আর্থিক খাতের সমস্যা অন্য খাতেও ছড়িয়ে পড়ে: সালেহউদ্দিন আহমেদ

সালেহউদ্দিন আহমেদ
সালেহউদ্দিন আহমেদ
সালেহউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর। ২০০৫ সালের মে থেকে ২০০৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। শিক্ষকতা করছেন, ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা, আন্তর্জাতিক সংস্থায়ও কাজ করেছেন। এখন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্কুলে অধ্যাপনা করছেন। ব্যাংক খাতের সুশাসন পরিস্থিতি, খেলাপি ঋণ, সুদহার, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন এই অর্থনীতিবিদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শওকত হোসেনসানাউল্লাহ সাকিব

প্রথম আলো: আপনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন। এখনকার বাংলাদেশ ব্যাংক দেখে আপনার কী মনে হয়?

সালেহউদ্দিন আহমেদ: নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে যেকোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটা স্বকীয়তা আছে, স্বাধীনতা আছে। তাদের কতগুলো বিশেষ দায়িত্ব পালন করতে হয়। মুদ্রানীতি বাস্তবায়ন করাই হচ্ছে সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান দায়িত্ব। এ কাজে সাধারণত অন্য কেউ হস্তক্ষেপ করে না। বাংলাদেশ ব্যাংকেরও দায়িত্বও তাই এবং এ জন্য আইনিভাবে বাংলাদেশ ব্যাংককে পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা দেওয়া আছে। এটা ঠিক যে সব দেশের রাজনীতিবিদেরা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পরামর্শ দেন, চাপও দিতে পারেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ হলো, এর মধ্যে থেকেই যথাযথ কাজ করে যাওয়া। আমরা যঁারা বিভিন্ন সময়ে দায়িত্বে ছিলাম, আমরাও সেভাবে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছি। আমাদের সময়েও বিভিন্ন চাপ ছিল। তবে কৌশল করে
চলতে হয়েছে।

এমনিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের দক্ষতা নিয়ে আমার কোনো প্রশ্ন নেই। তবে এখন দেখছি, আর্থিক শৃঙ্খলার যে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বিধিবিধান আছে, তা পরিপালন হচ্ছে না। যে নিয়মকানুন করা হচ্ছে, তা ভেবেচিন্তে করা হচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজস্ব বিবেচনায় এসব প্রজ্ঞাপন জারি করছে বলে মনে হচ্ছে না। বাংলাদেশের যেকোনো খাতের চেয়ে আর্থিক খাতে কিছুটা শৃঙ্খলা বজায় ছিল। সবাই টের পেত বাংলাদেশ ব্যাংক বলে একটা প্রতিষ্ঠান আছে, ব্যাংকিং খাতে তাদের কিছু ভূমিকা আছে। কিন্তু দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য যে নিয়মকানুন ও আইন আছে, তা পরিপালনে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছে না।

প্রথম আলো: বাংলাদেশ ব্যাংক ভূমিকা কেন রাখতে পারছে না বলে মনে করেন।

সালেহউদ্দিন আহমেদ: বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হয়তো পারছে। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে যে ভূমিকা রাখতে পারছে না, সেটা বাইরে থেকে আমরা দেখতে পারছি। ইদানীং এমন কিছু প্রজ্ঞাপন কেন্দ্রীয় ব্যাংক জারি করছে, যেটা ভেবেচিন্তে দেওয়া বলে মনে হয় না। এর প্রভাব কী হতে পারে, তা–ও বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না। মনে হচ্ছে কিছু রাজনৈতিক, আমলাতান্ত্রিক ও গোষ্ঠীস্বার্থের প্রভাবে এসব প্রজ্ঞাপন হচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে প্রভাবিত করা হচ্ছে। এটা ঠিক যে সরকারকে একেবারে বাদ দিয়ে কিছু করা সম্ভব নয়। কিন্তু এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাইরে থেকেও বিভিন্ন প্রজ্ঞাপন জারির উদ্যোগ আসছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংক সেটার আইনি স্বীকৃতি দিচ্ছে। সুদহার নির্ধারণ, বাজেট ঘাটতি ও মুদ্রানীতি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সরকারের আলোচনা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিচার-বিবেচনা করে বলা উচিত কোন কোন ক্ষেত্রে কেমন সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন।

