খেলা দেখার সংস্কৃতিটাই হারিয়ে গেছে

মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে ১৯৮৮ সালের ফেডারেশন কাপের ফাইনালে মুখোমুখি আবাহনী ও মোহামেডান। ছবি সংগ্রহ: সৈয়দ এনাম মোর্শেদ
মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে ১৯৮৮ সালের ফেডারেশন কাপের ফাইনালে মুখোমুখি আবাহনী ও মোহামেডান। ছবি সংগ্রহ: সৈয়দ এনাম মোর্শেদ

বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের শূন্য গ্যালারির দিকে তাকিয়ে হাহাকার বাড়ে আতাউর রহমানের। ‘আতা ভাই’ নামে ফুটবল অঙ্গনে বিপুল পরিচিতি তাঁর। ষাটোর্ধ্ব এই মানুষ এখনো গ্যালারিতে এসে লাফান। ‘মোহামেডান’, ‘মোহামেডান’ বলে গলা ফাটান। মোহামেডান তাঁর জান, তাঁর প্রাণ। আতাউর রহমান ব্যতিক্রমী একজন ফুটবলপাগল মানুষ। তাঁর মতো কেউ এখন আর বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে এসে ক্যামেরাম্যানের চোখ কেড়ে নেন না। সারাক্ষণ হইহই করে কাটিয়ে দেওয়ার মতো সেই আলোচিত দর্শকেরা এখন আর মাঠমুখী নন। একটা শূন্যতা ঘিরে ধরেছে দেশের ফুটবলকে।

শুধু ফুটবল কেন, বাংলাদেশের ঘরোয়া খেলাধুলার সংসারটাই এখন দর্শকশূন্যতায় ধুঁকছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট হলে হয়তো টিকিটের জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে। কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেট দেখতে যান কজন? আবাহনী-মোহামেডান ক্রিকেট ম্যাচ, সে মিরপুরের সবুজ ঘাসের বুকে হোক আর ফতুল্লায়, টেনেটুনে ৫০ জন দর্শকও পাবেন না।

অথচ একটা সময় যে ম্যাচ ঘিরে সারা দেশ দুই ভাগে ভাগ হয়ে যেত, সেই আবাহনী-মোহামেডান ফুটবল ম্যাচের কী দশা, তা বোধ হয় সংবাদপত্রের কল্যাণে ফুটবলরসিকদের অজানা নয়। মেরেকেটে এখন দুই থেকে তিন হাজারের বেশি দর্শক হয় না একসময়ের ধুন্ধুমার সেই ম্যাচে। দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর ওই তীব্র লড়াই আমাদের ফুটবল নস্টালজিয়াকে বারবার উসকে দেয়। মনে করিয়ে দেয় কী এক সোনালি দিন ছিল প্রতিটি খেলার মাঠে! ফুটবল ম্যাচ দেখতে দুপুর থেকেই লম্বা লাইন পড়ত।

মাঠ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে দর্শক—এটাই আজকের দিনে বড় আক্ষেপ। ঘরোয়া কোনো খেলাতেই আজ আর একাগ্র চিত্তে খেলা দেখার লোক নেই। জাতীয় খেলা কাবাডি স্টেডিয়ামে যান, বেশির ভাগ সময়ই খালি। পাশে ভলিবল স্টেডিয়াম। ইয়াদ আলীরা স্বাধীনতার পর যখন খেলতেন, বলা হতো, ফুটবলের পর দর্শক উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি ভলিবলে। ভলিবল স্টেডিয়ামের পুরোনো দিনের ছবিগুলো দেখলে অনেকে বিস্মিত হবেন। কী জমজমাট একটা পরিবেশ ছিল তখন। আর এখন খাঁ খাঁ সব।

তাই একটা তর্ক অনেক দিন ধরেই জমছে। দর্শক আসেন না বলে ভালো খেলা হয় না, নাকি ভালো খেলা হয় না বলে দর্শক মাঠ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এটা অনেকটা সেই ‘ডিম আগে না মুরগি আগের’ মতো। যুক্তিতর্কে দুটির পক্ষেই ভোট পড়বে। কারণ, শূন্য গ্যালারির সামনে খেলতে কারই-বা ভালো লাগবে। শরীরে জোশ তো আসে না। তাই ভালো খেলতে পারেন না। ফুটবলাররা এই কথা খুব বলেন। যুক্তিটা একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। আবার অনেকে বলেন, দর্শক কেন আসবেন? ভালো খেলা তো হয় না। ‘ভালো খেলা হয় না’ কথাটা অবশ্য সরলীকরণ করা ভুল। এর মধ্যে ভালো খেলা হয়। সেটা সব মাঠেই, সব খেলাতেই।

