ধনীরা কি পৃথিবী বদলে দিতে পারেন?

গত সপ্তাহে আটলান্টার মোরহাউস কলেজের বর্ষশেষ গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠানে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। রবার্ট স্মিথ নামের এক বিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল অনুষ্ঠানের মুখ্য বক্তা হিসেবে। তিনি আমেরিকার সবচেয়ে ধনাঢ্য কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি। জনসেবার জন্য আগে থেকেই তাঁর খ্যাতি রয়েছে। রবার্ট স্মিথ কাউকে কোনো আগাম আভাস না দিয়ে ভাষণের একদম শেষ পর্যায়ে ঘোষণা করেন, ২০১৯ সালে যাঁরা এই কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়ে বেরোচ্ছেন, তাঁদের প্রত্যেকের অপরিশোধিত শিক্ষাঋণ তিনি শোধ করে দেবেন।

রবার্ট স্মিথ কী বলছেন, সে কথার মানে বুঝতেই অনেকের কয়েক মিনিট চলে গেল। দু-চার ডলার নয়, প্রায় ৪০০ শিক্ষার্থীর ৪০ মিলিয়ন ডলার ঋণ এক কথায় মাফ! যুক্তরাষ্ট্রে লেখাপড়ার ব্যয় সহজসাধ্য নয়। চার বছর কলেজে পড়ার জন্য কোনো কোনো শিক্ষার্থীর এক লাখ ডলার বা তার চেয়ে বেশি অর্থ ঋণ করা আছে। কেউ কেউ শিক্ষাজীবন শেষ করার অনেক পরেও ঋণের বোঝা বয়ে বেড়াতে বাধ্য হন। একজন ভীষণ ধনাঢ্য ব্যক্তি, যাঁর মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার, তিনি কী অনায়াসে এই শিক্ষার্থীদের অনেকের জীবনে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিলেন।

কয়েক বছর ধরেই বিশ্বের ধনবান ব্যক্তিরা নামজাদা দাতা হয়ে উঠেছেন। বিল গেটস থেকে ওয়ারেন বাফেট, ফেসবুকের মার্ক জাকারবার্গ থেকে আমাজনের জেফ বেজোস—এঁরা সবাই যেন একধরনের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন কে কার চেয়ে কত বেশি অর্থ বিলিয়ে দেবেন। বিল গেটস তো বলেই বসেছেন, তিনি জীবনে যে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামিয়েছেন, সব বিলিয়ে দেবেন। তাঁর মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার। এ পর্যন্ত যে অর্থ তিনি দান করেছেন, তার পরিমাণ ৪৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি।

সব দেশেই ধনীরা কম–বেশি অর্থ দান করেন। কেউ করেন পরজন্মে পুণ্যের লোভে, কেউ করেন জীবদ্দশায় নাম কামাতে, কেউবা দান করেন কর মওকুফ পাওয়া যায়, এই ভাবনা থেকে। এমন লোকও আছেন, যাঁরা নাম কামালে আরও বেশি অর্থ কামানো যায়—এই ভাবনা থেকে দান করেন।

