশি হয়: একজন নতুন মানুষ আসছে! তার জন্য কাঁথা সেলাই করা হয়, খেলনা কেনা হয়; তাকে নিয়ে সবাই স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। তার মা তো গর্ভকালীন পুরোটা সময়ই তাকে নিয়ে স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকেন।

কিন্তু সেই স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়, যদি দেখা যায় নতুন মানুষটি স্বাভাবিক স্বাস্থ্য নিয়ে পৃথিবীতে আসেনি। তার ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে কম; পৃথিবীর আলোয় চোখ মেলে সে বুক ভরে শ্বাস নিতে পারছে না; সে এতই দুর্বল যে মায়ের স্তন পান করার শক্তিটুকুও তার নেই। তার নতুন চোখ দুটি ঝকঝকে উজ্জ্বল প্রাণবন্ত নয়, বরং হলদে কুয়াশায় নিষ্প্রভ।

দুঃস্বপ্ন গভীর ট্র্যাজেডিতে পরিণত হয়, যখন নতুন মানুষটি পৃথিবীর আলোয় চোখ মেলার পর ২৮ দিন পেরোনোর আগেই ফিরে চলে যায়।

হ্যাঁ, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৫০ হাজার পরিবারে এমন ট্র্যাজেডি নেমে আসে। জন্মের ২৮ দিনের মধ্যেই তারা নতুন মানুষটিকে হারায়। কিন্তু মানুষের স্বাভাবিক আয়ু মাত্র ২৮ দিন নয়। খোদ বাংলাদেশেই মানুষের গড় আয়ু এখন ৭২ বছর। সুতরাং বছরে প্রায় ৫০ হাজার নবজাতকের মৃত্যু অবশ্যই মর্মান্তিক অকালমৃত্যু; জন্মমৃত্যু নিয়ে প্রকৃতির রহস্যময় লীলা নয়। এদের অকালমৃত্যুর জন্য দায়ী আমরাই: আমাদের আর্থসামাজিক ব্যবস্থার গুরুতর দুর্বলতা, খাদ্য–পুষ্টি বণ্টনব্যবস্থার অমানবিক বৈষম্য, অজ্ঞতা–অশিক্ষা–কুসংস্কারে আচ্ছন্ন জন্ম–রীতিনীতি (বার্থ রিচুয়াল), জনস্বাস্থ্য ও মাতৃস্বাস্থ্যসেবার নিম্নমান, সর্বোপরি আমাদের সরকারগুলোর দায়িত্ববোধের অভাব এবং তার পরিণতিস্বরূপ প্রাতিষ্ঠানিক অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা ও অনৈতিকতার চর্চা।

গত তিন দশকে বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্য পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। আমাদের গড় আয়ু বেড়েছে, প্রসূতি মায়েদের মৃত্যুহার কমেছে, শিশুদের মৃত্যুর হার কমেছে, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টি–পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতির ফলে খর্বাকৃতি ও কৃষকায় শিশু জন্মের হার কমেছে। এসব উন্নতির তথ্য ও সূচকগুলো অবশ্যই সুখকর, কিন্তু সন্তুষ্ট করার জন্য যথেষ্ট নয়। বরং কিছু তথ্য এখনো বেশ বেদনাদায়ক। যেমন শিশুমৃত্যুর তথ্য: এখনো বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় এক লাখ শিশু মারা যাচ্ছে পাঁচ বছর বয়সে পৌঁছার আগেই। প্রতি ঘণ্টায় ১১ জন। ২০১৭ সালের এক সমীক্ষার ভিত্তিতে এই হিসাব দিয়েছে ইউনিসেফ। একটা ইতিবাচক তথ্য হলো, গত ২৭ বছরে বাংলাদেশে পাঁচ বছর পর্যন্ত বয়সী শিশুদের মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। ইউনিসেফ বলছে, ১৯৯০ সালে এই বয়সী ৫ লাখ ৩২ হাজার শিশুর মৃত্যু হয়েছে। আর ২০১৭ সালে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ১ লাখ শিশুর। শিশুমৃত্যু ঠেকানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এই অগ্রগতির প্রধান কারণ দারিদ্র্য হ্রাস; নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর আয় কিছুটা বাড়ার ফলে তাদের খাদ্যাভাব ও অপুষ্টি কিছুটা কমেছে। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় নারীর স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে, তাঁদের পুষ্টির অভাব ঘটলে গর্ভের শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটে না, তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হতে পারে: ফলে জন্মের সময় এবং তার পরের ২৮ দিন পর্যন্ত জীবাণু সংক্রমণে ও অন্যান্য জটিলতায় তার মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে। উল্লেখ্য, ২৮ দিন পর্যন্ত বয়সী শিশুদের ‘নবজাতক’ ধরা হয়; জন্মের পাঁচ বছরের মধ্যেই যে শিশুরা মারা যায়, তাদের অর্ধেকই নবজাতক। অর্থাৎ, এ দেশ প্রতি ঘণ্টায় যে ১১ শিশুর মৃত্যু ঘটছে তাদের মধ্যে প্রায় ৬ জনই নবজাতক।

নবজাতকের মৃত্যুহার কমানো বাংলাদেশের জন্য এখনো খুব বড় একটা চ্যালেঞ্জ। শিশুমৃত্যুর হার কমছে, মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি ঘটছে, আমরা খুশি হচ্ছি, কারণ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণের পথে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। এটা মোটা দাগের সত্য। সূক্ষ্ম বাস্তবতা হলো, মৃত্যুর হার কমছে শিশুর নবজাতক পর্যায় পেরোবার পর থেকে; জন্মের পরের ২৮ দিন পর্যন্ত শিশুর (নবজাতক) মৃত্যুর ঝুঁকি প্রায় একই রকম থেকে যাচ্ছে। বিভিন্ন গবেষণা ও সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, বিদ্যমান ব্যবস্থায় নবজাতকদের মৃত্যুহার আর কমানো যাচ্ছে না। এখানে এসে বাংলাদেশ যেন আটকে গেছে।

কেন? কারণ বেশ কয়েকটা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমীক্ষার ভিত্তিতে বৈশ্বিকভাবে নবজাতকের মৃত্যুর প্রধান কারণগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে; সেগুলোর মধ্যে আছে জীবাণু সংক্রমণ (সেপসিস/নিউমোনিয়া, টিটেনাস, ডায়রিয়া ইত্যাদি), নির্ধারিত সময়ের আগেই জন্ম (প্রিটার্ম/প্রিম্যাচিউর বার্থ), প্রসবের সময় শিশুর রক্তপ্রবাহে অক্সিজেনের ঘাটতি (বার্থ অ্যাসফিক্সিয়া), জন্মের সময় শিশুর ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে কম এবং সেই কারণে সৃষ্ট নানা জটিলতা, শ্বাসপ্রণালির সমস্যা, জন্ডিস ইত্যাদি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নবজাতকের মৃত্যুর প্রধান কারণগুলো ভিন্ন ভিন্ন। গড় বৈশ্বিক চিত্রের সঙ্গে বাংলাদেশের গড় চিত্রের সামঞ্জস্য পাওয়া যায় না। নবজাতকদের মৃত্যু নিয়ে বাংলাদেশে ব্যাপক পরিসরে গবেষণা–সমীক্ষা হয়েছে বলে জানা যায় না। আইসিডিডিআরবির কয়েকজন দেশি–বিদেশি গবেষক ২০০৩–০৪ সালে চাঁদপুরের মতলব উপজেলায় ১১ হাজার ২৯১টি জীবিত প্রসবের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখতে পান, ৩৬৫ শিশুর মৃত্যু ঘটেছে জন্মের ২৭ দিনের মধ্যেই। তাদের মধ্যে ৪৫ শতাংশের মৃত্যুর কারণ ছিল বার্থ অ্যাসফিক্সিয়া বা জন্মের সময় শিশুর রক্তপ্রবাহে অক্সিজেনের ঘাটতি। ওই সমীক্ষায় নবজাতকদের মৃত্যুর দ্বিতীয় কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে নির্ধারিত সময়ের আগে জন্ম/জন্মের সময় শিশুর ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে কম। এই কারণে ১৫ শতাংশ শিশুর মৃত্যু ঘটেছে। ১২ শতাংশ মারা গেছে সেপসিস/মেনিনজাইটিসে, ৭ শতাংশের মৃত্যুর কারণ ছিল রেসপিরেটরি ডিসট্রেস সিনড্রোম বা শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা, ৬ শতাংশ মারা গেছে নিউমোনিয়ায়।

