বিজেপির বিজয় অপ্রত্যাশিত ছিল না

লোকসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণার শুরুতেই ক্ষমতাসীন দল বিজেপির প্রার্থীদের জয়-জয়কার। ফের ক্ষমতায় ফেরার আনন্দে উচ্ছ্বসিত দলটির কর্মী-সমর্থকেরা। শিলিগুড়ি, ভারত, ২৩ মে। ছবি: এএফপি
লোকসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণার শুরুতেই ক্ষমতাসীন দল বিজেপির প্রার্থীদের জয়-জয়কার। ফের ক্ষমতায় ফেরার আনন্দে উচ্ছ্বসিত দলটির কর্মী-সমর্থকেরা। শিলিগুড়ি, ভারত, ২৩ মে। ছবি: এএফপি

আবারও মোদি ম্যাজিকে কুপোকাত হলো তাঁর বিরোধীরা। তবে তাঁর এই পরপর দুই মেয়াদে নির্বাচিত হওয়া খুব আশ্চর্যের ব্যাপার নয়। এই মুহূর্তে ভারতে যা দরকার মোদি ঠিক তাই দিতে পারছেন। যদিও হিন্দুত্ববাদ, গোমাংস খাওয়া নিয়ে মুসলমানদের ওপর হামলা, প্রগতিশীল লেখকদের হত্যা ও আক্রমণ—এসব নানা কারণে তিনি কলঙ্কিত হয়েছেন। ঋণ খেলাপি হিরা ব্যবসায়ী নীরব মোদির ব্যাপারে প্রথম দিকে নীরব থাকা নিয়েও তাঁর সমালোচনা হয়েছে।

কিন্তু ২০১৪ সালে কোন পরিপ্রেক্ষিতে মোদি ক্ষমতায় আসলেন, সেটি মাথায় রাখা দরকার। তার আগে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার পর পর দুই মেয়াদে ক্ষমতায় ছিল। তাদের দ্বিতীয় মেয়াদের শেষের দিকে ভারতের প্রশাসনে স্থবিরতা নেমে আসে। তার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব মন্ত্রীর বিরুদ্ধেই ছিল দুর্নীতির অভিযোগ। প্রয়াত ভারতীয় সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারের লেখা থেকে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনমোহন সিং ছিলেন রাবার স্ট্যাম্পের মতো। সব ফাইল নাকি সোনিয়া গান্ধীর বাড়িতে যেত। সেখান থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হতো। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনমোহন সিংও তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন না। ফলে পুরো ব্যবস্থাই প্রায় অচল হতে বসেছিল।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির ব্যবধান যোজন যোজন। তবে ভারতের আজকের শনৈঃ শনৈঃ উন্নতির পেছনে মনমোহন সিংয়ের অবদান অনেক। তিনিই অর্থমন্ত্রী হিসেবে অর্থনীতির উদারীকরণ ও আধুনিকায়নের নেতৃত্ব দেন। কিন্তু ২০০৪ সালে নির্বাচনে জয়ের পর সোনিয়া গান্ধী জন্মসূত্রে ইতালির নাগরিক হওয়ার কারণে প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। প্রধানমন্ত্রী হন মনমোহন সিং। যদিও কার্যত ক্ষমতা থেকে যায় সোনিয়া গান্ধীর হাতে। সম্ভবত, এ কারণেই মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পুরোপুরি কার্যকর হতে পারেননি।

কংগ্রেসের জমানায় ভারতের প্রবৃদ্ধির হার এখনকার চেয়ে বেশি ছিল। কিন্তু এই যুগে ভারতের যেটা দরকার মোদি তা দিতে পেরেছেন। তা হলো, শক্তিশালী নেতৃত্ব। তিনি একজন শক্তিশালী শাসক, তাঁর নেতৃত্বে ভারত বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক রাজনীতির পরবর্তী স্তরে যেতে পারবে, দরকার হলে তার জন্য প্রতিবেশী দেশের ভেতরে গিয়ে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করতেও পারবে, নিজের এই ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন তিনি। তিনি এখন ভারতের সুপারম্যান। তাঁর নেতৃত্বে সামনে ভারতের সুদিন-আমজনতা তা কমবেশি বিশ্বাস করে। অন্যদিকে নিজ দলের গেরুয়া মতবাদকে ভারতের জাতীয়তাবাদে রূপান্তরিত করতে পেরেছেন তিনি। ক্রমবর্ধমান মুসলমান জনসংখ্যার ভীতি কাজে লাগিয়ে তিনি অত্যন্ত কৌশলে তা করতে পেরেছেন। অন্যান্য দল মুসলমান ভোট টানতে যে প্রতিযোগিতায় নেমেছে তাতে দেশটির সংখ্যাগুরুরা কিছুটা আতঙ্কিত। তাদের আশ্বস্ত করতে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করেছে বিজেপি। আবার সেই মোদি সৌদি আরব, ইরান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করেছেন। মুসলিম বিশ্বের পুরোধারা তাঁকে ডেকে নিয়ে সম্মাননা দিয়েছেন। এতে আবার মুসলমান সম্প্রদায় আশ্বস্ত হয়েছে। তাদের মন জোগাতে এবার ছয়জন মুসলমান প্রার্থীও দিয়েছে বিজেপি।

করপোরেটরা দ্রুত সিদ্ধান্ত চায়। আমলতান্ত্রিক জটিলতা ছাড়া কাজ করতে পারাটা তাদের কাছে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ব্যাপার। মোদি সেটা অনেকটাই নিশ্চিত করতে পেরেছেন। তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিতে তাঁর জুড়ি নেই। এর আগে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে রাজ্যটিকে তিনি ভারতের সবচেয়ে আধুনিক ও ব্যবসা-সফল রাজ্য পরিণত করতে পেরেছেন। সে জন্য করপোরেটরা তাঁর ওপর আস্থা রেখেছেন। তিনিও প্রতিদান দিয়েছেন। বিশ্ব ব্যাংক বলছে, গত চার বছরে ভারতে ব্যবসা করা অনেক সহজ হয়েছে। তবে গত দুই বছরে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে দেশটির। কোন দেশে কত সহজে ব্যবসা করা যায়, সেই সূচকের ভিত্তিতে বর্তমানে বিশ্বের ১৯০টি দেশের তালিকায় ভারত উঠে এসেছে ৭৭ নম্বরে। ২০১৪ সালে এই তালিকায় ভারত ছিল ১৪২ নম্বরে। বিশ্ব ব্যাংকের ইজি অব ডুয়িং বিজনেস প্রতিবেদন অনুযায়ী, নরেন্দ্র মোদির সরকার গঠনের পর সহজে ব্যবসা করার সূচকের নিরিখে ওই তালিকায় ভারত পেছন থেকে ৬৫টি স্থান টপকে সামনে এগিয়ে এসেছে। শুধু গত দুই বছরে আরও ৫৩টি দেশকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেল ভারত। স্যামসাং ভারতে বিশাল কারখানা করেছে এই মোদির যুগেই। অ্যাপল ও আমাজনের মতো প্রতিষ্ঠান ভারতে এখন চুটিয়ে ব্যবসা করছে।

অন্যদিকে মোদির প্রথম জমানায় এক রাফায়েল কেলেঙ্কারি ছাড়া বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ ওঠেনি। এ ছাড়া তাঁর নীতির সুফলও মানুষ পাচ্ছেন। মোদি রিয়েল এস্টেট রেগুলেশন অ্যাক্ট বা রেরা নামে একটি আইন করেছেন। এই আইনের আওতায় ডেভেলপারদের বলতে হবে, তাঁর বিক্রীত ফ্ল্যাটটি কত বর্গফুটের, কত টাকায় তিনি সেটা বিক্রি করেছেন। ফলে প্রতারক প্রকৃতির ডেভেলপাররা সত্যটা বলতে বাধ্য হচ্ছেন। তাঁদের ওপর এটা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এরপর বড় নোট বাতিল বা ডিমনিটাইজেশনের প্রসঙ্গে আসি, ধনী লোকেরা আহা উহু করেন, এতে গরিব মানুষদের ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু গরিব মানুষের ক্ষতি হলে তাঁরা মোদিকে ভোট দেবেন কেন?

দ্বিতীয়ত, নোট বাতিলের কারণে সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজদের টাকা অচল হয়ে গেছে। যারা জাল নোট বানাত, তাদের টাকা অচল হয়ে গেছে। এরপর জিএসটিও দারুণ একটা ব্যাপার। এর সমস্যা হলো, এতে অনেক বেশি স্তর আছে। সিঙ্গাপুরে সবকিছুর ওপর সোজাসুজি ১০ শতাংশ রাজস্ব দিতে হয়, ভারতে সেটা করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া কৃষকদের হিসাবে সরাসরি ভর্তুকির টাকা পাঠানোসহ কৃষক বান্ধব নানা কর্মসূচি তিনি নিয়েছেন। গত বছর ফসলের দাম কমে যাওয়ায় কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এসব প্রকল্পের প্রভাব অনস্বীকার্য। ভোটের ফলাফলেই তা পরিষ্কার।

রাজনীতিতে সম্ভবত আদর্শের দিন শেষ। সারা পৃথিবীতেই এখন জনতুষ্টিবাদের জোয়ার চলছে। শাসকেরা এখন স্ট্রংম্যান—ট্রাম্প, মোদি, দুতার্তে, মাহাথির মোহাম্মদ প্রমুখ। বহুদলীয় গণতন্ত্রের রীতিনীতি মেনে শাসন পরিচালনা করা এদের সাজে না। তাঁরা সবকিছু ভেঙেচুড়ে দিয়ে নিজ সমর্থকদের তুষ্ট করতে চান। ভারতের মতো বর্ধিঞ্চু দেশের মানুষও এ রকম একজন স্ট্রংম্যানের অপেক্ষা করছিলেন। অন্যদিকে কংগ্রেসসহ অন্যরা মানুষকে কোনো বিকল্প কিছুর সন্ধান দিতে পারেনি। তাই গুজরাট দাঙ্গাসহ নানা কারণে কলঙ্কিত হলেও মোদির এই জয়জয়কার।

প্রতীক বর্ধন: সাংবাদিক
ই-মেল: [email protected]