রূপপুর রূপকথা ও বালিশ-বৃত্তান্ত

কোনো জাতির ইতিহাস স্রোতস্বিনী নদীর মতো। সন-তারিখের দেয়াল তুলে তাকে টুকরো টুকরো করার চেষ্টা নির্বুদ্ধিতা। আমরা মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিলাম, ব্রিটিশ ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত এবং সবশেষে পাকিস্তানের অংশ ছিলাম, তা অস্বীকার করা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।

ষাটের দশকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আইয়ুব খান রূপপুর নামক এক অপরিচিত জনপদে ২৫০ মেগাওয়াট শক্তিসম্পন্ন পারমাণবিক প্রকল্প গ্রহণ করেন। তাঁর সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী গোলাম ফারুক ১৯৬৬-এর মে মাসে রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের জন্য ফ্রান্সের সঙ্গে ৬ কোটি ডলারের একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। কানাডা ও জাপানের সঙ্গেও এই প্রকল্প নিয়ে আইয়ুব সরকার দেনদরবার করে এবং তাদের থেকে ঋণ পাওয়ার আশ্বাস পায়। স্বাধীনতার পর অনেক বছর এই প্রকল্পের কাজ বন্ধ ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে প্রকল্পটি পুনরুজ্জীবিত করেন, বর্তমানে রাশিয়ার সহায়তায় বাস্তবায়ন করছেন। এই প্রকল্পের প্রণেতারা বহু জিনিস কেনাকাটাসহ নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করলেও, কর্মকর্তাদের শান্তিতে ঘুমানোর জন্য বিছানাপত্র, বিশেষ করে শয্যার বালিশ নিয়ে কিছু ভাবেননি। আর দশজন যে রকম বালিশে ঘুমায় তাঁরাও সে রকম বালিশেই মাথা রেখে এবং কোলবালিশ বুকে জড়িয়ে শান্তিতে ঘুমাবেন, তেমনটিই ছিল তাঁদের ধারণা।

বর্তমান সময়ের পৃথিবীর সম্ভবত সবচেয়ে দামি বালিশ পাওয়া যাবে রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের কর্মকর্তাদের ফ্ল্যাটে। বিপ্লবপূর্ব রাশিয়ার জার কী রকম বালিশ ব্যবহার করতেন, তা মহামতি লেনিন বলতে পারতেন। বর্তমানে ব্রিটেনের রানি এবং জাপানের সম্রাটের ব্যবহৃত বালিশের মূল্যও আমাদের জানা নেই। সৌভাগ্যবশত আমি তিনজন মানব-মানবীর শয্যায় ব্যবহৃত বালিশ দেখার সুযোগ পেয়েছি। তাঁরা হলেন ইরানের শাহেনশাহ রেজা শাহ পাহলভি, তাঁর দ্বিতীয় বা তৃতীয় রানি ফারাহ দীবা এবং তাঁদের বিতাড়িত করে ইরানের ধর্মীয় ও সর্বময় রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি। বিশেষ মুহূর্তে শাহেনশাহ ও রানি একই বিছানায় শুয়েছেন, কিন্তু তাঁদের শয্যা ছিল আলাদা। আয়াতুল্লাহ খোমেনি জীবনের শেষ ১০টি বছর যে ছোট ঘরে সাধারণ বিছানায় শুয়েছেন এবং যে বালিশে ঘুমিয়েছেন, তা রূপপুরের ভাগ্যবান কর্মকর্তারা কল্পনাও করতে পারবেন না। রূপপুরের এক বালিশের দামে কৌম নগরীর ১০ বালিশ কেনা সম্ভব। পারস্যের শেষ শাহের বালিশও দামের দিক থেকে রূপপুরের ধারেকাছে নয়। অবশ্য বিল গেটস কত দামের বালিশ ব্যবহার করেন, তা রূপপুরের ঠিকাদার ও প্রকল্পের কর্মকর্তারা অনায়াসে জেনে নিতে পারেন।

বঙ্গীয় সমাজে মানুষ সারা জীবন সাধারণ বিছানায় ঘুমালেও জীবনে অন্তত একবার অপেক্ষাকৃত দামি বালিশ-তোশকে ঘুমায়, সেটা বাসরঘরের ফুলশয্যায়। ফুলশয্যার বালিশের গেলাফে যদি রঙিন ফুল তোলা থাকে, কারও কিছু বলার নেই। কিন্তু পারমাণবিক প্রকল্পের কর্মকর্তাদের বালিশ-চাদর ফুলশয্যাকে ছাড়িয়ে গেলে আমাদের মৃদু আপত্তি।

যারা বালিশ সরবরাহ করেছেন তারা হয়তো ভেবেছেন পরমাণু কেন্দ্রের বড় বড় কর্মকর্তার ঘুমানোর বালিশ একটু বেশি আরামদায়ক হওয়া বাঞ্ছনীয়। তাঁর মস্তিষ্ক ঠান্ডা রাখার জন্য সুনিদ্রা হওয়া প্রয়োজন। বালিশের কারণে যদি ভালো ঘুম না হয়, ঘাড় ব্যথা করে, তাঁর কাজে ব্যাঘাত ঘটা বিচিত্র নয়। বিশ্বের বিভিন্ন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মকর্তাদের এত দামি বালিশে ঘুমানোর সৌভাগ্য হয়েছে বলে মনে হয় না।

একজন যত দামি বালিশে ঘুমাবেন, তত ভালো ঘুম হবে সন্দেহ নেই এবং শান্তিপূর্ণ ঘুমের মধ্যেই সুখস্বপ্ন দেখা সম্ভব। বালিশ সরবরাহকারীরা সম্ভবত কর্মকর্তাদের সুখস্বপ্ন দেখাতে চেয়েছেন। অবশ্য শুধু রূপপুর কেন, আমাদের পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে এক বঙ্গীয় বনপ্রভুর বাড়িতে বালিশের মধ্যে তুলার পরিবর্তে কড়কড়া ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট পাওয়া গিয়েছিল।

