কাক-সংকটে মাতৃস্বাস্থ্য

জনশ্রুতি আছে যে কাক নাকি বিপদ দেখলে চোখ বন্ধ করে ফেলে। বন্ধ চোখে—কোথাও কোনো বিপদ নেই, সবকিছু ঠিকঠাক আছে—এ-জাতীয় একটা স্বস্তি দিয়ে নিজেকে ভোলাতে চায়। বাংলাদেশের মাতৃস্বাস্থ্যের ইতিহাস এবং ঘটনাবলির দিকে তাকালে আমার কাকের কথিত বুদ্ধিবৃত্তিক সংকটের কথা মনে হয়। নিরাপদ মাতৃত্ব দিবসে এই সংকটকে বোঝা অতি গুরুত্বপূর্ণ এই জন্য যে আর মাত্র সাড়ে ১০ বছরের মধ্যে আমাদের মাতৃস্বাস্থ্যের উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে মাতৃমৃত্যুর হারকে প্রতি লাখ জীবিত জন্মে ৭০-এর নিচে নামিয়ে আনা, যেটি এখন ১৭৬ (দুষ্টলোকদের মতে ১৯৬!)।

গত এক দশকে আমাদের মাতৃমৃত্যুর হার কমেনি। এতে যেকোনো দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ঘুম হারাম হয়ে যাওয়ার কথা, কাছা বেঁধে লেগে পড়ার কথা করণীয় নির্ধারণে। কিন্তু তা না করে আমাদের মন্ত্রণালয় জরিপের ফলাফলকে ধামাচাপা দেওয়ার হাস্যকর চেষ্টায় সময় নষ্ট করেছে। আত্মঘাতী, অপ-আনুগত্যের অতিশয়োক্তি করে কেউ কেউ এখনো বলছেন, ‘জরিপ ভুল’, কেন ভুল? কোথায় ভুল? ‘তা জানি না, কিন্তু ভুল—মাতৃমৃত্যু আসলে অনেক কম, শুধু জরিপে তা ধরা পড়ছে না।’ এই ‘কাক-সংকট’ নতুন নয়, অনেক পুরোনো।

সত্তরের দশকের শেষে শুরু হয়েছিল সনাতন ধাই প্রশিক্ষণ কর্মসূচি। প্রতিটি ইউনিয়ন থেকে ১৫ জন ধাই নির্বাচন করে তিন মাস প্রশিক্ষণ দেওয়া হলো, প্রায় ১৫ বছরে প্রশিক্ষণ দেওয়া হলো ৬০ হাজারের বেশি ধাইকে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি জরিপ করে দেখা গেল, এই ধাইরা মাত্র ১৬ শতাংশ ডেলিভারি করেন এবং তিন মাসের প্রশিক্ষণ তাঁদের দীর্ঘদিনের ক্ষতিকর অভ্যাসগুলো দূর করতে পারেনি। ভুল নির্বাচন, ভুল প্রশিক্ষণ, প্রশিক্ষণোত্তর সহায়তা ও সামগ্রিক কর্মসূচি ব্যবস্থাপনার অভাব এই কর্মসূচিকে ব্যর্থতায় নিয়ে গেল। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা দিয়ে সেই সঙ্গে বের হলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণার ফলাফল—‘সনাতন ধাই প্রশিক্ষণ কর্মসূচি’ দিয়ে মাতৃমৃত্যু কমানো সম্ভব নয়। মন্ত্রণালয় ধাইদের থেকে হাত মুছে ফেলল, ধাই প্রশিক্ষণের নাম নেওয়া হয়ে গেল মহাপাপ। অথচ এই ধাইরাই এখনো সদর্পে প্রায় ৫০ শতাংশ ডেলিভারি করে চলেছেন। শুধু ধাই প্রশিক্ষণ দিয়ে মাতৃমৃত্যু কমানো সম্ভব নয়, এটা সত্যি, কিন্তু প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাঁদের দিয়ে পরিচ্ছন্ন ডেলিভারি নিশ্চিত করা এবং ক্ষতিকর আচরণ বন্ধ করা সম্ভব। বৈশ্বিক গবেষণার ফলকে আমরা পরিপ্রেক্ষিত উপযোগী করতে পারিনি। বাদ দিলাম তো একেবারেই দিলাম, ‘অল অর নান ল’।

নব্বইয়ের শেষে এসে শুরু হলো জরুরি প্রসূতিসেবার যজ্ঞ। এটি মাতৃস্বাস্থ্য কর্মসূচির অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। চলল যন্ত্রপাতি কেনা, ওটি তৈরি, প্রসূতিবিদ ও অবেদনবিদদের জোড়ায় জোড়ায় প্রশিক্ষণ এবং পদায়ন। প্রায় ২০ বছর জরুরি প্রসূতিসেবা কর্মসূচি চলার পরও আমরা সবাই জানি যে এই কর্মসূচিকে দেশব্যাপী কার্যকর করা যায়নি। মন্ত্রণালয়ের অকার্যকর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে অদক্ষতার কারণে এখনো ১৩ শতাংশ জেলা হাসপাতাল এবং প্রায় ৭৫ শতাংশ উপজেলা হাসপাতালে প্রসূতিবিদ-অবেদনবিদের জোড়া রাখা সম্ভব হয়নি, যা ছাড়া জরুরি প্রসূতিসেবা সম্ভব নয়। কাজের চেয়ে বড় অকাজ হয়েছে, একদিকে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার মা প্রয়োজনে পাচ্ছেন না সিজারিয়ান অপারেশন সেবা, অন্যদিকে অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান বেড়ে গেছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। অভিভাবকহীন অনাথের মতো অবহেলায় বেঁচে আছে এই জীবন রক্ষাকারী কর্মসূচি—‘আছে কিন্তু নেই’।

