বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা যে কারণে

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধফেরত সেনাকে জড়িয়ে ধরেছেন তাঁর স্ত্রী। লন্ডন, ১৯৪০। ছবি: সংগৃহীত
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধফেরত সেনাকে জড়িয়ে ধরেছেন তাঁর স্ত্রী। লন্ডন, ১৯৪০। ছবি: সংগৃহীত

সাল ১৯৪৫। দীর্ঘ যুদ্ধের পর নাৎসি জার্মানি বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করেছে। তারিখ ৮ মে। উৎসবের ঢেউ লাগল যুক্তরাষ্ট্রসহ মিত্রজোটের দেশগুলোয়। যুদ্ধফেরত সেনাদের বরণ করে নিতে পথে নেমে আসে হাজারো মানুষ। বিনোদন জগতের তারকারাও নেমে আসেন পথে। এর মধ্যে অভিনেত্রী মার্লিন দিতরিচের সৈনিককে চুমু খাওয়ার ছবিটি তো রীতিমতো আলোড়ন তোলে। এই যুদ্ধফেরত সেনা বরণের এমন বহু স্থিরচিত্র বিখ্যাত হয়ে আছে ইতিহাসের পাতায়। এক উত্তুঙ্গ আবেগের জন্ম দেয় এসব দৃশ্য। ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে শুরু করে পরবর্তী নানা যুদ্ধে এই আবেগের ব্যবহার হয়েছে।

সাধারণত যুদ্ধের আগে পরে এবং যুদ্ধকালে সমর বিভাগ নিয়ে রাষ্ট্র এমন আবেগপূর্ণ দৃশ্য তৈরি করে। কিছুদিন আগে ভারতের পুলওয়ামায় হামলার পর পাকিস্তানে আটক ভারতীয় বিমানবাহিনীর পাইলট অভিনন্দন বর্তমানকে নিয়েও এমন আবেগপূর্ণ দৃশ্যের জন্ম দেওয়া হয়েছিল। অভিনন্দনের স্বদেশে ফিরে আসার দৃশ্য সরাসরি সম্প্রচার করে এতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল ভারতীয় সংবাদমাধ্যম। এই দৃশ্য জরুরি ছিল ভারতের গদিনশিন এবং আবারও গদি পাওয়া বিজেপি সরকারের জন্য। কারণ, বাস্তব ওই যুদ্ধ পরিস্থিতির সামনেই ছিল আরেক যুদ্ধের অঙ্ক। তাই এ দৃশ্যের ব্যাপক সম্প্রচার প্রয়োজনীয়তার কথাটি ঊহ্য রাখলেও চলে।

মানচিত্রের কাটা দাগে বিভাজিত বিশ্বকাঠামোয় সমর শক্তির প্রকাশ ও প্রচার নতুন কিছু নয়। প্রতিরক্ষার কথা বলে মূলত রাষ্ট্রের শক্তি প্রদর্শনই এর একমাত্র উদ্দেশ্য। উত্তর কোরিয়া, চীন, রাশিয়াসহ বিশ্বের সব দেশই এটি করে। আর যুক্তরাষ্ট্র এটি না করে পারেই না। প্রতিবছরই সব দেশ নিয়ম করে সামরিক মহড়ার আয়োজন করে। বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে আয়োজন করা হয় যৌথ মহড়ারও। এসবই ডালভাত। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে যখন জন-আবেগের সামরিকীকরণের মতো বিষয় সামনে আসে। নির্বাচন–পূর্ব ভারতে বিমানসেনা অভিনন্দনকে ঘিরে যে প্রচারটি হলো, তা এ ধাঁচেরই। জন-আবেগকে প্রভাবিত করাটাই ছিল এর উদ্দেশ্য। ঠিক একই রকম প্রচার হরহামেশাই দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রে।