হ্যাঁ, আমাদের ব্যাংকিং খাতে অনেক সমস্যা আছে। সেটা খেলাপি ঋণ, শাসনব্যবস্থা ও আইন নিয়ে। বাংলাদেশ ব্যাংক নিজের দক্ষতা দিয়ে এসব সিদ্ধান্ত নেবে, প্রয়োজনে নিজেদের পরিচালনা পর্ষদে আলোচনা করবে। এরপর বিভিন্ন সিদ্ধান্তের প্রভাব পর্যালোচনা করে সরকারকে নিজেদের মতামত জানাতে পারে। এরপর সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা ও সুশাসন ধরে রাখা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাজ। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ হচ্ছে এসব ক্ষেত্রে কোনো বিচ্যুতি হলে তা শক্তভাবে ধরা। কিছু ঘটলে অতি দ্রুত দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া। অথচ দেখা যাচ্ছে, অনেক ঘটনা ধরা পড়েও পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তারপর বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ‘আমরা দেখছি।’ কিন্তু কী দেখছে? ব্যাংক তো অন্য প্রতিষ্ঠানের মতো না। ব্যাংক তো গাড়ি, বাড়ি তৈরির প্রতিষ্ঠান না। ব্যাংকগুলো চলে জনগণের টাকায়। তাই হঠাৎ করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অনেক পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। ব্যাংকের ওপর জনগণের আস্থায় নড়চড় হলে বড় ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হবে।

প্রথম আলো: বাংলাদেশ ব্যাংক নজরদারিও করতে পারছে না, মুদ্রানীতিও ঠিক রাখতে পারছে না। তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে বাকি থাকল কী?

সালেহউদ্দিন আহমেদ: আমার সময়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ছিল না। পরে আবার এসেছে। এতে ব্যাংক খাতে দ্বৈত শাসন তৈরি হয়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এখন সরকারি ব্যাংক পরিচালনা করছে, পরিচালক নিয়োগ দিচ্ছে, ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা এমডিও বানাচ্ছে। এখন সময় এসেছে সব ব্যাংককে একই ছাতার নিচে আনার, একই নিয়মে পরিচালনা করার। আগেই বলেছি, ব্যাংক চলে সাধারণ জনগণের টাকায়। মানুষ বিশ্বাস করে ব্যাংকে টাকা রাখে। সেই টাকায় ব্যাংকগুলো ব্যবসা করে। তাই সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের জন্য দুই ধরনের নিয়ম চালু থাকতে পারে না।

সরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগ দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক একটা প্যানেল করে দিতে পারে। আবার পর্ষদের জন্য পরিচালক বাছাই করে দিতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকের পরিচালক সবাইকে অর্থনীতিবিদ হতে হবে, এমন তো নয়। উন্নয়ন, সামাজিক অর্থনীতি, দেশের নীতি সম্পর্কে ধারণা আছে, এমন কেউ হলেই তো পরিচালক বানানো যায়। তবে এমডি যাকেই বানানো হোক, তাঁকে ভালো ব্যাংকার হতেই হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের অন সাইট ও অফ সাইট সুপারভিশন বা পরিদর্শন ব্যবস্থা আছে। অফ সাইট সুপারভিশন ব্যাংকগুলোর প্রতিবেদন যাচাই–বাছাই করে, অনসাইটে গিয়ে সরেজমিন খোঁজখবর নেয়। এরপর মিলিয়ে দেখা হয় ব্যাংকগুলোর কী অবস্থা। এসব পর্যালোচনা করে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। আমার প্রত্যাশা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শকেরা যেসব অনিয়ম ধরছেন, তা যেন ধামাচাপা দেওয়া না হয়। তাতে যেন ঊর্ধ্বতনরা হস্তক্ষেপ না করেন। এখন শোনা যায়, ওপর পর্যায়ে পরিদর্শন প্রতিবেদন দেখার পর সিদ্ধান্ত হয়। এতে অনেক সময় লাগে এবং কখনো আটকেও যায়। এটা ঠিক নয়। নিচের দিকেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দিতে হবে। বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। আমার সময়েও গভর্নরের কাছে সব ফাইল আসত না। অনেক সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট বিভাগই গ্রহণ করত।

বেসিক ব্যাংকের কথাই বলতে পারি। কত ভালো ছিল। আর ব্যাংকটি নিশ্চয়ই এক দিনেই খারাপ হয়নি। এক দিনেই হাজার হাজার কোটি টাকা বের হয়ে যায়নি। সময়মতো পদক্ষেপ নিলে অনেক টাকা বাঁচানো যেত। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নিজ উদ্যোগে ভূমিকা নেওয়া উচিত ছিল। এমন সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কী পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা–ও খোলামেলা হওয়া উচিত।

প্রথম আলো: তাহলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রয়োজন কতটা?