এই শতাব্দীর শুরুতে এসে একজন প্রভাবশালী প্রসূতিবিদের প্রায় একক উদ্যোগে আমরা নেমে পড়লাম কমিউনিটি স্কিলড বার্থ অ্যাটেনডেন্ট (সিএসবিএ) কর্মসূচি নামক এক উদ্ভাবনী কর্মকাণ্ডে। পরিবারকল্যাণ সহকারী ও স্বাস্থ্য সহকারীরা প্রশিক্ষিত হতে থাকলেন ধাই হিসেবে। না হলো এই প্রশিক্ষণ আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন, না হলো প্রশিক্ষিত সিএসবিএদের কার্যপরিধি বা কর্ম ব্যবস্থাপনার কোনো পরিবর্তন, না দেওয়া হলো কোনো প্রশিক্ষণ-পরবর্তী সহায়তা। ফলাফল যা হওয়ার তা-ই হলো। একাধিক জাতীয় জরিপে দেখা গেল, প্রায় ১১ হাজার সিএসবিএ প্রশিক্ষণের পরও মাত্র ১ শতাংশ ডেলিভারিতে সহায়তা করেছেন। সনাতন ধাই প্রশিক্ষণের একই ভুল আমরা আবার করলাম। কাজ হোক না হোক, প্রশিক্ষণ চলতে থাকল, এখনো চলছে, চলবে। আমরা চালু করতে জানি, থামাতে জানি না। মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নতি না হোক, কারও কারও উন্নতি নিশ্চয়ই হচ্ছে।

আমাদের সর্বশেষ কর্মসূচি হচ্ছে মিডওয়াইফ বা ধাত্রী প্রশিক্ষণ। আশার কথাটি হচ্ছে, এটি একটি পরীক্ষিত প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, যা মাতৃমৃত্যু রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। ইতিহাসের ঘর পোড়া গরু হিসেবে এখনই কতগুলো বিষয় সমাধান করা দরকার, না হলে মিডওয়াইফ কর্মসূচিও ভুলের দীর্ঘযাত্রায় নবতম সংযোগ হবে মাত্র।

সারা দেশের সব স্বাভাবিক প্রসব পরিচালনা করতে হলে ২২ হাজার মিডওয়াইফ প্রয়োজন। এখন পর্যন্ত প্রায় ৫ হাজার মিডওয়াইফ প্রশিক্ষিত হয়েছেন, ২ হাজার ৪০০ জন পদায়িত হয়েছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও সাব-সেন্টারে। অতীতের শিক্ষা বলে, প্রশিক্ষণোত্তর পূর্ণাঙ্গ সহায়তা ও পুনঃপ্রশিক্ষণের ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মিডওয়াইফদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দেশব্যাপী প্রাথমিক সেবা পর্যায়ে (যেমন, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণকেন্দ্র) প্রয়োজনের নিরিখে বণ্টন এবং কর্মস্থলে অবস্থান নিশ্চিত করা। এখনো প্রয়োজনীয় পদ সৃষ্টি হয়নি, এখনো প্রশিক্ষণ শেষে মিডওয়াইফরা সিনিয়র স্টাফ নার্স বা যেকোনো সাধারণ নার্সের মতো দায়িত্ব পালন করছেন। অর্থাৎ, তাঁদের পেছনে বিনিয়োগ ও অর্জিত দক্ষতা কাজে লাগানো হচ্ছে না। মনে রাখতে হবে, কতজন মিডওয়াইফ প্রশিক্ষিত হলেন, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কত শতাংশ ডেলিভারি পরিচালনা করল। এটাই এই মুহূর্তের গুরুত্বপূর্ণ সূচক।

আমাদের হয়েছে পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্তের ভুল, হয়েছে বাস্তবায়নের ভুল, ভুল থেকে না শেখার ভুল, ভুল না শোধরানোর ভুল, ভুল থেকে ভুল শেখার ভুল, সাময়িক সাফল্যে সামগ্রিক বাস্তবতা ভুলে যাওয়ার ভুল এবং সবচেয়ে মারাত্মক, ভুল স্বীকার না করার ভুল। এটাই সেই ‘কাক-সংকট’। ভুলগুলোর মাশুল গুনতে হচ্ছে অপরিসীম মূল্যে। প্রতিবছর ৬ হাজার মায়ের জীবন দিয়ে এবং অগুনতি মায়ের দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক বৈকল্য দিয়ে। এই যুগে কোনো সভ্য জাতির কাছে এই মূল্য গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত নয়।

ইশতিয়াক মান্নান জনস্বাস্থ্যকর্মী