কৃষকের ধান ও 'রোল মডেল' রাষ্ট্রের নির্লিপ্ততা

ধানমাড়াইয়ে ব্যস্ত কৃষক
ধানমাড়াইয়ে ব্যস্ত কৃষক

বিশ্বের দ্রুততম ধনী লোক বৃদ্ধির দেশের গত ছয় মাসের কিছু সংবাদ শিরোনাম দেখা যাক:

‘আমনের বাম্পার ফলন, দিশেহারা কৃষক’; ‘রসুনের বাম্পার ফলন, লোকসানে কৃষক’; ‘শীতকালীন সবজির বাম্পার ফলন, হতাশায়
কৃষক’; ‘তরমুজের বাম্পার ফলন, হতাশ চাষি’; ‘ফুলকপির বাম্পার ফলনে বিপাকে কৃষক’; ‘ন্যায্যমূল্য নেই, আউশ নিয়ে বিপাকে কৃষক’; ‘বোরো নিয়ে বিপাকে কৃষক’; ‘দাম না পেয়ে পাকা ধানে আগুন দিলেন কৃষক’ এবং ‘দাম কমে যাওয়ায় গরুর খাবার টমেটো’।

বোঝা যায়, আউশ, আমন, ইরি, বোরো, আলু, পটোল, তরমুজ, বাঙ্গি—যা–ই লাগাক, এই রেকর্ড–ভাঙা বাম্পার ফলনের দেশে আজীবন মার খাওয়াই কৃষকের পরিণতি।

বলা হয়, যুগে যুগেই কৃষি অরক্ষিত ও অনিশ্চিত জীবিকা। ঝড়, বন্যা, শিলাবৃষ্টি, পোকার আক্রমণ—এসব প্রাকৃতিক কারণেই কৃষকের ঝুঁকি সীমাহীন। কৃষক বাজারদরের কাছে জিম্মি। কাজেই কৃষি এমনই। ঝুঁকি আর ঝামেলার। কিন্তু পৃথিবীর কোন দেশে কৃষি ঝুঁকিপূর্ণ নয়? আমেরিকা–ইউরোপে ধান, গম, আলুর বাজারদরে কি ওঠানামা হয় না? যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য পশ্চিম অঞ্চল মিডওয়েস্টের বন্যায় ভুট্টার খেতগুলো কি তলিয়ে যায় না? অতিরিক্ত শীতে আঙুর ও স্ট্রবেরিতে কি ফ্রস্টিং হয় না? পৃথিবীতে এমন একটি দেশ নেই, যেখানে কৃষি ঝুঁকিপূর্ণ নয়। পার্থক্য হলো কৃষি ঝুঁকিপূর্ণ এবং অনিশ্চিত—এই বাস্তবতা ওই সব দেশে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে স্বীকৃত। তাই ঝুঁকি নিয়ে ফসল ফলানোর জন্য কৃষিতে বিপুল প্রণোদনা এবং ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা আছে। কখনো ভর্তুকি, কখনো শস্যবিমা, কখনো ঝুঁকি মিটিয়ে দেওয়া (রিস্ক কাভারেজ), কখনো দাম কমার লোকসান মেটানো (প্রাইস লস কাভারেজ), কখনো সরাসরি অর্থ প্রদান ইত্যাদি বিভিন্নভাবে কৃষকদের সহযোগিতা করা হয়।

আমাদের মন্ত্রীরা কানাডা, আমেরিকা, ইউরোপকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। অথচ সেসব দেশের গম, আলু, ভুট্টা, সয়াবিনের চাষিরা কী অবিশ্বাস্য রকমের রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা পান, সেই খবর আমাদের মন্ত্রীরা রাখেন না। বলা হয়, আমেরিকার কৃষক বীজ রোপণ থেকে শুরু করে ফসল বিক্রি পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে প্রায় ৬০ রকমের রাষ্ট্রীয় সহযোগিতার জন্য আবেদন করতে পারেন। তাঁরা ঝড়–বন্যায় দুর্যোগকালীন সাহায্য পান। বাজারদরের পতন হলে বা প্রত্যাশার চেয়ে কম ফলন হলে কয়েক দফায় ক্ষতিপূরণ পান। এমনকি ফসল মজুত করতে চাইলে সেই খরচটাও দেয় রাষ্ট্র।