অর্থ বিলানোর কাজটা ভালো না মন্দ, এই নিয়ে এক পুরোনো বিতর্ক নতুন করে উসকে দিয়েছেন নিউইয়র্ক টাইমস–এর সাবেক সাংবাদিক আনন্দ গিরিধরদাস। উইনার্স টেক অল নামের এক গ্রন্থে তিনি দাবি করেছেন, দানছত্র খোলার নামে অতি ধনীরা যে কাণ্ড করছেন, তা আসলে একধরনের ব্যঙ্গ ছাড়া আর কিছুই নয়। তাঁরা কেউই খুব সৎপথে অর্থ উপার্জন করেননি। তাঁরা নিজেরাই প্রভাব ও অর্থ খাটিয়ে এমন এক ব্যবস্থার সৃষ্টি করেছেন, যা তাঁদের কোটিপতি, বহু কোটিপতি হতে সাহায্য করেছে। এখন তাঁরাই আবার পৃথিবী বদলের কাজে নেমেছেন, যার লক্ষ্য একটাই—পৃথিবী বদলানো নয়, যে সুবিধা তাঁরা এত দিন ভোগ করে এসেছেন, তা টিকিয়ে রাখা। গিরিধরদাসের যুক্তি অনুসারে, চলতি ভোগবাদী ব্যবস্থার প্রধান সমস্যা হলো সম্পদের অসম বণ্টন ও অব্যাহত বৈষম্য। ধনীরা কিছু টাকা ছড়ালে তাঁদের যেমন সম্পদ কমে না, তেমনি বিশ্বজোড়া বৈষম্যেরও কোনো তারতম্য হয় না। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত সম্পদ সৃষ্টির প্রধান হাতিয়ার হলো মুনাফা। শ্রমিকদের ও ভোক্তাদের না ঠকালে মুনাফা হয় না। ফলে যে চোরাপথে তাঁরা সম্পদের পাহাড় গড়েছেন, সেই একই ব্যবস্থা ব্যবহার করে তাঁরা কী করে অসাম্য কমাবেন?

তাহলে কি অতি ধনীরা নিজেদের ধন দান করে উল্টো বিপদ ডেকে আনছেন?

কিছুটা আনছেন তো বটেই। তাঁরা নিজেরাই ঠিক করছেন কীভাবে তাঁদের দান করা অর্থ ব্যয় হবে। অনেকটা আমেরিকার দেওয়া ‘ফরেইন এইডের’ মতো—কোথায় কোন খাতে কীভাবে অনুদানের অর্থ ব্যয় হবে, তার যাবতীয় শর্ত মেনে নিলে তবেই সে অনুদান মিলবে। দেখা গেছে, অতি ধনী দাতাদের প্রদত্ত অর্থের প্রায় ৬০ শতাংশ যাচ্ছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে। অবশিষ্ট ৪০ শতাংশের সিংহভাগ শিক্ষা ক্ষেত্রে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অতি ধনীরা নিজেরা যেসব কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন, যার বেশির ভাগ ব্যক্তিমালিকানাধীন, সেখানেই টাকা ছড়াচ্ছেন। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমনিতেই সম্পদশালী, তাদের একটা বড় কাজ চলতি অসাম্যের ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার পক্ষে শিক্ষার্থীদের জন্য যুক্তি খাড়া করা। আর সেই সব বিদ্যালয়েই অতিরিক্ত অর্থ ঢালা হচ্ছে, তা–ও সরকারিভাবে কর মওকুফের সুযোগ ব্যবহার করে। বিল ক্লিনটনের সাবেক শ্রমমন্ত্রী রবার্ট রাইশ মন্তব্য করেছেন, দান–খয়রাতের নামে ধনীরা যে কাণ্ড করছেন, তা আসলে ন্যায্য কর দেওয়া থেকে নিস্তার পাওয়ার একটা সহজ পথ ছাড়া আর কিছু নয়।

আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তো এ কথার সেরা উদাহরণ। তিনি দান-ধ্যান করবেন বলে এক ফাউন্ডেশন খুলে বসেছিলেন। আর সে ফাউন্ডেশন থেকে তিনি করমুক্ত যে অর্থ সংগ্রহ করেন—কিছু নিজের, অধিকাংশই অন্যের—তার অধিকাংশই ব্যয় হয় নিজের পোষা প্রকল্পের সমর্থনে। এমনকি তিনি নিজের পোর্ট্রেট কেনার জন্যও এই ফাউন্ডেশনের হাজার হাজার ডলার খরচ করেছেন। তদন্ত করতে গিয়ে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরোনোর অবস্থা শুরু হলে সে ফাউন্ডেশন বন্ধ করে দেওয়া হয়।

