যে দিকে নজর দিতে হবে

ধর্ষণ, ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যা, যৌন নির্যাতন ও নারীর প্রতি সহিংসতার ক্রমবর্ধমান হার সমাজের নেতিবাচক চিত্রই তুলে ধরছে। শিশু থেকে বৃদ্ধা কেউই ধর্ষণ থেকে রেহাই পাচ্ছে না। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী চলতি মে মাসের প্রথম আট দিনেই ৪১টি শিশু ধর্ষিত হয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, ১৩ থেকে ১৮ বছরের শিশুরাই সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছে ধর্ষণের। গত বছর মোট ৭৩২ জন ধর্ষিতার মধ্যে এই বয়সী ছিল ১১৬ জন। এ সময়ে ৭ থেকে ১২ বছর বয়সী ধর্ষিত মেয়েশিশুর সংখ্যা ছিল ১০৪। আর চলতি বছরের প্রথম চার মাসেই এই দুই সংখ্যা যথাক্রমে ৬৪ ও ৫২।

২০১৫ সালে মোট ধর্ষণের সংখ্যা ছিল ৮৪৬টি। এর মধ্যে একক ধর্ষণের ঘটনা ৪৮৪ টি, গণধর্ষণ ২৪৫, ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যা ৬০, ধর্ষণের পরে আত্মহত্যা ২ আর ধর্ষণচেষ্টা ৯৪ টি। গত পাঁচ বছরের চিত্র মোটামুটি এ রকমই। এই পরিসংখ্যান সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে তৈরি। সব ধর্ষণের খবর সংবাদমাধ্যমে আসে না। এ দেশে ধর্ষণের ঘটনা সাধারণত সামাজিকভাবে মিটিয়ে ফেলা বা চাপা দেওয়ার চেষ্টা থাকে। ফলে বাস্তবে যে এমন ঘটনা বহুগুণ বেশি ঘটছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ধর্ষণের ঘটনা যে বাড়ছে, শিশুরাও যে নিরাপদ নয়, সামাজিকভাবে যেসব পুরুষকে নিরাপদ ভাবা হতো যেমন শিক্ষক, ধর্মীয় নেতা, বয়স ও সম্পর্কে মুরব্বিস্থানীয় ব্যক্তি; তাঁরাও যে আজ নারীর জন্য নিরাপদ নন এবং পুলিশসহ পুরুষশাসিত সমাজের ক্ষমতা-কাঠামোয় নারীর অবস্থান যে এখনো নিতান্ত দুর্বল, সুবিচারের পথ যে প্রতিকূলতায় আচ্ছন্ন, সে সম্পর্কে দ্বিমত করার কারণ নেই। শুধু যদি মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতের ঘটনাটাই দৃষ্টান্ত ধরি, তাহলে দেখি শিক্ষকই ছিলেন যৌন নির্যাতকের ভূমিকায়, কতিপয় ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক তাঁর হত্যাকারী, ক্ষমতাসীন দলের নেতা তাঁদের পৃষ্ঠপোষক, আর পুলিশ ছিল তাঁদের রক্ষক।

ধর্ষণ এত বাড়ছে কেন? শরীরী ধর্ষণ ছাড়াও পথেঘাটে, গণপরিবহনে, কর্মক্ষেত্রে, এমনকি ঘরে কেন নারী পুরুষের দ্বারা কথা, ইঙ্গিত, স্পর্শে ব্যাপক হারে যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে? এক জরিপে দেখা যাচ্ছে, গণপরিবহনে ৯৪ শতাংশ নারীই যৌন হয়রানি, অশ্লীল আচরণ ও সামাজিক অবমাননার শিকার হন। এই যদি বাস্তবতা হয় তবে একে সুস্থ সমাজ বলা যাবে না। এ থেকে মুক্তি পেতে হলে এই ব্যাধি নির্ণয় ও নির্মূল করতে হবে।

ধর্ষণ ও নারীর প্রতি আগ্রাসী যৌনাত্মক আচরণ পুরুষের অপরিশীলিত অনিয়ন্ত্রিত মনোবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ। বয়ঃসন্ধি থেকে একটি ছেলে তার উদীয়মান যৌন চেতনায় যেমন নিজের সক্ষমতার নতুন রূপ সম্পর্কে সচেতন হয়, তেমনি এ নিয়ে মনোদৈহিক সংকটেও ভোগে। এ সময়ে তার সঠিক পরামর্শ, সাহচর্য, নানা সৃজনশীল কাজ ও সুস্থ বিনোদনে সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ দরকার হয়। পরিবার, বিদ্যালয় বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান তাকে এ ব্যাপারে সহযোগিতা করে। ফলে তার জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নাজুক কাল কেটে যায় প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ছাড়া। তখন থেকেই যৌনতা সম্পর্কে তার বিভ্রান্তি চলতে থাকে। মেয়েদের সঙ্গে সহজ স্বাভাবিক সম্পর্ক ও আচরণ তার শেখা হয় না। এটি এক ভয়ংকর বাস্তবতা।

এ বয়সে ছেলেরা প্রধানত যৌনশক্তি ও চেতনার বিকাশের ফলেই নিজেকে বড় ভাবতে, বড় কাজের উপযোগী ভাবতে ভালোবাসে। এমন সব কাজ তাকে তৃপ্তি দেয়, যাতে তার যোগ্যতা, ক্ষমতা, সামর্থ্যের প্রকাশ ঘটে। অংশগ্রহণ, নেতৃত্ব, বিজয় ও সাফল্য তাকে তৃপ্তি দেয়, তার মনোদৈহিক সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা এতে তৃপ্ত হয়। একসময়ে খেলাঘর ও কচিকাঁচার আসরের মতো সংগঠন, বয়স্কাউট ও গার্ল গাইডস, পাড়ায় পাড়ায় গড়ে ওঠা ক্লাব ও পাঠাগার, স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, দেয়ালপত্রিকাসহ নানা সহশিক্ষা কার্যক্রম তাদের এ ধরনের চাহিদা পূরণ করত। প্রায় তিন দশক ধরে কট্টর রক্ষণশীল রাজনীতি ও সমাজচিন্তার ভ্রান্ত ভূমিকা এবং রাজনৈতিক-সামাজিক অবক্ষয়ের ফলে ছেলেমেয়েদের সংস্কৃতিচর্চার পরিবেশ নষ্ট হয়েছে।

রাজনীতি অর্থবিত্ত ও ক্ষমতায় শক্তিধর হওয়ার মাধ্যম হয়ে পড়ায় ক্রমে সংস্কৃতি থেকে বিযুক্ত হয়ে পড়েছে। শিক্ষা শুধু পরীক্ষার ফলাফলমুখী হয়ে পড়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শৈশব-কৈশোর-তারুণ্যের সুস্থ সামগ্রিক বিকাশের সুযোগও নেই, পরিবেশও নেই। উপরন্তু ভোগ্যপণ্যের উৎকর্ষ ও সরবরাহ এতটাই বেড়েছে যে মানুষের মধ্যে কেনাকাটা ও ভোগের আসক্তি প্রবল হয়েছে। শৈশব-কৈশোরে দলবদ্ধ কাজ, ব্যক্তিগত গণ্ডি ছাপিয়ে সমাজ ও ইতিহাসের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে ভূমিকা পালন, সৃজনশীল ও গঠনমূলক কাজের সামর্থ্য ও দক্ষতার প্রকাশ এবং সর্বোপরি ত্যাগের প্রতি (ভোগের বিপরীতে) কিংবা অন্তত অন্যদের প্রয়োজন বিবেচনার উপলব্ধি তার মানসে ততটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে না, যাতে তার ন্যায়-অন্যায় বিবেচনা ও মানবিক বোধ পরিচ্ছন্ন, শাণিত ও কার্যকর হতে থাকে। শিশু থেকে তরুণ জনগোষ্ঠী সঠিকভাবে মানুষ হয়ে ওঠার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

সমাজে ক্ষমতা ও পুরুষ-শক্তির বেপরোয়া আগ্রাসী প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে। ঋণখেলাপি, নদী-খাল, বন ও মাঠ দখল, এসব নিয়ে সংঘাত, হানাহানি চলছে। মানুষ অবলীলায় মিথ্যা ও প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে, হিংসা ও সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়ছে, স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে, ভোগ-বিলাসে গা ভাসাচ্ছে। পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় বিধান, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য—কিছুই তার আধোযাত্রা থামাতে পারছে না। এ রকম বাস্তবতায় প্রথম বলি হয় মনুষ্যত্ব, আর তখন মূল্যবোধসম্পন্ন প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠা কঠিন হয়ে পড়ে। আমরা তেমন কঠিন বৈরী বাস্তবতার নিষ্ঠুর চিত্র দেখছি আর শিউরে উঠছি। কিন্তু কোনো ইতিবাচক কাজের সূচনা না করে শুধু প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা বস্তুত আধোযাত্রায় শামিল হওয়ারই নামান্তর।

ইতিমধ্যে সমাজে অনেক পরিবর্তন হয়েছে, আমাদের ভ্রান্তপথে যাত্রাও অনেক দূর এগিয়ে গেছে। ফলে রাতারাতি সম্পূর্ণ চিত্র বদলানো যাবে না। কিন্তু তাই বলে বসে থাকাও চলবে না। নতুন প্রজন্মকে নিয়েই কাজ শুরু করতে হবে। ছেলেমেয়েদের এমন সব কাজ ও খেলায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিতে হবে, যাতে তাদের মনোদৈহিক চাহিদা পূরণ হয়, অংশীদারত্বের অভ্যাস গড়ে ওঠে, অন্যের গুণের কদর করার মনোবৃত্তি তৈরি হয়, নিজ নিজ ক্ষমতার বিকাশ ঘটে এবং সেই সঙ্গে তারা যেন নিজেদের কাজ ও ভূমিকার সাফল্যের দৃশ্যমান চিত্র দেখতে পায়। এমনভাবে বড় হলে সেই ছেলেমেয়েরা সহজাতভাবে নিজের মর্যাদা ও ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ার মতো কাজে জড়াবে না।

তবে অপরাধী মনোবৃত্তির মানুষ দুই-একজন তো সব সময়ই তৈরি হতে পারে। তখন কঠোর আইন ও শাস্তির প্রয়োগ কার্যকর ফল এনে দিতে পারবে। মানুষ তৈরির সঠিক পথ নির্মাণ না করে শুধু আইন প্রয়োগ করে এই ব্যাধি থেকে সমাজকে মুক্ত করা যাবে না।

আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক