ভারতে নির্বাচন: গণমাধ্যম কেন 'গণের' মনোভাব বুঝতে পারে না!

ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণা হয়েছে গত বৃহস্পতিবার। এতে ভূমিধস জয় পেয়ে ফের ক্ষমতায় এসেছেন নরেন্দ্র মোদি। শুক্রবার ভারতের পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতা তাই ভরে গেছে মোদিবন্দনায়। গতকাল চেন্নাইয়ের একটি পত্রিকার দোকানে।  ছবি: এএফপি
ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণা হয়েছে গত বৃহস্পতিবার। এতে ভূমিধস জয় পেয়ে ফের ক্ষমতায় এসেছেন নরেন্দ্র মোদি। শুক্রবার ভারতের পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতা তাই ভরে গেছে মোদিবন্দনায়। গতকাল চেন্নাইয়ের একটি পত্রিকার দোকানে। ছবি: এএফপি

বৃহস্পতিবার সকালে এক অগ্রজ বন্ধু অনেকটা ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, ‘আপনারা এত দিন যেসব ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণ দিলেন, তা তো মিলল না। আপনারা যেসব খবর ও বিশ্লেষণ পাঠিয়েছেন, তাতে মনে হয়েছিল, মোদি থাকবেন না। বিজেপিকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু বিজেপি তো আরও বেশি আসন নিয়ে ক্ষমতায় এল।’ পশ্চিমবঙ্গের কথা উল্লেখ করে তিনি বললেন, মমতা দিদি এখন কী বলবেন। তিনি তো মোদিকে ভারত থেকে বিদায় দিতে চেয়েছিলেন।

কিন্তু বন্ধুর কথা পুরোপুরি সত্য না হলেও ভারত ও বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোর খবর ও বিশ্লেষণে যে বিজেপিবিরোধীরা অধিক গুরুত্ব পেয়েছিল, তাতে সন্দেহ নেই। এর একটি কারণ হতে পারে, বিজেপি যেহেতু ক্ষমতায় সেহেতু গণমাধ্যম তার ভুলত্রুটি বেশি তুলে ধরেছে। বিরোধী রাজনীতিকেরা ৩৩ দলের না ৬৩ দলের জোট হবে তা নিয়ে বছরজুড়ে তৎপরতা দেখিয়েছেন, মহা মহা সমাবেশ করেছেন, তারও প্রভাব গণমাধ্যমে থাকতে পারে।

এ ছাড়া লোকসভা নির্বাচনের আগে যে কটি বিধানসভা নির্বাচন হয়েছিল, বেশির ভাগ রাজ্যে কংগ্রেস ও এর সমর্থকেরা জিতেছে। আরেকটি কারণ হতে পারে গণমাধ্যম তৃণমূলের জনগণের পালস বা মনোভাবটা ধরতে পারে না। এটি শুধু ভারতে নয়, মোটামুটি সারা বিশ্বেই হয়ে এসেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে সেখানকার প্রথম শ্রেণির প্রায় সব পত্রিকা হিলারি ক্লিনটনকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল। জনমত জরিপেও এগিয়ে রাখা হয়েছিল হিলারি ক্লিনটনকে। নিউইয়র্ক টাইমস ঘোষণা দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। কিন্তু তাঁর বিজয় ঠেকাতে পারেনি।

গণমাধ্যমের কাজ কাউকে ক্ষমতায় রাখা বা নেওয়া নয়। গণমাধ্যম জনগণের মতকে তুলে ধরবে। ভালো–মন্দ বিচার করবে। বাংলাদেশ ১৯৯১ সালের নির্বাচনে প্রায় সব গণমাধ্যমের ভবিষ্যদ্বাণী ছিল আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়ী হবে। বাস্তবে জিতেছিল বিএনপিই। আশি ও নব্বই দশকে পশ্চিমবঙ্গে প্রতিটি বিধানসভা নির্বাচনের আগে আনন্দবাজার পড়লে মনে হতো এবার বাম ফ্রন্টের রক্ষা নেই।

তাই ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ফল দেখে মনে হয়েছে সেখানকার গণমাধ্যমগুলোও ভোটারদের মনোভাব বুঝতে পারেনি। আমাদের গণমাধ্যম ভারতের গণমাধ্যমের প্রতিধ্বনি করেছে। এবার লোকসভা নির্বাচন ভারতের বিরোধী রাজনীতিকদের তো বটেই, সব দেশের গণমাধ্যমের জন্যও একটি শিক্ষণীয় বিষয় হতে পারে।

এবার নির্বাচনটি হয়েছে মোদি বনাম বাকি ভারত। অনেকটা গণভোটের মতো। অন্যদের পুঁজি ছিল বিজেপি বা মোদির বিগত পাঁচ বছরের শাসনের ব্যর্থতা, প্রতিশ্রুতি পূরণ না করা। বিরোধীরা এমন কোনো কর্মসূচি দিতে পারেনি, যাতে জনগণ তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। শেষ দিকে এসে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী প্রতি পরিবারকে ছয় হাজার টাকা মাসিক সহায়তা দেওয়ার কথা বলে চমক দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মোদির পুলাওয়ামা ও উড়ি চমকের কাছে সেটি পাত্তাই পায়নি। বিজেপিকে জিতিয়ে নিতে মোদি একাই যথেষ্ট। তিনি ভারতকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। কিন্তু বিরোধী দলে এমন কোনো নেতা নেই যিনি ভারতকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন।