এই গবেষকেরা বলেছেন, মতলব উপজেলায় বার্থ অ্যাসফিক্সিয়ায় নবজাতকের মৃত্যুর উচ্চহার বৈশ্বিক চিত্রের তুলনায় অনেক বেশি। বার্থ অ্যাসফিক্সিয়ার বৈশ্বিক গড় হার ২৩–২৯ শতাংশ। নবজাতকের রক্তপ্রবাহে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয় প্রসবের সময় প্রসূতির রক্তচাপ খুব কমে গেলে এবং তাঁর শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা হলে। ওই গবেষকেরা তাঁদের সমীক্ষাপত্রে মন্তব্য করেছেন, মতলবে নবজাতক মৃত্যুর ক্ষেত্রে বার্থ অ্যাসফিক্সিয়ার উচ্চহারের মানে হলো, সেখানকার প্রসূতিরা প্রসবের সময় যথাযথ মাতৃসেবা পাননি। এই পর্যবেক্ষণ সারা বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হতে পারে, কারণ এ দেশে ৫৩ শতাংশ সন্তান প্রসব হয় বাড়িতে, সেখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও দক্ষ ধাত্রী থাকে না, চিকিৎসকের কথা বলাই বাহুল্য। প্রসবের সময় মাতৃস্বাস্থ্যসেবার ঘাটতি শুধু নবজাতকের মৃত্যুর প্রধান কারণ নয়, প্রসূতির মৃত্যুরও প্রধান কারণ এটাই। মাতৃমৃত্যু (প্রসূতি) সম্পর্কে জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের (নিপোর্ট) ২০১৬ সালের জরিপের তথ্য হলো, প্রসবকালে ৫৪ শতাংশ প্রসূতি মারা যান অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ও খিঁচুনির কারণে। এই দুটি সমস্যা এমন গুরুতর নয় যে তা এত বিপুলসংখ্যক প্রসূতির মৃত্যু অনিবার্য করে তোলে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ও খিঁচুনি বন্ধ করার ওষুধ আছে, সেগুলো খুব দামি নয়। কিন্তু দেশের সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর ৭২ শতাংশে রক্তক্ষরণ বন্ধ করার ওষুধ সব সময় থাকে না, খিঁচুনি বন্ধ করার ওষুধ থাকে না ৬০ শতাংশ সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। তাই গ্রামাঞ্চলের প্রসূতিরা প্রসবের সময় বাড়িতে থাকলে যেমন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ও খিঁচুনিতে মারা যেতে পারে, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গেলেও একইভাবে মারা যেতে পারে। এ দুইয়ের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য থাকছে না।

সরকারি–বেসরকারি মাতৃস্বাস্থ্যসেবার মান বাড়িয়ে, প্রসবের সময় প্রসূতিকে হাসপাতাল–ক্লিনিক–স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে প্রসূতি ও নবজাতকের মৃত্যুহার আরও অনেক কমানো সম্ভব। সে জন্য দরকার মাতৃস্বাস্থ্যসেবা ক্ষেত্রের ব্যবস্থাপনা, দায়িত্বশীলতা, জবাবদিহি বাড়ানো; ধাত্রীসেবার আধুনিকায়নের জন্য ধাত্রীবিদ্যা পড়ানো ও প্রশিক্ষণের উদ্যোগগুলোর পরিধি আরও বাড়াতে হবে। এই খাতে অর্থ বরাদ্দও বাড়ানো দরকার। আমাদের বর্তমান অর্থনৈতিক সামর্থ্যের মধ্যেই এসব করা সম্ভব।

এভাবে মাতৃস্বাস্থ্যসেবার অভাবে প্রসূতি ও নবজাতকের মৃত্যুর প্রধান কারণটি অনেকাংশে লাঘব করা যাবে। কিন্তু নবজাতক মৃত্যুর যে দ্বিতীয় কারণ, অর্থাৎ জন্মের সময় নবজাতকের ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে কম—এটা প্রথম কারণের চেয়ে অনেক বেশি গুরুতর ও জটিল। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার যেসব দিকে আমরা সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে আছি এবং সম্ভবত আরও লম্বা সময় ধরে পিছিয়েই থাকব, সেগুলোর ওপর গুরুতর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে জন্মের সময় শিশুর ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে কম হওয়ার সমস্যাটি। এই সমস্যা কম সময়ে দূর করা সম্ভব কি না জানি না, কারণ এর সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে আমাদের আর্থসামাজিক ব্যবস্থার নানা দিক, যেগুলো কম সময়ে বদলানো যায় না। কম ওজনের নবজাতকদের নিয়ে আলোচনা করব এর পরের লেখায়।

মশিউল আলম: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক
[email protected]