সালেহউদ্দিন আহমেদ: আলাদাভাবে ব্যাংকিং বিভাগ বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থাকা আর উচিত নয়। আর্থিক খাত দেখভালের জন্য একটা উইং বা শাখা থাকতে পারে, যেভাবে বাজেট শাখা আছে। তবে সেখানেও দক্ষ লোকবল দিতে হবে। ব্যাংকিং খাত দেখভাল তো আমলাতান্ত্রিকতা নয়। এটা খুবই টেকনিক্যাল কাজ। ব্যাংক খাতকে আমলাতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে।

প্রথম আলো: আপনি যখন গভর্নর ছিলেন, তখন ওপর মহল থেকে কী ধরনের চাপ পেতেন?

সালেহউদ্দিন আহমেদ: আমার সময়ে তো মুদ্রানীতি দেওয়ার আগেও সরকারের সঙ্গে কোনো পরামর্শ করা হয়নি। সে সময় সরকার থেকে এ নিয়ে বলা হলেও আমরা জানিয়ে দিয়েছিলাম যে প্রয়োজনে পরিবর্তন করা যাবে। এটা তো সংসদ থেকে আসেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব ক্ষমতায় মুদ্রানীতি হয়েছে। আবার আমার সময়ে নতুন ব্যাংক দেওয়ার ব্যাপারে যে চাপ ছিল না, এমন তো নয়। সব সময়ই এ নিয়ে চাপ থাকে। আমরা যাচাই করেছি, এর প্রভাব কী হবে সরকারকে তা জানিয়েছি। এ নিয়ে আলোচনা করে পর্ষদ শক্ত অবস্থান নিয়েছে। সরকারও তা মেনে নিয়েছে, কোনো নতুন ব্যাংক হয়নি। আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেওয়ার জন্যও ভালো চাপ ছিল, কিন্তু তা–ও দেওয়া হয়নি।

আমার কথা হচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংককেই মর্যাদা রাখতে ভূমিকা নিতে হবে। না হলে তো কিছুই থাকবে না। স্বায়ত্তশাসন কেউ এমনি এমনি দেবে না, এটা কার্যকলাপ দিয়ে অর্জন করতে হয়।

প্রথম আলো: আপনারা নতুন ব্যাংক দিলেন না। কিন্তু এরপর তো গত এক দশকে ১২টি ব্যাংক অনুমোদন পেল। বাংলাদেশের অর্থনীতির বিবেচনায় এত নতুন ব্যাংকের প্রয়োজন আছে?

সালেহউদ্দিন আহমেদ: নতুন ব্যাংক প্রয়োজন আছে কি না, তা নির্ভর করবে দেশের অর্থনীতির আকার ও ধরনের ওপর। বাংলাদেশের অর্থনীতির পরিধি বিবেচনায় আর ব্যাংকের প্রয়োজন নেই। বিশেষ বিবেচনায় বিশেষ ধরনের সেবা দিতে নতুন ব্যাংক হতে পারে। যেমন কোনো ব্যাংক যদি প্রত্যন্ত এলাকায় যেতে চায়, সেটা হতে পারে। এখন যে মোবাইল ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং করা হচ্ছে, তা না করে ব্যাংকগুলোই এ ধরনের বিশেষ সেবা নিয়ে কাজ করতে পারত। নতুন যে ৯টি ব্যাংক চালু হলো, তারা কেউ নতুন কিছু করতে পারেনি। এনআরবি ব্যাংকগুলো কত টাকার প্রবাসী আয় এনেছে? আমরা দেখছি, সব ব্যাংক একই ধরনের সেবা দিচ্ছে।