রাহুল গান্ধী বলেছেন, মোদির সঙ্গে তাঁর লড়াই আদর্শের। কংগ্রেস বহুত্ববাদী ভারতের সমর্থক। বিজেপি একসত্তাবাদী। মোদি ও তাঁর টিম বোঝাতে পেরেছেন, ভারতের নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব এবং ধর্ম তথা হিন্দুত্ব তাদের হাতেই নিরাপদ। এই স্লোগানকে শুধু হিন্দিবলয় নয়, সমগ্র ভারতই গ্রহণ করেছে। অন্যদিকে বিরোধী দল মোদির জমানা শেষ করে দেওয়ার ঘোষণা দিলেও তারা একক কোনো জোট করতে পারেননি। মমতা, মায়াবতী, চন্দ্রবাবু নাইডু প্রমুখ কংগ্রেসের বাইরে যে তৃতীয় ফ্রন্ট নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করেছেন, তা শেষ পর্যন্ত বিজেপির পক্ষেই গিয়েছে। এসব আঞ্চলিক নেতারা দিল্লি জয় করার বাসনা ব্যক্ত করলেও তাঁদের পায়ের তলার মাটি যে সরে গেছে, সেটি উপলব্ধি করতে পারেননি। আবার উদার গণতন্ত্রী আঞ্চলিক দলগুলো বামদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, যা শেষ বিচারে বিজেপির পক্ষে গিয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমবঙ্গের কথা বলতে পারি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এসে বিরোধীদের শুধু নির্মূল করার কৌশল নিয়েছেন। তিনি চেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল ছাড়া আর কোনো দল থাকবে না। স্থানীয় পর্যায়ের কোনো নির্বাচনে বিরোধীদের দাঁড়াতেই দেননি। ফলে এই কর্মীরা বিকল্প হিসেবে বিজেপিকে বেছে নিয়েছেন। অতীতে বাম ফ্রন্টের নেতা-কর্মীদের দৌরাত্ম্যে টিকতে না পেরে অনেকে যেমন তৃণমূলে ভিড়েছিলেন। অর্থাৎ মমতার কৌশল এখন বুমেরাং হয়েছে। তাঁর উচিত ছিল অতীতের হিংসা দ্বেষ ভুলে কংগ্রেস ও বাম ফ্রন্টের সঙ্গে জোট বেঁধে বিজেপিকে মোকাবিলা করা। তাঁর ২০১৪ সালের জনপ্রিয়তা অটল থাকারও কোনো কারণ নেই। তিনি সুশাসন ও সমৃদ্ধি কোনোটাই দিতে পারেননি। ফলে এ কথা বলা ভুল হবে না যে মমতা বিজেপির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে তিনিই পশ্চিমবঙ্গের জন্য গেরুয়া শাসনের পথ সুগম করলেন।

আমাদের ধারণা, ভারতের প্রবীণ কূটনীতিক মুচকুন্দ দুবে লোকসভা নির্বাচন সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়নটি করেছিলেন। মাস দুই আগে প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, মোদিই জিতবেন। তবে তিনিও মনে করেছিলেন, বিজেপির আসন কমতে পারে। কিন্তু ফলাফলে দেখা গেল আরও বেশি আসন নিয়ে বিজেপি ও এনডিএ জোট ক্ষমতায় এসেছে।

একজন বিশ্লেষক মন্তব্য করেছেন: রাজনীতিতে সম্ভবত আদর্শের দিন শেষ। সারা পৃথিবীতেই এখন জনতুষ্টিবাদের জোয়ার চলছে। শাসকেরা এখন স্ট্রংম্যান—ট্রাম্প, মোদি, দুতার্তে, মাহাথির মোহাম্মদ প্রমুখ। বহুদলীয় গণতন্ত্রের রীতিনীতি মেনে শাসন পরিচালনা করা এঁদের সাজে না। তাঁরা সবকিছু ভেঙেচুরে দিয়ে নিজ সমর্থকদের তুষ্ট করতে চান। ভারতের মতো বর্ধিঞ্চু দেশের মানুষও এ রকম একজন স্ট্রংম্যানের অপেক্ষা করছিলেন। অন্যদিকে কংগ্রেসসহ অন্যরা মানুষকে কোনো বিকল্প কিছুর সন্ধান দিতে পারেনি। তাই মোদির এই জয়জয়কার।

পশ্চিমবঙ্গের বিজেপির উত্থান বিস্ময়কর। ২০১৬-র বিধানসভার চেয়ে এবারের লোকসভায় তৃণমূলের ভোট প্রায় ২ শতাংশ কমেছে। আর বিজেপির ভোট বেড়েছে ৩০ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের আসন দাঁড়াল ২২। বিজেপি ১৮। মমতার জন্য এটি অশনিসংকেতও বটে। আনন্দবাজার লিখেছে, এই মেরুকরণকে নিছক সাম্প্রদায়িক বললে তা খণ্ড সত্য হবে। এর বাইরেও আরও একটি মেরুকরণ এবার স্পষ্ট। সিপিএম এবং কংগ্রেস কার্যত মুছে যাওয়ার মতো অবস্থায় পৌঁছেছে এবার। সিপিএম একটি আসনও পায়নি। ভোট মাত্র ৮ শতাংশ। কংগ্রেস দুটি আসন পেলেও ভোট ৬ শতাংশও নয়। অর্থাৎ শাসক এবং বিরোধী ভোট সরাসরি দুটি শিবিরে ভাগ হয়ে গেল। যার অর্থ ২০২১-এ বিধানসভার লড়াই হবে মুখোমুখি—বিজেপির সঙ্গে তৃণমূলের। কিন্তু শুধু আনন্দবাজার কেন কোনো গণমাধ্যমই জনগণের মনোভাব আঁচ করতে পারেনি। নির্বাচনের আগে কোনো গণমাধ্যম কংগ্রেস বা মমতাকে সতর্কও করে দেয়নি।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
ই-মেইল: [email protected]