মোদির বিজয় ট্রাম্পের জন্য সুখবর!

নরেন্দ্র মোদি ও ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফাইল ছবি
নরেন্দ্র মোদি ও ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফাইল ছবি

নরেন্দ্র মোদির বিজয়ে সবাই যে খুব বিস্মিত হয়েছে, তা মনে হয় না। তবে যে ব্যবধানে তাঁর নির্বাচনী জোটের বিজয় হয়েছে, তাতে অবাক হতেই হয়। তার চেয়েও বিস্ময়কর কংগ্রেস ও বিরোধী জোটের লেজেগোবরে অবস্থা। আঙুল উঠেছে কংগ্রেসের তরুণ নেতা রাহুল গান্ধীর দিকে। আমেথিতে নিজের পারিবারিক আসনটি পর্যন্ত তিনি ধরে রাখতে পারেননি।

মোদির ম্যাজিকের রহস্য কী? ভারতীয় ভাষ্যকাররাই বলছেন, একদিকে হিন্দুত্বের জিগির, অন্যদিকে ‘পাকিস্তান তাস’, এই দুই চালেই বাজিমাত করেছেন তিনি। ভারতের অর্থনীতি মোটের ওপর সুস্থির, কৃষকদের মধ্যে নানা অসন্তোষ থাকলেও নতুন যে ‘উচ্চাকাঙ্ক্ষী’ বা ‘এস্পায়ারিং’ শ্রেণি গড়ে উঠেছে, তারা মোদির কোনো বিকল্প খুঁজে পায়নি। সেটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। এই তিনে মিলে যে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সূচনা করেছেন মোদি, অনায়াসে তার স্লোগান হতে পারে, সবার আগে ভারত ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’। ভারতীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সুহাস পালশিকার বলেছেন, মোদির ভারতে একজন ভারতপন্থী জাতীয়তাবাদী ও ভারতপন্থী হিন্দুর মধ্যে কোনো তফাত নেই।

মোদির জাতীয়তাবাদের কেন্দ্রে রয়েছে ভীতি। হাজার বছরের হিন্দুত্ববাদী ভারত, মুসলমানরা তাঁকে বদলে দিতে চাইছে। তাদের ঠেকাতে হবে। এই অভ্যন্তরীণ ভীতির সঙ্গে যুক্ত করুন পাকিস্তান থেকে আসা ভীতি। গত ফেব্রুয়ারিতে প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে যে ক্ষণস্থায়ী বিমান যুদ্ধ হয়, তার কতটা পাকিস্তানি হামলার জবাব, কতটা কৃত্রিম, সে তর্ক ভারতীয়রাই এখনো শেষ করে ওঠেনি। তবে সে ঘটনা যে মোদির পক্ষে গেছে, তা বলাই বাহুল্য। ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশই বহির্গত আক্রমণের এই হুমকি যার যার রাজনৈতিক প্রয়োজনে বরাবরই ব্যবহার করেছে। মোদিও করলেন। কিছুটা কল্পনা, কিছুটা প্রচারমাধ্যম ব্যবহার করে তিনি মানুষের মনে এই ভাবনা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন, পাকিস্তানকে ঠেকাতে হলে তিনি ছাড়া বিকল্প নেই। কাশ্মীর সীমান্তের কাছে বালাকোটে ভারতীয় বিমান হামলার সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে রাহুল গান্ধী সে দাবিতে কিছুটা হলে ঘি ঢেলে দেন।

তবে মোদির সাফল্যের বড় কারণ হিন্দুত্ববাদের প্রত্যাবর্তন। নেহরু ও পরবর্তীকালে তাঁর কন্যা ইন্দিরা যে ভারত গঠনের চেষ্টা করেন, তা ছিল বহু-ধর্মীয় ও অসাম্প্রদায়িক। পঞ্চাশ বছর চেষ্টা করেও সে ভারত গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। বরং উল্টো, হিন্দু ভারতকে বহু-ধর্মীয় করার চেষ্টায় ভারতীয় কংগ্রেস দল ক্রমেই একটি শহুরে ‘এলিট’-নির্ভর দল হয়ে ওঠে। অন্যদিকে মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) কোনো রাখঢাক ছাড়াই নিজেদের হিন্দুত্ববাদী হিসেবে উপস্থিত করে, যার লক্ষ্য হাজার বছরের পুরোনো হিন্দু গৌরবকে পুনরুদ্ধার। গোহত্যা বন্ধ অথবা ধর্মান্তরের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে নাগরিকদের হাত করতে মোদি ও তাঁর সমর্থকদের তেমন একটা বেগ পেতে হয়নি। এই সব ভারতীয় সেক্যুলারিজম কী তা বোঝে না, কিন্তু গরু নিধন বন্ধের দাবি ঠিকই বোঝে। হিন্দুত্ববাদী নাথুরাম গডসে ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীকে গুলি করে হত্যা করেছিল। মোদির দলের প্রাজ্ঞ ঠাকুর সেই গডসেকে সাচ্চা দেশপ্রেমিক বলে সালাম ঠোকার পর অনেকে ভেবেছিল এমন কথা বলায় তাঁর নির্বাচনে জেতা অসম্ভব। ভুল, তিনি শুধু জিতেছেন তাই নয়, ভুপালে একজন সাবেক কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রীকে প্রায় ৩০ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে গোহারা হারিয়েছেন।

মোদির এই হিন্দু ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদী জাতীয়তাবাদের বিস্তর মিল। ট্রাম্পের রাজনীতির কেন্দ্রেও রয়েছে ভীতি—মেক্সিকানদের থেকে ভীতি, মুসলমানদের থেকে ভীতি, সব ধরনের বহিরাগত থেকে ভীতি। এই ভীতি থেকে উদ্ভূত হুমকি-ধারণা ট্রাম্প এতটা বাড়িয়ে তুলেছেন যে তাঁকে ব্যবহার করে রীতিমতো জাতীয় জরুরি অবস্থা জারি করে বসেছেন। মোদি গো-নিধন বন্ধ করেছেন, ট্রাম্প বহিরাগত ঠেকাতে দেশের দক্ষিণে সীমান্ত দেয়াল তুলছেন। প্রতীক হিসেবে উভয় কৌশলই কাজে লেগেছে।

ট্রাম্প ও তাঁর সমর্থকদের জন্য বহিরাগতরা যদি হয় বহির্গত হুমকি, তো ডেমোক্রেটিক পার্টি ও তার রাজনীতি হলো অভ্যন্তরীণ হুমকি। গত ৬০ বছর যুক্তরাষ্ট্রে একধরনের উদারনৈতিক সাংস্কৃতিক রাজনীতি গড়ে উঠেছে, যার কেন্দ্রে রয়েছে লিঙ্গ ও বর্ণভিত্তিক সমানাধিকার। এই সংস্কৃতির প্রভাবে ধর্মের ভূমিকা দুর্বল হয়েছে, যাকে খ্রিষ্টীয় মূল্যবোধ ভাবা হয়, তা ক্রমেই নাগরিক জীবন থেকে অন্তর্হিত হয়েছে। ব্যাপারটা অনেকটা ভারতে প্রথাগত ধর্মচর্চার স্থলে অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির ক্রমবিস্তারের সঙ্গে তুলনীয়। ভারতে যেমন দেশের এক বড় অংশ এই উদারনৈতিক সংস্কৃতির সংক্রমণে বিচ্ছিন্ন বোধ করেছে, আমেরিকায়ও গ্রামীণ ও বয়স্ক মানুষ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের এই ক্রমবিস্তারে অসহায় ও একাকী বোধ করেছে। এদের অধিকাংশ শ্বেতকায়, কালো অথবা বাদামি লোকের প্রতি তাদের মনোভাব সর্বদাই অবজ্ঞা মিশ্রিত ঘৃণা। এই দেশটা তাদের, তাদের অভ্যস্ত খ্রিষ্টীয় জীবনধারাই এই দেশে বহাল থাকবে, এমন একটি কল্পিত ঈশ্বরদত্ত অধিকারে তাদের বিশ্বাস। বহিরাগতদের উপস্থিতি সেই অধিকার হরণ করতে উদ্যত। ট্রাম্প এই ভীতিকে ব্যবহার করে নিজেকে শ্বেত আধিপত্য ও খ্রিষ্টীয় মূল্যবোধের প্রধান সমর্থক হিসেবে হাজির করেছেন। তাঁকে সঙ্গ দিয়েছে এ দেশের সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল ইভানজেলিক্যাল গোষ্ঠী।

মোদি বলেন, হিন্দু ভারত, ট্রাম্প বলেন, ‘সবার আগে আমেরিকা’। এই দুইয়ের মধ্যে কার্যত কোনো তফাত নেই। তাঁদের দুজনের রাজনৈতিক ব্যবহারেও আশ্চর্য মিল। নিউজ উইক পত্রিকা তাঁদের মধ্যে অন্তত পাঁচ জায়গায় মিল খুঁজে পেয়েছে: তাঁদের উভয়ের রাজনীতির কেন্দ্রে রয়েছে ব্যক্তি মোদি ও ব্যক্তি ট্রাম্প; তাঁরা দুজনই বহিরাগতদের তাড়াতে চান; উভয়েরই মন্ত্র জাতীয়তাবাদ; দুজনই নির্দ্বিধায় মিথ্যা বলেন এবং দুজনেরই গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রতি আস্থা খুব সামান্য।

আপাতভাবে মোদি ও ট্রাম্প উভয়েই উদারনৈতিক লেখক-বুদ্ধিজীবীদের উপহাসের পাত্র। সেসব লেখক-বুদ্ধিজীবীদের সবাইকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রেকর্ড পরিমাণ আসন জিতে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় ফিরে এসেছেন মোদি। অন্যদিকে দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচনে লড়ার জন্য তৈরি হচ্ছেন ট্রাম্প। মোদির অনায়াস বিজয় দেখে তিনি উল্লসিত হবেন, সেটাই স্বাভাবিক। ২০১৭ সালে মোদি যখন হোয়াইট হাউসে সরকারি সফরে আসেন, ট্রাম্প তাঁকে ‘আমার প্রকৃত বন্ধু’ বলে করমর্দন করেছিলেন। অনুমান করি, সেই প্রকৃত বন্ধুর দেখানো পথ ধরেই নিজের নির্বাচনী বৈতরণি পেরোনোর চেষ্টা করবেন ট্রাম্প।

হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।