বাংলাদেশের দাতব্য সংস্কৃতির অবস্থা খুব যে ভিন্ন, তা নয়। একটা সময় ছিল যখন রাজা-বাদশাহ-জোতদার-জমিদার দান-ধ্যানের নামে মসজিদ–মন্দির বানিয়েছেন, কেউ কেউ পাঠাগার বা বিদ্যালয়। এত দিন পরে আমরা সবাই ভুলে গেছি কী প্রবল অত্যাচারী ছিলেন সেই ক্ষমতাবানেরা অথবা খাজনা আদায় করতে কীভাবে লাঠিয়ালদের ব্যবহার করেছেন। তাজমহলকে মনে রেখেছি, কিন্তু যে ২০-২২ হাজার শ্রমিকের রক্তে ও অশ্রুতে সে স্মৃতিস্তম্ভের নির্মাণ, তাঁদের কথা মনে রাখিনি, তাঁদের নামও আমরা জানি না। সাম্প্রতিক সময়ে যে এই অবস্থা বদলেছে, তা মনে হয় না। এখন যাঁরা দান-খয়রাত করে নাম করেছেন, তাঁদের প্রায় সবাই হয় ঋণখেলাপি, নয়তো বাঁকা পথে সম্পদ বানিয়েছেন। তাঁরা সবাই চাইছেন কিছু টাকা ছড়িয়ে গায়ের ময়লা দাগ কিছুটা হলেও ধুয়ে ফেলতে।

তাহলে ধনীরা তাঁদের সম্পদ নিজেরাই ভোগ করুন, কোনো সামাজিক কাজে ব্যয় না করুন, সেটাই অধিক যুক্তিপূর্ণ? যাঁরা অতি ধনীদের বদান্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, তাঁরা কেউই সে কথা বলেন না। তাঁরা শুধু বলছেন সামাজিক পরিবর্তনের লক্ষ্য হওয়া উচিত হাতে ব্যান্ড এইড লাগিয়ে রক্তক্ষরণ বন্ধ নয়, রক্তক্ষরণের কারণকে আঘাত করা। সামাজিক বৈষম্য ও বণ্টনের অসাম্য টিকিয়ে রেখে প্রকৃত পরিবর্তন সম্ভব নয়। রবার্ট স্মিথ মোরহাউস কলেজের ৪০০ শিক্ষার্থীর অবস্থা বদলাতে সাহায্য করেছেন ঠিকই, কিন্তু যে অসম শিক্ষাব্যবস্থার কারণে লাখ লাখ শিক্ষার্থী ঋণের ভারে নুইয়ে রয়েছেন অথবা আগামী দিনে যাঁরা এই বোঝা মাথায় তুলে নেবেন, তাঁদের কী হবে? আসলে ধনীরা কাকের জন্য ভাত ছড়ালে দুই-চারজনের সুবিধা হয়তো হয়, কিন্তু অসাম্যের কাঠামোগত চরিত্র কখনোই বদলায় না। পৃথিবীও বদলায় না।

ধনীরা নিজেরাই এই কাঠামোগত পরিবর্তন আনবেন, এ কথা কেউ বলে না। তেমন আশা করাও অন্যায়। ধনীরা যদি সত্যি পরিবর্তন চান, ন্যূনতম যে কাজটি তাঁরা করতে পারেন তা হলো নিজেরাই নিজেদের সম্পদের পুনর্বণ্টনের দায়িত্ব না নিয়ে সামাজিক উদ্যোগের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া। তাঁরা যদি নিজেদের ব্যক্তিগত অগ্রাধিকারকে প্রাধান্য না দিয়ে সাধারণ কল্যাণের বড় ছবিটা মাথায় রাখেন, তাহলে অল্পবিস্তর ভালো কাজ নিশ্চয় অর্জন সম্ভব। এ জন্য প্রথম কাজই হবে যাঁদের জন্য এই দান, তাঁদের সে কাজে যুক্ত করা। গ্রামে যদি একটা রাস্তা বানানোর জন্য দান আসে, তাহলে সে রাস্তা কোন দিক দিয়ে গেলে ভালো হয়, এ কথা গ্রামের মানুষের চেয়ে ভালো আর কে জানবে?

হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি