অভিবাসনের মরিয়া প্রয়াস

বাংলাদেশের যুবসমাজের একটা বড় অংশের বিদেশ যাওয়ার আগ্রহ অত্যন্ত প্রবল। একদিকে স্বদেশে কর্মসংস্থানের প্রকট ঘাটতি, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তাবোধের অভাব, স্বদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে হতাশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি তাদের বিদেশমুখী করে। তাদের ধারণা, বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত, সেখানে স্বদেশের তুলনায় আয় বেশি, অপেক্ষাকৃত উন্নত জীবনযাপনের সুযোগ-সুবিধাগুলো সহজলভ্য। অনেকে স্বপ্ন দেখেন, বিদেশে গিয়ে অনেক টাকা আয় করে স্বদেশে পাঠাবেন, ফলে পরিবারের ভাগ্য বদলাবে।

বিদেশ যেতে আগ্রহী তরুণ-যুবকদের এসব ধারণা বা স্বপ্ন অমূলক নয়; প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো অর্থ বা রেমিট্যান্সের অঙ্কের দিকে তাকালে সেটা বোঝা যায়। রেমিট্যান্স বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খাত। ১ কোটির বেশি প্রবাসী বাংলাদেশি স্বদেশে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাচ্ছেন। ২০১৮ সালে তাঁরা পাঠিয়েছেন মোট ১ হাজার ৫৫৪ কোটি মার্কিন ডলার। সুতরাং আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের অবদান বিরাট। বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে যখন কর্মক্ষম লোকজনের পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব হচ্ছে না, তখন তাঁদের একটা অংশের বিদেশ যাওয়ার আগ্রহকে আমরা ইতিবাচকভাবেই দেখতে চাই। তবে তাঁরা কী প্রক্রিয়ায় বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করছেন, সেই চেষ্টার কোন পর্যায়ে কী ধরনের সমস্যা ও বিপদের মুখোমুখি হচ্ছেন, সেই প্রক্রিয়ায় বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কতটা ক্ষুণ্ন হচ্ছে এবং তার পরিণতিতে আরও কী কী সমস্যা দেখা দিচ্ছে—এসব বিষয় ভেবে দেখা প্রয়োজন।

বিদেশ যাওয়ার পথগুলো ততটা সুগম নয়, বরং কিছু পথ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কিছুদিন আগেই লিবিয়া থেকে নৌকায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে ডুবে মারা গেলেন ৪০ জন বাংলাদেশি। এর আগে ২০১৫ সালের আগস্ট মাসেও ইউরোপে অভিবাসন-প্রত্যাশী বাংলাদেশি নাগরিকদের ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে নৌকাডুবিতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। সাহারা মরুভূমি পাড়ি দিতে গিয়েও অনেকের মৃত্যু হয়েছে।

পথের মৃত্যু এড়িয়ে যাঁরা কাঙ্ক্ষিত দেশে গিয়ে পৌঁছাতে পারছেন, তাঁদের সবাই যে সেখানে মর্যাদার সঙ্গে বৈধ কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছেন, তা মোটেই নয়। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এখন এক লাখের বেশি বাংলাদেশি নাগরিক অবৈধভাবে অবস্থান করছেন। সেখানে তাঁদের জীবনযাপন সুখকর নয়, আয়-রোজগারও প্রত্যাশিত রকমের নয়। যাঁরা তাঁদের অবৈধভাবে কাজে নিয়োগ করেন, তাঁরা কম মজুরি দেন; পুলিশি হয়রানির আশঙ্কা থাকে। অনেকে কারাগারে আছেন। তাঁদের এই দুরবস্থা সংশ্লিষ্ট দেশের সরকার ও জনগণের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে। আগামী মাসে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠেয় বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলা দেখতে যাওয়ার সুযোগ নিতে অনেক অভিবাসনপ্রত্যাশী বাংলাদেশি তৎপর হয়ে উঠেছেন বলে সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। প্রায় ১০ হাজার বাংলাদেশি নাগরিক অনলাইনে খেলার টিকিট কিনে ফেলেছেন, তাঁরা যুক্তরাজ্যের ভিসা পাওয়ার চেষ্টা করছেন এবং এই সুযোগে বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সি তাদের ভিসা পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস নিয়ে তৎপর হয়ে উঠেছে। তারা নানা রকমের প্রতারণামূলক তৎপরতা চালাচ্ছে।

গত বছর রাশিয়ায় বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা দেখতে গিয়ে কিছু বাংলাদেশি অবৈধভাবে ইউরোপে পাড়ি দেওয়ার পথে পুলিশের কাছে ধরা পড়েছিলেন। এবার বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলা দেখতে যাঁরা ইংল্যান্ড যাবেন, তাঁদের একাংশও যে সেখানে থেকে যাওয়ার বা ইউরোপের অন্য দেশে থেকে যাওয়ার চেষ্টা করবেন না, এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এ ধরনের অবৈধ তৎপরতার ফলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হচ্ছে, শ্রেণি-নির্বিশেষে সব বাংলাদেশি নাগরিক সম্পর্কে বিদেশে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে, বৈধভাবে বিদেশ যেতে আগ্রহী বাংলাদেশিদের জন্য বিভিন্ন দেশের ভিসা পাওয়া আরও কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

অবৈধভাবে বিদেশ যাওয়ার সব পথ বন্ধ করতে হবে। কাজটা সহজ নয়, কিন্তু সে জন্য নির্বিকার বসে থাকা চলবে না। বৈধভাবে বিদেশ যাওয়ার পথ সুগম করার উদ্যোগ নিতে হবে।