পাটিকরদের দৈন্যদশা

‘চন্দনেরি গন্ধভরা, শীতল করা, ক্লান্তি–হরা, যেখানে তার অঙ্গ রাখি, সেখানটিতেই শীতল পাটি’। ছন্দের জাদুকর কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ‘খাঁটি সোনা’ কবিতায় বাংলার মাটিকে এভাবে শীতলপাটির সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের শীতলপাটিকে বিশ্বের নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে। কিন্তু যাঁরা এই শীতলপাটি তৈরির সঙ্গে যুক্ত, বাংলার সেই পাটিকরদের দুর্দশার খবরটি আমাদের ব্যথিত করেছে।

শুক্রবার প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, দক্ষিণাঞ্চলের পাটিকরদের আগের মতো সচ্ছলতা নেই। আগের মতো বিক্রিবাটা নেই বলে তাঁদের বেশির ভাগই আর্থিক অনটনে রয়েছেন। তারপরও তাঁরা প্রাণপণ চেষ্টা করছেন পূর্বপুরুষের এই ঐতিহ্যবাহী পেশায় টিকে থাকতে। পাটিকরদের জীবন ও জীবিকা নিয়ে কাজ করেন, এমন ব্যক্তিদের মতে, আধুনিক প্রশিক্ষণ না পাওয়ায় পাটিকররা তাঁদের শীতলপাটিকে বহুমুখী ব্যবহার উপযোগী করতে পারেননি। আর এটাই তাঁদের দৈন্যদশার অন্যতম কারণ।

শীতলপাটি বাংলাদেশের ঐতিহ্যগুলোর মধ্যে একটি। একটা সময় গরমের দিনে মানুষকে অনাবিল শ্রান্তি এনে দিতে শীতলপাটির কোনো জুড়ি ছিল না। মোর্তা বা পাটিবেত বা মোস্তাক নামক গুল্ম–জাতীয় উদ্ভিদের ছাল দিয়ে তৈরি করা হয় এই পাটি। কোথাও কোথাও এই পাটিকে নকশিপাটি হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। এই নিপুণ হস্তশিল্প শহর-গ্রামে মাদুর ও চাদরের পরিবর্তে ব্যাপকভাবে সমাদৃত ছিল। শীতলপাটি একসময় হাজার হাজার মানুষের জীবন-জীবিকার অবলম্বন হয়ে ওঠে। অথচ এখন প্রযুক্তির প্রসারের কারণে শীতলপাটি তৈরির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরাই আর্থিক দৈন্যদশায় ভুগছেন। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

ইউনেসকো যে বস্তুটিকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিয়েছে, সেই ঐতিহ্যকে রক্ষায় সরকারকে অবশ্যই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। এ জন্য অবশ্যই, বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের পাটিকরদের দিকে নজর দিতে হবে। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, বরিশালের বাকেরগঞ্জ, ঝালকাঠির রাজাপুর, পিরোজপুরের কাউখালী—এই তিন উপজেলার ১০ গ্রামে অন্তত ৩৪০টি পরিবার পূর্বপুরুষের এই পেশা আঁকড়ে আছে। বর্তমানে রান নামের একটি বেসরকারি সংস্থা শীতলপাটির বহুমুখী ব্যবহারের একটি প্রশিক্ষণ এই অঞ্চলের পাটিকরদের দিচ্ছে। সরকারও এ রকম উদ্যোগ নিতে পারে। এর পাশাপাশি সরকারের উচিত এই শিল্পসংশ্লিষ্টদের প্রণোদনা দেওয়া। পাটি বিক্রির মৌসুমে পাটিকরদের জন্য বিনা সুদে ঋণের কোনো ব্যবস্থা নেই বা তাঁদের পুনর্বাসনও করা হয় না। সরকারকে এ বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে।

সিলেট অঞ্চলের শীতলপাটি বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চলের শীতলপাটিও যাতে বিদেশে রপ্তানি করা যায়, সরকারকে সেই উপায় খুঁজে
বের করতে হবে। তাহলেই গতি পাবে এই শিল্প এবং দৈন্যদশা কাটবে দক্ষিণাঞ্চলের পাটিকরদের।