হুয়াওয়েকে দিয়েই শীতল যুদ্ধের শুরু!

হুয়াওয়ে মোবাইল ফোনকে আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি সাব্যস্ত করা একটি আদেশে ডোনাল্ড ট্রাম্প যেদিন সই করেছেন, সেদিনই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের চলমান বাণিজ্যযুদ্ধে এমন একটি মাত্রা যুক্ত হয়েছে, যা দুই দেশের বৈরিতাকে আরও গভীর করে তুলবে। ট্রাম্পের কলমের ছোট্ট খোঁচাটির কারণে যে কত বড় ও কত সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়ার জন্ম হচ্ছে, তা হয়তো তিনি নিজেও আন্দাজ করতে পারছেন না। এই সইয়ের নেতিবাচক প্রভাবে আগামী বেশ কয়েক বছর যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বকে খেসারত দিতে হবে।

এর আগে যুক্তরাষ্ট্র হুয়াওয়ের নির্বাহী কর্মকর্তা মেং ওয়াংঝৌকে গ্রেপ্তার করেছে, চীনা টেলিকম কোম্পানি জেডটিইকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে। তবে এবার তারা হুয়াওয়েকে ‘শ্বাসরোধ করে’ মেরে ফেলার চেষ্টা চালিয়েছে। ট্রাম্পের নির্দেশে হুয়াওয়েকে হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার সেবা বন্ধ করেছে গুগলের প্যারেন্ট কোম্পানি অ্যালফাবেট। হুয়াওয়ে কোম্পানিকে চীনে একটি ন্যাশনাল আইকন হিসেবে দেখা হয়। কোম্পানিটির বিরুদ্ধে ট্রাম্পের এই ব্যবস্থা গ্রহণকে চীনের মানুষ চীনের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা হিসেবে মনে করছে। তারা এতে যারপরনাই ক্ষুব্ধ হয়েছে।

সম্প্রতি ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র আর কোনো দিন চীনের সঙ্গে ‘ফিফটি-ফিফটি’ ভিত্তিতে চুক্তি করবে না। চীনকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো চুক্তি করতে হলে অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রকে বেশি লাভ দিতে হবে। ট্রাম্পের এই বক্তব্যও একটি বড় অন্তর্ঘাত ছিল। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ট্রাম্প এবং আমেরিকান সরকার চীনের সংস্কৃতি সম্পর্কে মারাত্মকভাবে অজ্ঞ। ট্রাম্পের এই বক্তব্য চীনা নাগরিকদের মধ্যে ক্ষোভ উসকে দিতে বাধ্য, কারণ ঊনবিংশ ও বিংশ শতকে পশ্চিমা দেশগুলো চীনের সঙ্গে কী ধরনের অপমানজনক আচরণ করেছে, তা তারা ভুলে যায়নি।

ট্রাম্পের কথাবার্তা ও কাজ–কারবার চীনা নাগরিকদের মধ্যে এই ভাবনা তৈরি করছে যে আমেরিকা তাদের অগ্রগতি ও উত্থান ঠেকিয়ে রাখতে চায়। চীন চায় তাকে যুক্তরাষ্ট্রের মতোই মান্যগণ্য করা হোক। এ কারণে চীনের জন্য অসুবিধার কারণ হবে এমন কোনো চুক্তিতে তারা সই করবে না। দিন যত পার হচ্ছে, তত যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্যযুদ্ধ অবসানের সম্ভাবনা ফিকে হতে থাকছে।

ট্রাম্পের চীনবিরোধী নীতি কংগ্রেসে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট—উভয় দলের নেতাদের সমর্থন পেয়েছে। তার মানে বোঝা যাচ্ছে, আমেরিকায় চীনবিদ্বেষ ভয়ানক রূপ নিচ্ছে এবং নীতিনির্ধারণেও তার প্রতিফলন ঘটছে। চীন এমন এক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে, যাকে যুক্তরাষ্ট্রের সব রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান আমেরিকার জন্য বড় বাধা বলে মনে করছে।

ট্রাম্প হয়তো ভেবেছেন, হুয়াওয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলে চীন কাকুতি–মিনতি করে একেবারে হাঁটু গেড়ে যুক্তরাষ্ট্রের পায়ে এসে পড়বে এবং তখন একটা লাভজনক চুক্তি করে নেওয়া যাবে, কিন্তু সেটা ভেবে থাকলে তিনি খুবই ভুলের ভেতরে আছেন। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, চীন এখন গুগল অ্যান্ড্রয়েডের বিকল্প কোনো স্মার্টফোন অপারেটিং সিস্টেম নিজেরা তৈরি করার জন্য মরিয়া হয়ে কাজ করবে এবং তারা সফল হবে। অনেক বছর ধরেই চীন টুইটার, গুগল ও ফেসবুকের নিজস্ব সংস্করণ ব্যবহার করে আসছে। একই সঙ্গে চীন আমেরিকান কোম্পানিগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ রেখেছে। এতে চীনা ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি আমেরিকার ব্যবসায়ীরাও লাভবান হয়েছেন।

এখন যুক্তরাষ্ট্র সফটওয়্যার সেবা দেওয়া বন্ধ করায় হুয়াওয়েকে বাধ্য হয়ে আমেরিকার প্রযুক্তি ছাড়াই সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রযুক্তিতে সফটওয়্যার তৈরি করতে হবে। এতে আমেরিকা ও চীনের মধ্যে একটি ডিজিটাল লৌহপর্দা পড়ে যাবে। হুয়াওয়েকে সফটওয়্যার সেবা দেওয়ায় আগে দুই দেশের ব্যবসায়ীরা যে আর্থিক সুবিধা ভোগ করতে পারতেন, এখন আর তা পারবেন না। এখন বেকায়দায় পড়ে হলেও চীনকে অ্যান্ড্রয়েড সিস্টেমের বিকল্প সফটওয়্যার বানাতে হচ্ছে। কিন্তু আজ হোক আর কাল হোক, এমন দিন অবশ্যই আসবে, যখন বিশ্বের অন্য দেশগুলোকে হয় আমেরিকান অ্যান্ড্রয়েড সিস্টেম অথবা চীনা অ্যান্ড্রয়েড সিস্টেম—এই দুটোর একটিকে বেছে নিতে হবে।

প্রকৃতপক্ষে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তিগত শীতল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। চীন হয়তো বিকল্প অ্যান্ড্রয়েড সিস্টেম বানানোর জন্য কঁাড়ি কঁাড়ি অর্থ ঢালবে এবং চট করে তাতে তারা সফল হয়তো হবে না, কিন্তু এই আবিষ্কারের পথে অনেক ধরনের অর্জন তার হাতে ধরা দেবে। প্রযুক্তিতে আমেরিকা অনেক এগোনো, এ কথা ঠিক। কিন্তু ফাইভ–জি দৌড়ে হুয়াওয়ে এগিয়ে আছে। সুতরাং প্রযুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য চিরকালীন না–ও হতে পারে।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত

মা জাহি হং সিঙ্গাপুরভিত্তিক প্রযুক্তিবিষয়ক লেখক