আবার দেশে যখন ঘোষণা দেওয়া হয় যে রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক হচ্ছে, এ ধরনের ঘোষণার কারণে এসব ব্যাংক তো বৈদেশিক ব্যবসা পরিচালনায় বড় সমস্যায় পড়েছে। তৃতীয় একটি ব্যাংকের কাছ থেকে গ্যারান্টি নিতে হচ্ছে। এতে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এটা না হলে খরচ অনেক কমে যেত, সুদহারও কমত। এ ছাড়া আছে দক্ষ মানবসম্পদের অভাব। একই ব্যক্তি বিভিন্ন ব্যাংকে দৌড়ঝাঁপ করছেন। ব্যাংক পরিচালকদের সঙ্গে তাঁদের সখ্য গড়ে উঠেছে। এর ফলে পরিচালকদের কথায় তাঁরা পুরোপুরি চলছেন। যদিও আশার দিক হচ্ছে, এখন তরুণেরা ভালো করছেন, তাঁদের তুলে আনতে হবে।

প্রথম আলো: সম্প্রতি বেশ কিছু পদক্ষেপ আমরা দেখতে পাচ্ছি। যেমন আমানতে ৬ শতাংশ ও ঋণে ৯ শতাংশ সুদহার নির্ধারণ। অথচ সেটা বাস্তবায়নও হলো না। কখনো শুনেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংককে পাশ কাটিয়ে বাইরে থেকে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা?

সালেহউদ্দিন আহমেদ: না, আগে কখনো এমনটা দেখিনি। বাজারভিত্তিক অর্থনীতিতে সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক কেউ সুদহার ঠিক করে দিতে পারে না। অথচ এ সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হলো। আমি ভেবেছিলাম, এটা নিয়ে অনেক কথা হবে, সমালোচনা হবে। কিন্তু এ নিয়ে সেভাবে কেউ কথা বলেননি। ব্যাংকের মালিকেরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে সুদহার ঠিক করেছেন। এভাবে সুদহার নির্ধারণ আগে কখনো হয়নি। এ ধরনের ভুল সিদ্ধান্ত যে কখনো বাস্তবায়িত হবে না, তা আগে বোঝা উচিত ছিল। আমি বলি, আমানত ও ঋণের সুদহারের ব্যবধান কমিয়ে আনুন। তাহলেই সুদহার অনেকটা কমে যাবে। তহবিল খরচ আছে, পরিচালন খরচ আছে। এসব কমিয়ে আনতে হবে। এত সাজসজ্জার ব্যাংক প্রয়োজন নেই। এত খরচ করে শাখার প্রয়োজন আছে কী? খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে হবে। আর ব্যাংকের কাজ কি শুধু মুনাফা করা—এ নিয়েও ভাবতে হবে।

প্রথম আলো: অনেক দিন ধরেই খেলাপি ঋণ নিয়ে কথা হচ্ছে। এখন আবার সংজ্ঞা পরিবর্তন করে কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আবার খেলাপিদের ছাড় দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে। এসব পদক্ষেপ কীভাবে দেখছেন?

সালেহউদ্দিন আহমেদ: এই যে খেলাপি ঋণ নিয়ে বিভিন্ন প্রজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে, এটা বাইরের চাপে হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিন্তাভাবনা থেকে এসব প্রজ্ঞাপন আসেনি। ব্যবসায়ী, খেলাপি গ্রাহক ও রাজনীতিবিদদের চাপে এসব প্রজ্ঞাপন হচ্ছে। এটা ঠিক, খেলাপি গ্রাহকদের সবাই
ইচ্ছাকৃত খেলাপি নন। অনেক খাতে সমস্যা ছিল, আন্তর্জাতিক মন্দাও ছিল। তাঁদের কারও চলতি মূলধন, কারও প্রকল্প ঋণ লাগতে পারে। তবে এর সমাধান হিসেবে তো গণহারে কোনো সুবিধা দেওয়া সমাধান হতে পারে না। কেস টু কেস ভিত্তিতে এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। কিন্তু যাঁরা টাকা নিয়ে অন্য খাতে স্থানান্তর করেছেন, বিদেশে পাচার করেছেন, এখন তাঁরা সবাই একই সুবিধা পাবেন। তাঁরা ৯ শতাংশ সুদে ঋণ শোধ করতে পারবেন। আর যাঁরা ভালো গ্রাহক, তাঁদের ১০-১২ বা ১৩ শতাংশ সুদ দিতে হবে। অর্থাৎ দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন না করে বরং খারাপ লোকদের কাছে এনে সৃজনশীলদের দূরে সরিয়ে রাখা হচ্ছে। এতে ভালো গ্রাহকেরা নিরুৎসাহিত হবেন। খেলাপি ঋণ আরও বেড়ে যাবে। নিয়মিত গ্রাহকেরা ঋণ পরিশোধে আগ্রহ হারাবেন।

প্রথম আলো: ব্যাংকের উদ্যোক্তারা তো বেশ প্রভাবশালী এখন। তাঁদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আইন পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তও পাল্টে যাচ্ছে। কীভাবে দেখছেন বিষয়টি?

সালেহউদ্দিন আহমেদ: নিজের স্বাধীনতা বাংলাদেশ ব্যাংককেই রক্ষা করতে হবে। বাইরের সিদ্ধান্ত যদি তারা মানতে না চায়, কেউ নিশ্চয়ই গিয়ে চাপ দেবে না। নিজে থেকে শক্ত হলে তাহলে তো কেউ ঢুকতে পারবে না। তা ছাড়া, বাইরের প্রভাব যদি কমানো না যায়, তাহলে ব্যাংক খাত কখনোই ভালো হবে না। ব্যাংক পরিচালকদের চাপে যে আইন পরিবর্তন হয়ে গেল, এটা একেবারেই ঠিক হয়নি। ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের অনেক ঘাটতি আছে। আবার পরিচালকেরা অনেক সময় রাজনীতিকে ব্যাংকের পর্ষদে নিয়ে আনছেন, এটা একেবারেই ঠিক নয়। আর্থিক খাতে যখন কোনো সমস্যা হয়, তখন অন্য খাতে তা সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়ে। যেমন সমস্যাগুলো সরকারি ব্যাংক থেকে বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চলে গেছে। এরপর এসব সমস্যা অন্য খাতে চলে যাবে। সেটা উৎপাদনশীল খাতে গিয়ে বড় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এর ফলে প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থানেও বড় প্রভাব পড়বে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে অনেক সময় লাগবে। ১৯৩০ সালের মহামন্দায় উৎপাদনশীল খাতে বড় সমস্যা দেখা দিয়েছিল। এ কারণে ব্যাংকগুলো সমস্যায় পড়েছিল। ২০০৮ সালে আর্থিক খাতের সংকট থেকে যে বৈশ্বিক মন্দার সৃষ্টি হয়, তার মূল কারণ হচ্ছে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের অব্যবস্থাপনা। সে সংকট থেকে বিশ্বব্যাপী ব্যাংকিং খাত এখনো বের হতে পারেনি। আমেরিকা কিছুটা পেরেছে। ফ্রান্স ও জার্মানি ছাড়া অন্য দেশের ব্যাংকগুলো এখনো ধুঁকছে। আমাদের এমন কিছু হলে আমরা উঠে দাঁড়াতে পারব না। সুতরাং যথেষ্ট মনোযোগ দিয়ে এর সমাধান করতে হবে।

প্রথম আলো: অনেক সমস্যা নিয়ে তো আলোচনা হলো। তাহলে এর সমাধান কী?

সালেহউদ্দিন আহমেদ: সমস্যার কথা সবার জানা। এমনকি সমাধানও অজানা নয়। কিন্তু দ্রুত দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা। এই রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংককে যতই ক্ষমতা দেওয়া হোক, কোনো লাভ হবে না। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলেই নীতিনির্ধারকদের থেকে ভালো নির্দেশনা আসবে। এর ফলে যাঁরা কাজ করবেন, তাঁরা সাহস পাবেন। এখন যেমন ভালো ব্যাংকার, ব্যবসায়ী সবাই চুপ হয়ে গেছেন। খারাপরা সামনে চলে এসেছেন। তাঁদের কেউ কিছু বলছেনও না।

প্রথম আলো: সুনির্দিষ্ট কোনো সুপারিশ আছে আপনার?

সালেহউদ্দিন আহমেদ: ব্যাংকিং খাত ঠিক করতে অস্থায়ী ভিত্তিতে হলেও একটা ব্যাংক কমিশন করা যেতে পারে। স্থায়ী কমিশন হতে হবে, এমন নয়। অস্থায়ী কমিশন গঠন করে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করা প্রয়োজন। সময় এসেছে কমিশন গঠন করে সব নীতি পর্যালোচনা করার। দক্ষ ব্যক্তিরা বসে আলাপ–আলোচনা করে ঠিক করবেন নতুন কোনো নীতির প্রয়োজন আছে কি না বা ঠিক কী কী করতে হবে। এভাবে ব্যাংক খাতের সমস্যার একটা সমাধান হতে পারে।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

সালেহউদ্দিন আহমেদ: ধন্যবাদ।