গুদামে অবিক্রীত চিনি

বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) গুদামে বিপুল পরিমাণ চিনি প্রায় দুই বছর ধরে অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে আছে। সম্প্রতি বুধবার সরকারি প্রতিষ্ঠানসম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, কেন ও কার স্বার্থে এই চিনি বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়েছিল। বৈঠকে উপস্থিত বিএসএফআইসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি বলে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বলে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে।

সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ক্ষোভ যথার্থ। কারণ, তাদের প্রশ্নটি যৌক্তিক। প্রথম আলোর কাছে অবশ্য বিএসএফআইসি কর্তৃপক্ষের সূত্রে একটা ব্যাখ্যা আছে। গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিএফএসআইসির অধীন চিনিকলগুলো পর্যাপ্ত চিনি উৎপাদন করতে পারেনি বলে সংস্থাটি ২০১৭ সালে ১ লাখ ৫ হাজার টন চিনি আমদানি করেছিল। সরকারি গুদামে চিনি মজুত না থাকলে চিনি ব্যবসায়ীরা সংঘবদ্ধভাবে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে চিনির দাম বাড়িয়ে দিতে পারেন—এই আশঙ্কা থেকে ওই পরিমাণ চিনি আমদানি করা হয়েছিল।

কিন্তু দেখা যাচ্ছে, গত দুই বছরে এর অর্ধেকের কিছু বেশি পরিমাণ চিনি বিক্রি হয়েছে, ৪৪ হাজার টন অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে আছে। তাহলে চিনি আমদানি করার সিদ্ধান্তটি বাস্তব বিবেচনাপ্রসূত ছিল না, এটা ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়েছে। বিএফএসআইসির দায়িত্ব হলো, তাদের অধীন চিনিকলগুলোতে আখ থেকে চিনি উৎপাদন করা, বিদেশ থেকে চিনি আমদানি করা নয়। এই সংস্থার অর্থনৈতিক সুরক্ষার কথা ভেবে সরকার চিনি আমদানিতে উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ করে রেখেছে। কিন্তু সংস্থাটি নিজেই ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে চিনি আমদানি করেছে; তা করার প্রয়োজন আসলেই ছিল কি না, তা ভালো করে যাচাই করা হয়নি।

আমাদের বিবেচনায়, বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে বিদেশ থেকে চিনি আমদানি করার প্রয়োজন অন্তত সরকারি সংস্থাটির ছিল না। কারণ, দেশের মোট চাহিদার তুলনায় বেশি পরিমাণ চিনি উৎপাদনের ক্ষমতা দেশের ভেতরেই রয়েছে। মোট বার্ষিক চাহিদা ১৪ লাখ টন; যদিও বিএসএফআইসির অধীন ১৫টি চিনিকলের মোট বার্ষিক উৎপাদন মাত্র ৬০ হাজার টনের কাছাকাছি, কিন্তু বেসরকারি খাতের চিনিকল ও চিনি পরিশোধন কারখানাগুলোর মোট উৎপাদনক্ষমতা দেশের চাহিদার দ্বিগুণের বেশি। অর্থাৎ দেশের চিনির বাজারে ঘাটতি নেই, আর কখনো ঘাটতি দেখা দিলে বিএসএফআইসি এক লাখ বা দুই লাখ টন চিনি আমদানি করে তা পূরণ করতে পারবে না।

প্রকৃতপক্ষে দেশের চিনির চাহিদা ও সরবরাহব্যবস্থার ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণের সুযোগ নেই; তেমন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ভাবনা বাস্তবসম্মতও নয়। চিনি ব্যবসায়ীদের অসাধু অংশ সংঘবদ্ধ কারসাজির মাধ্যমে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়াতে তৎপর হলে তা প্রতিরোধ করার ফলপ্রসূ উপায় হতে পারে সরকারি চিনিকলগুলোর উৎপাদনক্ষমতা বাড়ানো এবং উৎপাদিত চিনি প্রতিযোগিতামূলক দামে বাজারে সরবরাহ করা; বিদেশ থেকে চিনি আমদানি করা নয়। কিন্তু বিএসএফআইসির অধীন ১৫টি চিনিকলের মোট উৎপাদনক্ষমতা দেশের মোট চাহিদার তুলনায় খুবই কম। উপরন্তু সেগুলোর উৎপাদন খরচ এত বেশি যে তারা উৎপাদিত সব চিনি বিক্রি করতে পারে না। সব সরকারি চিনিকলই লোকসানি প্রতিষ্ঠান, গত ১৬ বছরে তাদের মোট লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা। বিএসএফআইসি চলছে ঋণ করে, তাদের ঋণের পরিমাণ প্রায় চার হাজার কোটি টাকা।

এই ঋণগ্রস্ত সংস্থা আরও ঋণ নিয়ে বিদেশ থেকে চিনি আমদানি করে বাস্তব বুদ্ধির পরিচয় দেয়নি; বরং চিনি আমদানির পেছনে কোনো ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থের বিবেচনা কাজ করেছে কি না, তা তদন্ত করে দেখা প্রয়োজন।