ইউরোপ–আমেরিকার কৃষক পরিবারগুলোর গড় আয় সে দেশের অকৃষক পরিবারগুলোর গড় আয়ের প্রায় দ্বিগুণ। এ নিয়ে নানা ধরনের কৌতুক প্রচলিত আছে। যেমন বলা হয়, আমেরিকার সর্বোচ্চ ভর্তুকি পান ডেভিড রকফেলার (আমেরিকার সবচেয়ে ধনী ব্যাংকারদের একজন।) আর ইংল্যান্ডে সবচেয়ে বেশি কৃষি ভর্তুকি পান রানি এলিজাবেথ। অর্থাৎ রানি হোক, চাষি হোক, ব্যাংকার হোক, ঝুঁকি নিয়ে কৃষিতে বিনিয়োগ করলেই রাষ্ট্র প্রণোদনা দেবে, বিমা করে দেবে, গরু–বাছুর পালার খরচ দেবে।

যেমন ইউরোপের প্রতিটি গরু বছরে প্রায় ৭০ হাজার টাকা ভর্তুকি পায় (দিনে প্রায় আড়াই ডলার)। অর্থাৎ ইউরোপীয় গরুদের দৈনিক আয় পৃথিবীর অর্ধেক মানুষের দৈনিক আয়ের চেয়ে বেশি। ঠাট্টা করে বলা হয়, ইউরোপের দুই কোটি গরু যে পরিমাণ রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি পায়, তা দিয়ে প্রতিটি গরু ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ থেকে লম্বা অবকাশ যাপন করে ফিরতে পারবে। সাংবাদিক পি সাইনাথ একবার এক ভারতীয় কৃষক সংগঠককে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘ভারতীয় কৃষকের স্বপ্ন কী?’ উত্তর এসেছিল, ‘পরের জন্মে ইংল্যান্ডের গরু হয়ে জন্ম নেওয়া।’

উন্নত দেশগুলোতে গরু ও গরুর মালিক এতটাই যত্নের, আদরের।

ধান, গম, আলু ছাড়া জীবন বাঁচে না, সভ্যতা টেকে না—এই সহজ বাস্তবতা বুঝতে পেরে ঝুঁকিপূর্ণ এই উৎপাদনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে একটি কৃষকবান্ধব ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে উন্নত রাষ্ট্রগুলো। কানাডা ২০১২ সাল পর্যন্তও জাতীয় হুইট বোর্ডের মাধ্যমে কৃষকের উৎপাদিত প্রতিটি শস্যকণা কিনে রাখত। দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার ১৯৭০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত কৃষকের কাছ থেকে বেশি দামে চাল কিনে কম দামে জনসাধারণের কাছে বিক্রি করত। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার চাপে এই কৃষকবান্ধব প্রথাগুলো বাজারমুখী হলেও দক্ষিণ কোরিয়া এখনো কৃষকের ‘টার্গেট’ মূল্য আর বাজারমূল্যের পার্থক্য হলে ‘ডেফিসিয়েন্সি পেমেন্ট’–এর মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ দেয়। এমনকি ভারতের পাঞ্জাব, হরিয়ানাসহ অন্তত কয়েকটি রাজ্যের সরকার অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে ‘মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস’ পদ্ধতির মধ্য দিয়ে ধান, গম, সরিষার মতো কৃষিপণ্যগুলো সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে লাভজনক মূল্যে কিনে নেয়।

বাংলাদেশের কৃষক ভর্তুকি চান না। ৩৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ মওকুফও চান না। চান শুধু ন্যায্য দাম। ফড়িয়াদের উৎপাত আর চালকলের মালিকদের প্রতারণা থেকে মুক্তি। সরকারি ক্রয়কেন্দ্রে গিয়ে ভালো দামে ধান বেচতে পারার গ্যারান্টি। এবার দুই কোটি টন বোরো উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা, অথচ সরকার কিনবে মাত্র ১২.৫ লাখ টন। তা–ও সরাসরি কৃষকের ধান নয়, ১১ লাখ টনই মিলের চাল। কৃষকের ধানের বদলে মিলের চাল কিনলে কার লাভ?

মন্ত্রী বলছেন, সারা দেশ থেকে চাষিদের নির্বাচন করা কঠিন।

কঠিন কেন? এত বছরেও কৃষকদের তালিকা নেই কেন? কেউ বলছে সরকারি গুদামে জায়গা নেই। নেই কেন? ‘উন্নয়নের’ দেশে ফসল মজুত করার সরকারি সামর্থ্য এত দিনেও বাড়ানো হয়নি কেন? গত আমন মৌসুমে বাম্পার ফলনের পরও চলতি বছরে দুই লাখ টন চাল আমদানি হলো কোন বিবেচনায়? হিলি বন্দর দিয়ে এখন পর্যন্ত ট্রাকে ট্রাকে চাল ঢুকছে কোন সাহসে?

কৃষক বলেন, ‘সরকারি গুদামে ধান দিতে গেলে কয় ধান শুকাইছে না, আবার ফড়িয়া-টাউটরা ওই একই ধান আমরার কাছ থাকি কম দামে কিইন্না গোদামে দিতে পারে।’ কৃষক কষ্ট করে ফসল ফলান। পয়সা খরচ করে ভ্যান ভাড়া দিয়ে গুদাম পর্যন্ত নিয়ে যান। অথচ সরকার ধান যথেষ্ট শুকায়নি বলে ফিরিয়ে দেয় কেন? ধান কেনার ইচ্ছা থাকলে এত বছরেও সব রকমের ধান কেনা ও মজুত করার সক্ষমতা তৈরি করেনি কেন রাষ্ট্র? চাতালের মালিকদের ওপর নির্ভরশীলতা কমায়নি কেন? সরকারি গুদামের কর্মকর্তাদের সঙ্গে চালকল ও চাতালের মালিকদের কিসের সম্পর্ক? বিশ্বের সর্বোচ্চ খরচের হাইওয়ে বানানো যায় আর কৃষকের কাছে লোক পাঠিয়ে ধান কেনা যায় না? তখন বলা হয়, স্টোরেজ নেই, ক্যাপাসিটি নেই, ধান শুকায়নি!

সরকার জেলায় জেলায় ধান কেনা শুরু করলেই নড়েচড়ে বসতেন চাতালের মালিকেরা। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ধানের দাম ফিরত। অথচ কৃষকের এমন বুকফাটা হাহাকারের দিনেও সেই উদ্যোগ নিতে এত দেরি কেন? আজকে অগণিত কৃষক যখন খেতমজুর–সংকট আর লোকসানের ভয়ে পাকা ধান মাঠে ফেলে রেখেছেন, কতটুকু নির্লিপ্ত হলে একজন কৃষিমন্ত্রী বলতে পারেন, সরকার ধানের দাম বাড়াবে না!

আজকে গার্মেন্টস শিল্পে এ ধরনের বিপর্যয় হলে মাতম পড়ে যেত না? ২০০৯ সালের অর্থনৈতিক মন্দার সময়, ২০১৩ সালের পেট্রলবোমা–সন্ত্রাসের সময় দফায় দফায় মিটিং করে হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা দেওয়া হয়নি গার্মেন্টস মালিকদের? অথচ কৃষক কি উদ্যোক্তা নন? কৃষি কি প্রাইভেট সেক্টর নয়?

বেসরকারি বিনিয়োগের পরিবেশ নিশ্চিত করতে কত ঢাকঢোল পেটায় সরকার, অথচ দেড় কোটি চাষির রক্ত পানি করা বিনিয়োগ কি বিনিয়োগ নয়? বীজ বপন থেকে শুরু করে চারা রোপণ, ধান পাকলে ধান কাটা, এরপর ধানমাড়াই, বাছাই, রোদে শুকানো—এমন প্রতিটি পর্যায়ে যে অপূর্ব উদ্যোগ, সৃজনশীলতা, বৈচিত্র্য, দক্ষতা প্রয়োজন, তার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব নয়? শীতকালে দুই টাকা দরে মাঠের বেগুন, টমেটো, ফুলকপি, আলু ছেড়ে দেন কৃষক। কৃষককে বাঁচাতে এত দিনেও জেলায় জেলায় মিনি কোল্ডস্টোরেজ করা হলো না, আর এখন হাজারো কৃষক খেদিয়ে জেলায় জেলায় মেগা অর্থনৈতিক অঞ্চল করা হয়?

কত বুকভাঙা কাহিনি। কত অনাচারের দলিল। একটা অবিশ্বাস্য রকমের অসৎ ব্যবস্থার মধ্যে ঘুরপাক খায় কৃষকের দীর্ঘ নিশ্বাস। আমরা রাতারাতি কানাডা হয়ে যাই, সিঙ্গাপুর হয়ে যাই, রোল মডেল হয়ে যাই, তবু কিছু কি পাল্টায়?


মাহা মির্জা আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অর্থনীতি বিষয়ের গবেষক