চলতি মাসের শুরুতে এবিসি নিউজে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এমন একটি গল্পই তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে নয় বছর বয়সী সন্তানকে চমকে দিতে তার জন্মদিনে হঠাৎ করেই হাজির হন সেনা কর্মকর্তা বাবা। যেকোনো বাবাই চান সন্তানের জন্মদিনে তার পাশে থাকতে। আর চমকে দেওয়ার সুযোগ থাকলে তো কথাই নেই। সে ক্ষেত্রে এটি সাদামাটা একটি গল্পই। কিন্তু এই গল্পটিকেই নানা মসলা দিয়ে ভীষণ আবেগী করে উপস্থাপন করা হয় ওই প্রতিবেদনে। শুধু এবিসি নিউজ কেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল নিয়মিতভাবেই এটি করছে। ভূরি ভূরি উদাহরণ দেওয়া যাবে, যেগুলো সাধারণ মানুষের আবেগকে দারুণভাবে নাড়া দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। কথা হচ্ছে কেন? মানুষকে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্দীপ্ত করে টগবগ করে ফোটাতেই কি?

এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে হলে তাকাতে হয় চলমান বিভিন্ন ঘটনার দিকে। যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয়তাবাদী আবেগকে উসকে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ছে কেন? সত্যিকারের যুদ্ধাবস্থা ছাড়া কখন একটি রাষ্ট্র তার জনগণের দৃষ্টি সমর শক্তির দিকে ঘোরানোর চেষ্টা করে? যুক্তরাষ্ট্রের দিকেই তাকানো যাক। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে যুক্তরাষ্ট্র এখনো সেই কথিত ‘গ্রেট’ হয়ে ওঠেনি। বরং নানা ফ্রন্টে যুদ্ধ শুরু করে কিছুটা বিহ্বল হয়ে আছে। ঘরের দিকে তাকালে উচ্চ কর্মসংস্থানের যে তথ্য সরকার ছাড়ছে, তার ফাঁকটা বেরিয়ে পড়ছে। কূটনৈতিক অর্জন শূন্যের কোঠায়। বিশ্বমোড়ল হিসেবে নিজের অবস্থান নানাভাবে নড়বড়ে করে ফেলেছে ট্রাম্প প্রশাসন।

আর গত নির্বাচনে রাশিয়ার সঙ্গে আঁতাত প্রশ্নটি এখনো এড়িয়ে যেতে পারেনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচার শিবির। সঙ্গে রয়েছে হোয়াইট হাউসের মিউজিক্যাল চেয়ার। ফলে জনতার নজর বাইরে নেওয়াটা জরুরি। ফলে মঞ্চে ইরান ও চীনের হাজির হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না, যা দেখিয়ে জাতীয়তাবাদী ঢেউটি তোলা যায়। আর তাকে পূর্ণাঙ্গ করতেই দরকার পড়ে আবেগের সামরিকীকরণের।

যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি দেশের জন্য আবেগের এই সামরিকীকরণের আরেকটি প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আর তা হলো বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত অনিঃশেষ যুদ্ধের সম্মতি উৎপাদন। জনতার আবেগকে এ পথে পরিচালিত করলে চলমান এসব যুদ্ধ এবং সেগুলোয় মার্কিন সেনা-ক্ষয় নিয়ে প্রশ্ন ওঠার সুযোগ থাকে না। ২০০৩ সালে শুরু হওয়া ইরাক যুদ্ধের কথাই ধরা যাক। ইউনিসেফের তথ্যমতে, ওই বছরের মার্চেই ইরাকের সাত শতাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয় গুঁড়িয়ে দেয় মার্কিন বাহিনী। মার্কিন কার্যক্রমের কারণে ইরাকের শিশুরা এখনো ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই সবই মার্কিন তরুণ প্রজন্ম ও অভিভাবকদের কাছ থেকে আড়াল করা যায় একটি সফল ‘যুদ্ধফেরত সেনার পারিবারিক মিলনের’ দৃশ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে। এই আড়াল করার প্রয়োজনীয়তাটা যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি প্রশাসনেরই অবশ্যপালনীয় তালিকায় থাকে। কারণ, দেশটির যুদ্ধ কখনো থামে না। বিশ্বের ৭০টির বেশি দেশে রয়েছে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি; তাই কোথাও না কোথাও সে যুদ্ধ করেই। তাই মার্কিন যেকোনো প্রশাসনের জন্যই এবং তাদের প্রকট কিংবা প্রচ্ছন্ন প্রভাবে থাকা সংবাদমাধ্যমের জন্য আবেগের এ সামরিকীকরণের উপাদান সরবরাহ করাটা একরকম বাধ্যবাধকতা হয়ে দাঁড়ায়।