তবে একটা সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই; এখন আর ক্রিকেট বাদে অন্য খেলায় এমন কেউ নেই, যাঁর খেলা দেখতে লোকে পঙ্গপালের মতো আসবে, একটা সময় যেটি ছিল। মেসি-রোনালদোদের ব্যক্তিগত সমর্থক আছে অগুনতি। তাই তাঁদের খেলা দেখার সুযোগটা লোকে পারতপক্ষে হারান না। বাংলাদেশের ফুটবলেও সত্তর, আশি বা নব্বইয়ের দশকে এমন অনেক তারকা ছিলেন, যাঁরা একটা আকর্ষণ ছড়াতে পেরেছিলেন। কাজী সালাউদ্দিনের কথা আসে সবার আগে। তাঁর মাঠে নামা, মাঠের বাইরে চলাফেরা—এগুলোও ছিল লোকের কাছে বড় আকর্ষণ। সে রকম তারকা আজ হারিয়ে গেছে। এনায়েতুর রহমান খান, আশরাফ উদ্দিন চুন্নু, শেখ আসলাম, কায়সার হামিদরা নিজস্ব একটা সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি করতে পেরেছিলেন। তেমন ফুটবলার গত দুই দশকে সেভাবে আর আসেনি। তাই একটা শূন্যতা, মাঠে আসতে অনাগ্রহ দর্শকদের। তা ছাড়া, আবাহনী-মোহামেডানের সেই দ্বৈরথ হারিয়ে যাওয়ায় লোকের মাঠ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার অন্যতম একটা বড় কারণ মানেন অনেকেই।

উপরন্তু, এখন নাগরিক জীবন অনেক কঠিন। চাইলেও মিরপুর থেকে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে এসে খেলা দেখা সম্ভব হয় না অনেকের পক্ষে। রাস্তায় যানজট খেয়ে ফেলে অনেকটা সময়। তা ছাড়া, মানুষের নাগালেই আছে বিনোদনের অনেক উপায়। টিভিতে রিমোট ঘুরালেই বাসায় বসে বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদ, চেলসি, বায়ার্ন মিউনিখসহ ইউরোপের সেরা দলগুলোর খেলা দেখা খুবই সহজ। তাই ওদিকটাতেই ঘুরে গেছে বর্তমান প্রজন্ম। কিন্তু যাঁরা একটা সময় মাঠে-ময়দানে কাটিয়েছেন, বাংলাদেশের খেলাধুলার অলিন্দে যাঁদের বাস ছিল, সেই বয়োজ্যেষ্ঠরাও আজ আর মাঠে আসেন না। ক্লাব কর্মকর্তারা নিজ দলের খেলা দেখতে এতটুকু উৎসাহী নন। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের নির্বাচনের সময় টাকার খেলা হয়। অথচ নির্বাচনে জিতে বেশির ভাগ সদস্যই ভুলে যান মাঠের চেনা পথ। এই যে বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলের শীর্ষ স্তর প্রিমিয়ার লিগ চলছে এখন ঢাকা, সিলেট, গোপালগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও নীলফামারীতে; কিন্তু দর্শক-সাড়া খুব কম। ৫০০, ১০০০ দর্শকও হয় না বেশির ভাগ ম্যাচে। ঢাকায় না হয় নাগরিক ব্যস্ততার একটা অজুহাত খাড়া করা যায়। কিন্তু ঢাকার বাইরে তো এমন হওয়ার কথা নয়। এমনকি বসুন্ধরা কিংস নামের প্রিমিয়ার লিগের নবাগত দলটি গত রাশিয়া বিশ্বকাপে খেলা কোস্টারিকার ফরোয়ার্ড দানিয়েল কলিনদ্রেসকে এনেছে। অনেকে ভেবেছিলেন, কলিনদ্রেসের খেলা দেখতে লোকে গ্যালারিতে ভিড় করবে। কিন্তু সেটা ভুল মনে করাচ্ছে স্টেডিয়ামের প্রায়-ফাঁকা গ্যালারি।

এই শূন্যতা মুছে স্টেডিয়ামের গ্যালারি আবার জেগে উঠবে—সেই আশা করা লোকেরও আকাল। সবাই যেন ধরেই নিয়েছেন, এটাই এখন আমাদের ক্রীড়া সংস্কৃতি। অথচ ইউরোপের ফুটবল দেখতে রাতজাগা মানুষ বাংলাদেশে লাখ লাখ। তাঁরা ফুটবল ভালোবাসেন। মেসি-রোনালদোকে নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তোলেন। আগামী ১ জুন অনুষ্ঠেয় মাদ্রিদে লিভারপুল-টটেনহামের চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল নিয়ে তর্ক জোড়েন। আফসোস, তর্ক হয় না আবাহনী-মোহামেডান নিয়ে। মনে হয়, আবাহনী-মোহামেডান এখন শুধুই অতীতের স্মৃতি!

মাসুদ আলম প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি