নির্বাচনী পরিবেশের গুরুতর অবনতি

প্রায় এক মাস এক সপ্তাহ ধরে সাত ধাপে ভারতের লোকসভা নির্বাচন ১৯ মে শেষ হলো। প্রায় তিন মাস ধরে ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের অনুশাসন ও মডেল কোড অব কন্ডাক্ট অনুসরণে ব্যাপক নির্বাচনী প্রচারণা চলেছে। প্রচারণায় এগিয়ে ছিল ক্ষমতাসীন দল বিজেপি। ভারতীয় কংগ্রেসও কম যায়নি। উত্তর প্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে প্রচারযুদ্ধ ছিল তুঙ্গে; কারণ এই দুটি রাজ্যে লোকসভার আসনসংখ্যা অনেক: উত্তর প্রদেশে লোকসভার ৮০টি, পশ্চিমবঙ্গে ৪২টি। সবচেয়ে উত্তপ্ত ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস (টিএসসি) শাসিত পশ্চিমবঙ্গ। শেষ দিকে মনে হয়েছিল, এ যেন মমতা আর মোদির লড়াই। প্রায়ই লঙ্ঘিত হয়েছে ‘মডেল কোড অব কন্ডাক্ট’।

নির্বাচনী আবহাওয়া বিষাক্ত হয়েছিল প্রতিপক্ষদের পারস্পরিক কটূক্তির বন্যায়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে আঞ্চলিক শীর্ষ নেতাদের কাদা ছোড়াছুড়ির দৃশ্যে হতবাক হয়ে অনেক পর্যবেক্ষক মন্তব্য করেছেন, ভারতীয় নির্বাচনী রাজনৈতিক সংস্কৃতির উদ্বেগজনকভাবে অবনতি হয়েছে। বিশেষত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর দলের নেতাদের বক্তব্যে তাঁরা হতাশা প্রকাশ করেছেন।

প্রথম থেকেই বিতর্ক শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সামরিক বাহিনীকে নির্বাচনী প্রচারণায় টেনে আনেন। তিনি কাশ্মীরের পুলওয়ামায় পাকিস্তানিদের আক্রমণে নিহত সৈনিকদের দোহাই দিয়ে ভোট চান। এতে মডেল নির্বাচনের কোড অব কন্ডাক্ট লঙ্ঘিত হয়েছে এমন অভিযোগ ওঠে, কিন্তু নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে বিতর্ক ওঠে। সাবেক সামরিক কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রচারণায় না টানার অনুরোধ জানিয়ে রাষ্ট্রপতিকে চিঠি দেওয়া হয়। তবু প্রধানমন্ত্রী সামরিক বাহিনীর নামে ভোট চাইতে দ্বিধা করেননি। কারণ, নির্বাচন কমিশন প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যে মডেল কোড অব কন্ডাক্টের ব্যত্যয়ের উপাদান খুঁজে পায়নি।

মোদি কংগ্রেসকে আক্রমণ করতে গিয়ে প্রয়াত নেহরু, ইন্দিরা, রাজীব, সোনিয়া, রাহুল গান্ধীসহ কাউকে কটূক্তি করতে ছাড়েননি। তিনি রাজীব গান্ধীকে দুর্নীতিবাজ বলেছেন। অভিযোগ করেছেন, রাজীব ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিমানবাহীর যুদ্ধজাহাজে সপরিবার বেড়াতে গিয়েছিলেন; কিন্তু এ অভিযোগ ধোপে টেকেনি। ভারতে এই প্রথম একজন প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন ভাষণে মৃত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও কুৎসা রটানো হয়েছে। আমার জানামতে এর আগে কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের ভাষা ব্যবহার করেননি।

বিজেপির হিন্দুত্ববাদী নেতা সন্ন্যাসিনী প্রজ্ঞা ঠাকুরকে ভোপাল থেকে মনোনয়ন দেওয়ায় বিতর্ক ওঠে। তাঁকে হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসের অভিযোগে প্রায় আট বছর জেলে রাখা হয়। এখনো ওই মামলা শেষ হয়নি, তিনি জামিনে থেকে নির্বাচন করেছেন। তাঁকে ২০০৮ সালে মালেগাঁও বোমা হামলার জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছিল। তিনি ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসেকে দেশপ্রেমিক আখ্যা দিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে সুর মিলিয়েছিলেন মোদির মন্ত্রিসভার একজন সদস্য। এ নিয়ে সমগ্র ভারতে ভীষণ বিতর্ক ও ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল।

কংগ্রেস দল সংযত ছিল, তবু তারা প্রধানমন্ত্রী মোদিকে রাফায়েলের কথিত দুর্নীতি, বিশেষ করে মুকেশ আম্বানিকে সমরাস্ত্র ক্রয়ে যুক্ত করা নিয়ে ছেড়ে কথা বলেনি। রাহুল গান্ধী সারাটা প্রচারণায় প্রধানমন্ত্রী মোদিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, চৌকিদার চোর হ্যায় (চৌকিদার চোর)। মোদি নিজেকে চৌকিদার হিসেবে পরিচিত করে আসছিলেন। মায়াবতীও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে টিপ্পনী কেটেছিলেন।

ভারতে এবারের নির্বাচনে ভোট চাওয়ার ক্ষেত্রে ধর্মের ব্যাপক ব্যবহার হয়েছে। বিজেপি বরাবরের মতো হিন্দুত্ববাদীদের উসকে দিয়েই ভোট চেয়েছে ধর্মের নামে। এমনকি সেক্যুলার বলে পরিচিত দল কংগ্রেসও তা করতে পিছপা হয়নি। রাহুল গান্ধী, প্রিয়াঙ্কাসহ কংগ্রেসের অন্যরাও নিজেদের হিন্দু প্রমাণের প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন।

বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ কলকাতায় এক ‘রোড শো’ করেন, সেখানে রামের অবতার, হনুমানের আদলসহ রামায়ণের অনেক দেব–দেবী আর অবতার দর্শনের জন্য অনেককে সমবেত করা হয়েছিল। বেশির ভাগ অংশগ্রহণকারী ছিল গেরুয়া বসনধারী। সেখানে তাদের সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের বড় ধরনের সংঘর্ষ হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কলেজ। তৃণমূলের সমর্থক কিছু ছাত্র প্ল্যাকার্ড নিয়ে অমিত শাহর বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে গিয়ে বিজেপির কর্মীদের দ্বারা আক্রান্ত হন। বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙচুর করা হয়। মূর্তি ভাঙা নিয়ে দুই পক্ষে বাদানুবাদ চরমে পৌঁছে। এরপর থেকে যেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা তাঁর দলের সমাবেশগুলোতে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে মিথ্যাবাদী আখ্যা দিয়ে কান ধরে ওঠবস করার আহ্বান জানান।

পশ্চিমবঙ্গের এ পরিস্থিতির কারণে সপ্তম ধাপের ভোটের দুই দিন আগেই প্রচারণা বন্ধ করার আদেশ দেয় নির্বাচন কমিশন। এতে বিরোধী দলগুলো নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তোলে। কারণ, কমিশন এমনভাবে সময় বেঁধে দিয়েছিল, যাতে কলকাতায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জনসভা শেষ হতে পারে। অন্যদিকে তৃণমূলের প্রচারণার সুযোগ এক দিন কমে গিয়েছিল।

এই নির্বাচনে ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তি যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মোদি ও বিজেপির সভাপতি অমিত শাহর বিরুদ্ধে মডেল কোড অব কন্ডাক্টের প্রায় ৮ দফা ব্যত্যয়ের পরও তাঁদের সম্পূর্ণভাবে ছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার অশোক লাভাসা দ্বিমত পোষণ করে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছিলেন, কিন্তু প্রধান নির্বাচন কমিশনার তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। অশোক লাভাসা পরে এক চিঠিতে বলেন, কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর লিখিত দ্বিমত গৃহীত না হওয়ায় তিনি মনে করেন, নির্বাচন কমিশনের সভাগুলোতে তাঁর উপস্থিতি কোনো গুরুত্ব বহন করবে না, তাই তাঁর ২৫ মের কমিশন সভায় উপস্থিত থাকা অনিশ্চিত। এ যেন বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের ‘ক্লোন’ বা জেরক্স কপি। গত বছর নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনেও ঠিক এমনই কয়েকটি ঘটনা ঘটতে দেখেছি।

ভারতের রাজনৈতিক সংস্কৃতির এমন রূপ এর আগে কখনো দেখা যায়নি। এই নির্বাচন শুধু ভারতীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতির হতাশাব্যঞ্জক রূপই উন্মোচিত করেনি, ভারতীয় নির্বাচন কমিশনকেও বিতর্কিত করেছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ উদার গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত ভারতের এই নির্বাচনী সংস্কৃতি এই উপমহাদেশের রাজনীতি এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশে কোনো প্রভাব ফেলবে কি না, তা দেখার বিষয় হবে। তবে সমগ্র উপমহাদেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতির যে ধস নেমেছে, তা ভবিষ্যতের উদার গণতন্ত্রের জন্য সুখবর বয়ে আনবে না।

. এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, বর্তমানে অনারারি ফেলো এসআইপিজিএনএসইউ
[email protected]