অভিনেত্রী মার্লিন দিতরিচের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধফেরত সৈনিককে চুমু খাওয়ার এ ছবি বিখ্যাত হয়ে আছে এর আবেদনের কারণে। ছবি: সংগৃহীত
অভিনেত্রী মার্লিন দিতরিচের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধফেরত সৈনিককে চুমু খাওয়ার এ ছবি বিখ্যাত হয়ে আছে এর আবেদনের কারণে। ছবি: সংগৃহীত

এ তো গেল যুক্তরাষ্ট্রের কথা। তাহলে বাকি দেশগুলো কেন করে। এমনকি আপাত অর্থে যুদ্ধের সুদূর কোনো আশঙ্কাও নেই এমন দেশেও কখনো কখনো দেখা যায় এই একই ধরনের প্রচার। এর কারণটি খুঁজতে হলে তাকাতে হবে ওই বিশেষ দেশের অভ্যন্তরেই। মোটাদাগে একটি দেশের অর্থনীতি যদি নড়বড়ে হয়, আইনের শাসন নিয়ে যদি জন-অস্বস্তি থাকে, নিরাপত্তা যখন বিরাট প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়, বাজার যখন লাগামহীন হয়, থাকে দুর্নীতি ও অপশাসন—এককথায় কোনো কিছুই যখন ঠিকমতো চলে না, তখনই এ ধরনের প্রচার রাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

মূলত সাধারণ মানুষকে নিজের শৌর্য দেখিয়ে, সেনা সদস্যদের নিবেদন দেখিয়ে প্রবোধ দেওয়ার লক্ষ্যেই এটি করা হয়। এটি অনেকটা মলম হিসেবে কাজ করে। এটি মানুষকে একটা সিনেমা হলে নিয়ে যায়, যেখানে শেষ দৃশ্যে মধুর মিলন কিংবা করুণ পরিণতি ক্ষণিকের জন্য মানুষের হৃদয়কে গ্রাস করে। মানুষ আর কিছু ভাবতে পারে না। এই ভাবনা শূন্যতাই মূলত কাম্য রাষ্ট্রের। তাই সে নানাভাবে নানা অজুহাতে এসব দৃশ্যের উৎপাদন করে চলে, যা নিজের ক্ষমতাবলে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার করা হয়। মূলত বাস্তবতা থেকে জনতার চোখ ফেরাতেই এমন দৃশ্যের প্রচার করা হয়।

আবেগের সামরিকীকরণের লক্ষ্যে করা যেকোনো প্রচার তাই সংশ্লিষ্ট দেশের জনগণকে অলক্ষ্যে একটি বার্তা দেয়। আর তা হলো, ‘ভালো করে তাকাও নিজ দেশের দিকে। তাকাও অন্য দেশে তোমার দেশের কর্মকাণ্ডের দিকে।’ মজার বিষয় হলো, রাষ্ট্র নিজেই এই বার্তা দিয়ে দেয় নিজের অজান্তে, যা ঠিকঠাক পড়ে নেওয়াটাই মানুষের কাজ, যা পারলে অনেক কিছুই আর রাষ্ট্রের পক্ষে লুকোনো সম্ভব হয় না।

ফজলুল কবির: সাংবাদিক
ই-মেইল: [email protected]