ঢাকায় সাবেক রুশ রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার নিকোলায়েভের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। তিনি তাঁর দূতাবাসে গানবাজনা ও খানাপিনার আসরে দাওয়াত দিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে রুশ ও বাংলা ভাষার শিল্প-সাহিত্য নিয়ে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে এই পারমাণবিক প্রকল্পের প্রসঙ্গও পাড়তেন। যখন এই প্রকল্পের অপ্রয়োজনীয়তা ও অপকারিতা সম্পর্কে আমরা পরিবেশকর্মীরা বলছিলাম, তখন মি. নিকোলায়েভ ছিলেন এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কখনো এমনও হয়েছে যে তিনি তাঁর বলিষ্ঠ হাতখানা আমার শীর্ণ কাঁধে স্থাপন করে বলতেন: দোহাই ভাই, এসব কাজে বাধা দিসনে। আমি বলতাম, আমরা বকবক করেই যাব প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে, তোমার কাজ তুমি করো গিয়ে।

কথায় কথা আসে। এই বালিশ, চা বানানোর কেটলি, টিভি সেট প্রভৃতি প্রসঙ্গেই পারমাণবিক প্রকল্পের প্রসঙ্গ উঠল, তা না হলে এসব প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। ভুলি নাই শুধু চেরনোবিল ও জাপানে পারমাণবিক প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়ার কথা।

১৯৫০ দশকের মাঝামাঝি পাকিস্তান সরকার আমেরিকা, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সহযোগিতা নিয়ে পারমাণবিক শক্তি শান্তিপূর্ণ কাজে ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়। মাওলানা ভাসানী তার ঘোর বিরোধিতা করলেও একই দলের আরেক নেতা সোহরাওয়ার্দী করেন সাবলীলভাবে সমর্থন। তখন পাকিস্তানে আবদুস সালাম, নাজির আহমেদ ও আই এইচ উসমানী (ইশরাত হোসাইন উসমানী) পরমাণু বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করছিলেন। সালাম ও উসমানী ছিলেন নেতৃত্বে। তাঁরা একটি বিশ্বমানের পরমাণু গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা এবং আণবিক কর্মসূচির প্রকল্প প্রণয়ন করেন।

পাকিস্তানে তখন প্রাসাদ ষড়যন্ত্র চলছিল পুরোদমে। ঘন ঘন সরকার বদল হচ্ছিল। ১৯৫৬-৫৭ সালে আওয়ামী লীগ-রিপাবলিকান পার্টি কোয়ালিশন করে সরকার গঠন করে। প্রধানমন্ত্রী হন আওয়ামী লীগ নেতা সোহরাওয়ার্দী। তিনি সালাম ও উসমানীর পরমাণু পরিকল্পনা লুফে নেন। বাস্তবায়নের কাজ শুরু করার আগেই সোহরাওয়ার্দী ক্ষমতাচ্যুত হন। বছরখানেক পরে প্রধান সেনাপতি আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করেন। তিনি গঠন করেন পাকিস্তান অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন।

১৯৬০ দশকে আণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে উসমানী পরমাণু গবেষণায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের এবং পরে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হক উসমানীর ভাই। ১৯৮০ দশকের শেষ দিকে আমি এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের কয়েক সপ্তাহের এক প্রশিক্ষণ শেষে তেহরান থেকে ঢাকা ফেরার পথে করাচি যাত্রাবিরতি করি। তখন মাহমুদুল হক উসমানীর আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। ইশরাত উসমানী ও আণবিক শক্তি কমিশনের বিষয়েও কথা হয়। তিনি বলেন, তাঁরা উত্তর প্রদেশের অধিবাসী। তাঁর ভাইয়ের লেখাপড়া আলীগড়ে ও বোম্বেতে, পরে লন্ডনে। প্রথম জীবনে ছিলেন ভারতে আইসিএস অফিসার। পাকিস্তানে তাঁরা মোহাজের।

একপর্যায়ে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে উসমানীর সম্পর্ক ভালো ছিল না। তিনি বিদেশে চলে যান। আন্তর্জাতিক অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সির চেয়ারম্যানও ছিলেন। ইরানের শাহেরও পরমাণুবিষয়ক পরামর্শদাতা ছিলেন। যে একটি কারণে তিনি আমাদের কাছে স্মরণীয় তা হলো, ষাটের দশকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্রদের ইউরোপ-আমেরিকায় উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য বৃত্তি জোগাড় করে দেন। তিনি চাইতেন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাঙালি বিজ্ঞানীদের দ্বারাই পরিচালিত হোক।

মূল পরিকল্পনায় ছিল রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র হবে একটি ‘বিশ্বমানের’ প্রতিষ্ঠান, যা পরিচালিত হবে বাঙালি বিজ্ঞানী ও কর্মকর্তাদের দ্বারা; বিদেশিদের দ্বারা নয়। সেখানে কেনাকাটায় দুর্নীতি হবে, তা কারও কল্পনায় ছিল না।

রূপপুরের বালিশ-বৃত্তান্ত বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এ রকম হাজারো ঘটনা পাওয়া যাবে সরকারি প্রকল্পের কেনাকাটায়। আরব্য রজনীতে রয়েছে হাজার এক রাতের কাহিনি। ওই গল্পকারেরা আজ বেঁচে থাকলে যোগ করতে পারতেন হাজার দ্বিতীয় রাতের কল্পকাহিনির পরিবর্তে বাস্তব কাহিনি।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক